নানা জল্পনার পরে অবশেষে গত ৮ মে মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৫ সালে ইরানের সঙ্গে সম্পন্ন হওয়া পারমাণবিক চুক্তি থেকে তার দেশের নাম প্রত্যাহার করে নেন । ১২ মে ছিল ইরান সম্পর্কে ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত জানানোর সময়সীমা। তিনি তার চার দিন আগেই জানিয়ে দেন যে, ওয়াশিংটন আর এই চুক্তির মধ্যে থাকতে রাজি নয়। ট্রাম্প বরাবরই ইরান চুক্তির বিরোধিতা করে এসেছেন; চুক্তিটিকে ‘অবিশ্বাস্য’ এবং ‘হাস্যকর’ বলেও বিদ্রুপ করেছেন এবং বারংবার হুমকি দিয়ে এসেছেন যে, অবিলম্বে এই চুক্তির ‘ভুলত্রুটি’ না শোধরালে তিনি তা ত্যাগ করবেন।
যেহেতু ইরানের সঙ্গে সম্পাদিত হওয়া চুক্তিটি দ্বিপাক্ষিক নয় এবং তাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইরান ছাড়াও রয়েছে বিশ্বের অন্যান্য বড় শক্তিগুলোও, তাই ফ্রান্স, ইংল্যান্ড এবং জার্মানির পক্ষ থেকে মার্কিন নেতৃত্বের কাছে আবেদন করা হয় চুক্তিটিকে খারিজ না করতে। কিন্তু আপন মর্জির মালিক ট্রাম্প কারও কথাতেই কান না দিয়ে তার চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটি নিয়ে ফেলেন।
ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত বিশ্বজুড়ে নিন্দিত হয়। ইরান এবং মার্কিন জোটসঙ্গীরা তো বটেই, আমেরিকার অভ্যন্তরেও এই নিয়ে ধিকৃত হন ট্রাম্প। “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমস্ত সম্মান আজ দেশের প্রেসিডেন্ট ধুলোয় মিশিয়ে দিলেন” বলেও সমালোচনা শোনা যায়।
কথাটা মিথ্যে নয়। ট্রাম্পের এই হঠকারিতা আজ বিশ্ব রাজনীতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তো বটেই, পাশাপাশি অন্যান্য অনেক দেশের স্বার্থও প্রবলভাবে ক্ষুণ্ণ করেছে এবং তাদের মধ্যে রয়েছে ভারতও।
ওবামার সময়ের এই চুক্তি ