শুরু হয়ে গেল ভারতের গ্রীষ্মকালীন টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট উৎসব ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ বা আইপিএল এর একাদশতম সংস্করণ। প্রতিবারের মতো এবারেও এই প্রতিযোগিতা চলবে প্রায় দুই মাস। দেশ-বিদেশের ভালো ভালো খেলোয়াড়রা এতে যোগ দেওয়ার জন্যে মুখিয়ে থাকেন, কারণ অর্থ এবং যশ। আইপিএল এ খেলার জন্যে দেশের হয়ে আন্তর্জাতিক খেলা ছেড়েছেন, এমন উদাহরণও রয়েছে ক্রিকেট বিশ্বে। এক কথায়, আইপিএল এর প্রবর্তন ভারত তো বটেই, বিশ্ব ক্রিকেটেও এনেছে এমন এক বৈপ্লবিক বদল, যার প্রভাব সর্বব্যাপী। অতীতে অস্ট্রেলিয়ার কেরি প্যাকারের সিরিজও এমন এক বিপ্লব ক্রিকেট দুনিয়ায় এনেছিল, কিন্তু আইপিএল এর ব্যাপ্তি তার চেয়েও অনেক বড়।
আইপিএল ‘গ্লোবাল’ এবং ‘লোকাল’-এর দুর্দান্ত সংমিশ্রণ
এবারের আইপিএল এ কিছু ভালো খেলোয়াড় চোট অথবা শাস্তির কারণে একেবারে শেষ সময়ে ছিটকে গিয়েছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার মিচেল স্টার্ক, স্টিভ স্মিথ, ডেভিড ওয়ার্নার এবং দক্ষিণ আফ্রিকার কাগিসো রাবাডা। এতে নিশ্চিতভাবে এবারের আইপিএল এর জৌলুশ একটু হলেও ফিকে হবে। কারণ, এরা প্রত্যেকেই এই মুহূর্তে বিশ্ব ক্রিকেটের বড় বড় সব নাম। কিন্তু আইপিএল এর প্রভাব বিশেষভাবে খর্ব হবে না, কারণ, আইপিএল শুধুমাত্র একটি ক্রিকেট প্রতিযোগিতা নয়, এটিকে বলা চলে একটি গ্লোকাল ইন্ডাস্ট্রি যেখানে ‘গ্লোবাল’ এসে মিশেছে ‘লোকাল’-এর সঙ্গে এবং এই দুইয়ের সংমিশ্রণে তৈরি হয়েছে জনপ্রিয়তার এক অভূতপূর্ব উপাদান।
১৯৮৩ সালের বিশ্বকাপ জয় ভারতের ক্রিকেট ইতিহাসে প্রথম বড় বদলটি আনে
১৯৮৩ সালে ইংল্যান্ডে কপিল দেবের নেতৃত্বে ভারত প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ জিতলে তা দেশের সামাজিক জীবনে বড় বদল নিয়ে আসে। সেই সময়ে বিশ্ব ক্রীড়ার দরবারে ভারতের একমাত্র সমীহ আদায় করার যে খেলাটি ছিল- হকি, তার স্থান ক্রমেই নিম্নাভিমুখী হতে শুরু করে।
১৯৮০ সালে ভারত হকিতে শেষবারের মতো অলিম্পিক সোনা জিতলেও যেহেতু পশ্চিমের বহু দেশই আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ডামাডোলের কারণে রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত সেই অলিম্পিকটি বয়কট করে, তাই স্বাভাবিকভাবেই ভারতের অর্জিত সোনার গুরুত্ব ততটা বিশেষ ছিল না। আর এই তিন বছর পরে কপিল দেবের দল তখনকার এক নম্বর দল ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে বিশ্বচ্যাম্পিয়নের খেতাব জিতলে হকিকে পাকাপাকিভাবে শীর্ষ স্থানচ্যূত করে ক্রিকেট। এরপর পঁচাশিতে ভারত অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠিত আরেকটি বহুদলীয় প্রতিযোগিতা জিতে প্রমাণ করে যে, তাদের দু’বছর আগেরকার জয়টি ফ্লুক ছিল না। আর এরপরেই ক্রিকেট অলিখিতভাবে দেশটির জাতীয় খেলায় পরিণত হয়।
কপিল দেবের শীর্ষ সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে নতুন প্রজন্মও আকৃষ্ট হয়ে পড়ে ক্রিকেটের দিকে এবং তাদের হাত ধরে ক্রিকেটের প্রভাব উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতেই থাকে দেশটির জনমানসে। কপিল দেব-সুনীল গাভাস্কারের পরবর্তী সময়ে শচীন টেন্ডুলকার-রাহুল দ্রাবিড়দের এবং তারও পরে মহেন্দ্র সিংহ ধোনি এবং বিরাট কোহলিদের মাধ্যমে ক্রিকেটের জয়যাত্রা অব্যাহত থাকে ভারতের মাটিতে। এর পাশাপাশি, এই খেলাটির চূড়ান্ত বাণিজ্যিকীকরণও ভারতের মতো বিপুল বাজারসমৃদ্ধ দেশে ক্রিকেটকে সাফল্যের চূড়ায় নিয়ে যায়।
তিরাশির সাফল্য ভারতের মতো বদ্ধ অর্থনীতিকে উজ্জীবিত করেছিল; ‘আমরাও পারি’ মানসিকতার সূত্রপাত ঘটিয়েছিল। ঘরে ঘরে টেলিভিশনের জনপ্রিয়তার ফলে গুরুত্ব বেড়েছিল গণমাধ্যম এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার। বলতে গেলে, তৈরি হয়েছিল এক প্রকারের জাতীয় আইডেন্টিটি। তার আগে পর্যন্ত টেস্ট ক্রিকেটে শুধুমাত্র ড্রয়ের জন্যে খেলা ভারতের নেতিবাচক ভাবমূর্তিকে যেন এক মুহূর্তে চুরমার করে দেয় তৎকালীন বিশ্বসেরাদের বিরুদ্ধে এই অপ্রত্যাশিত জয়।
২০০৭ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জয়ও বদলে দেয় ভারতীয় ক্রিকেটের চেহারা
ঠিক তেমনভাবেই, ২০০৭ সালের ৫০ ওভারের বিশ্বকাপে ভারতের চূড়ান্ত ব্যর্থতার পরেই আসে আরেকটি মাইলফলক। সেবছর ওয়েস্ট ইন্ডিজে আয়োজিত বিশ্বকাপ ক্রিকেটে বাংলাদেশ এবং শ্রীলঙ্কার কাছে হেরে ভারত প্রতিযোগিতার প্রাথমিক পর্যায়েই বিদায় নেয়। দেশজুড়ে এর জন্যে চরমভাবে ধিকৃত হয় ভারতের জাতীয় দল।
সেই সময়ের ভারতীয় ক্রিকেট দলের বড় নামগুলোর প্রায় সবাই তাদের নিজ নিজ ক্যারিয়ারের অপরাহ্নের দিকে এগুচ্ছিলেন। নতুন প্রজন্মের খেলোয়াড়দের উঠে আসা তখন জরুরি হয়ে পড়েছিল। সেই বছরেরই সেপ্টেম্বর মাসে দক্ষিণ আফ্রিকায় বসে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আসর।
ভারতের সিনিয়র খেলোয়াড়দের অনেকেই তাতে যেতে চাননি। কারণ, হয়তো তারা ভেবেছিলেন ৫০ ওভারের পরে বিশ ওভারের ক্রিকেটের এই নয়া ফরম্যাটেও যদি হার মানতে হয়, তবে তা তাদের ভাবমূর্তির পক্ষে মোটেই ভালো হবে না। ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড তাই ধোনির নেতৃত্বে একটি কমবয়সী খেলোয়াড়দের দল পাঠায় দক্ষিণ আফ্রিকায় এবং কী আশ্চর্য! তিরাশির মতো দু’হাজার সাতেও ভারত ফের অপ্রত্যাশিতভাবে জিতে নেয় বিশ্বকাপের মুকুট। এবং এবারে চিরকালীন প্রতিপক্ষ পাকিস্তানকে ফাইনালে ৫ রানে হারিয়ে।
ধোনি, যিনি পরে আইপিএল-এর অন্যতম সফল অধিনায়ক হিসেবেও নাম কেনেন, পরে সংবাদমাধ্যমের সামনে স্বীকার করেন যে, ২০০৭ এর বিশ্বকাপে পরাজয়ের গ্লানি তাকে একজন পরিপূর্ণ ক্রিকেটার হিসেবে গড়ে উঠতে সাহায্য করেছিল। ধোনি নিজেও সেই বিশ্বকাপে ভারতীয় দলের অংশ ছিলেন এবং দল ছিটকে যাওয়ার পরে রাঁচিতে ধোনির নির্মীয়মাণ বাড়িতে চড়াও হয় সমর্থকরা, ছোঁড়া হয় ইট-পাটকেলও।
ফের তিরাশির ম্যাজিকের মতো কাজ করে দু’হাজার সাতের জয়ও। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা রাতারাতি বেড়ে যায় বহুগুণ এবং যে ভারতীয় বোর্ড সেই সময় পর্যন্ত এই ধরনের ক্রিকেট নিয়ে বিশেষ আগ্রহী ছিল না, তারাও লেগে পড়ে এই ফরম্যাটের শ্রীবৃদ্ধিতে।
তাছাড়া, এই সময়ে ভারতে ইন্ডিয়ান ক্রিকেট লিগ বলে একটি ‘বিপ্লবী’ টি-টোয়েন্টি প্রতিযোগিতাও চালু হয় দেশের ক্রিকেট বোর্ডকে চ্যালেঞ্জ করে। একটি বেসরকারি সংস্থা অতীতে ভারতীয় বোর্ডের কাছ থেকে ম্যাচ সম্প্রচার স্বত্ব আদায় না করতে পেরে এই বিপ্লবের পথে হাঁটে বোর্ডকে শিক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে।
কিন্তু ভারতীয় ক্রিকেটের পরাক্রমশালী বোর্ড এই বিপ্লবকে প্রতিহত করতে চালু করে আইপিএল। ২০০৮ সালে শুরু হওয়া এই প্রতিযোগিতা আইসিএল এর কারিকুরি খতম করে দেয় তো বটেই, সঙ্গে সঙ্গে টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটের হাত ধরে ভারতের ক্রিকেট ইতিহাসে এক নয়া অধ্যায়ের সূচনা করে।
কপিল দেবের সময়কার বিশ্বজয় যেমন ক্রিকেট খেলুড়ে দেশ হিসাবে ভারতের নাম উজ্জ্বল করেছিল; দেশের মানুষের আত্মবিশ্বাসকে যেমন উজ্জীবিত করেছিল, ধোনির ২০০৭ এর বিশ্বজয় বিশ্বের সামনে হাজির করায় এক নতুন ভারতকে। যে ভারত সমস্ত ক্রিকেট বিশ্বকে নিজের খেলোয়াড়ি এবং অর্থনৈতিক কর্তৃত্ব দেখায়, বিশ্বক্রিকেটের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়ায় এবং সবচেয়ে বড় কথা, ক্রিকেটের যেখানে এক সম্পূর্ণ গণতন্ত্রীকরণ ঘটে।
একসময়ের রাজা-রাজড়া-অভিজাতদের খেলা ক্রিকেট আজকের ভারতে এক সম্পূর্ণরূপে জনসাধারণের খেলা আর এই পরিবর্তন এনেছে কপিল দেব এবং ধোনি উভয়েরই বিশ্বজয় (২০০৭ এর পরে ধোনি ২০১১ সালেও ভারতকে তাদের ৫০ ওভারের দ্বিতীয় বিশ্বকাপটি এনে দেন)। আর কপিল দেবের বিশ্ব খেতাব যদি ক্রিকেটকে ভারতের মধ্যবিত্তের গর্বের খেলায় রূপান্তরিত করে, ধোনির টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জয় তাকে প্রতিষ্ঠিত করেছে সমসাময়িক ভারতের নব্য-মধ্যবিত্তের প্রিয়তম মনোরঞ্জনে। আর আইপিএল সেই মনোরঞ্জনকে দান করেছে পরিপূর্ণতা।
আইপিএল ভারতের শহরভিত্তিক উন্নয়নের পরিচায়ক
আইপিএল এর আরেকটি বিশেষত্ব হচ্ছে, তা ভারতের শহরভিত্তিক উন্নয়নের দাবিকে প্রতিষ্ঠা দেয়। আজকের ভারতে যে শিক্ষিত শহুরে মধ্যবিত্তের বেশ বড় গুরুত্ব দেশের রাজনৈতিক বা অার্থ-সামাজিক পরিসরে, তা প্রমাণ করে আইপিএল এর শহরভিত্তিক বিন্যাস। একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে যে, আইপিএল এর দলগুলোর বেশিরভাগই দেশটির দ্রুত উন্নয়নশীল শহরগুলোর নামে তৈরি। এর পেছনে কাজ করে এক ধরনের অর্থনৈতিক চিন্তা, অর্থাৎ আজকের ভারতের উন্নয়নের মুখ শহরকেন্দ্রিক; শহরের নাম ক্রিকেট দল চালু করলে তাতে দর্শকের মধ্যেও একধরনের প্রতিযোগিতার উদ্ভব ঘটবে এবং স্থানীয় আবেগকে উস্কে দিয়ে আরও বেশি করে ব্যবসা চালানো যাবে।
সন্ধ্যাবেলায় বিশ ওভারের টানটান উত্তেজনার ক্রিকেট আয়োজন করলে অফিসফেরত মানুষকেও মাঠমুখী করা যাবে আর তাতে মুনাফা বাড়বে হৈ হৈ করে। আর পাশাপাশি, এই দলগুলোর মধ্যে যদি আন্তর্জাতিক তারকাদের মহামিলন ঘটানো যায়, তাহলে তো কথাই নেই।
আইপিএল এর সমালোচনা ধোপে টেকে না
আইপিএল এর সমালোচকের সংখ্যা নেহাত কম নয়। অনেকেই বলে থাকেন, এটি কোনো ক্রিকেটই নয়। বরং অন্তঃসারশূন্য আওয়াজ। কিন্তু এই সমালোচনা ধোপে টেকে না। আইপিএল এর মাধ্যমে আজ পরবর্তী প্রজন্মের খেলোয়াড় উঠে আসছে; খেলাটির আরও গণতন্ত্রীকরণ ঘটছে।
টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের বদৌলতে ভারতের রাঁচির মতো একটি ছোট শহর যদি ধোনির মতো একজন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন অধিনায়ককে উপহার দিতে পারে, তাহলে এটি মানতেই হবে যে, এই ধরনের ক্রিকেট খেলাটির আরও গণতন্ত্রীকরণ ঘটাবে। আর যত এই প্রসার ঘটবে, তত ব্যবসা ফুলে ফেঁপে উঠবে, ক্রিকেটও সমৃদ্ধ হবে।
আইপিএল এর দৌলতে যে স্থানীয় খেলোয়াড়দের সঙ্গে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক তারকাদের মেলামেশা ঘটে একই শিবিরে, একজন অখ্যাত খেলোয়াড়ের উন্নতির জন্য এটিও কম নয়। আইপিএল সেই কাজটিও করে দিচ্ছে এবং সমর্থন কুড়াচ্ছে প্রচুর।
আইপিএল গত এক দশক ধরে ক্রমাগত হয়ে আসছে তার কারণ হলো এর জনপ্রিয়তা। যেহেতু টি-টোয়েন্ট ক্রিকেটে রোমাঞ্চের উপাদান সর্বদা মজুদ, তাই তার ব্যর্থ হওয়ার সুযোগ কম। আর তার পাশাপাশি যদি বাজার এবং ব্যবসার পরিপূর্ণ আশীর্বাদ পাওয়া যায়, তবে তো সোনায় সোহাগা। ভারতের ক্রিকেট বোর্ড আইপিএল এর আকর্ষণ বজায় রাখতে ভারতীয় ক্রিকেটারদের পৃথিবীর অন্য কোনো দেশের প্রতিযোগিতায় খেলতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। অর্থনৈতিক নিরিখে এই সিদ্ধান্ত যথেষ্ঠ গুরুত্বপূর্ণ যদিও নিন্দুকের মতে, এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ক্রিকেটের সার্বিক গুণমান।
কিন্তু গুণমান রক্ষার থেকেও ক্রিকেট বোর্ডগুলোর আজ মাথাব্যথা নিজেদের বাজার রক্ষা করার। আর বিশেষ করে পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী বোর্ড বিসিসিআই এর মাথাব্যথা সবচেয়ে বেশি। আইপিএল নামক সোনার ডিম পাড়া হাঁসটিকে তাই আজ তারা সবদিক দিয়েই আগলে রেখেছে।
Featured Image Source: Sportzwiki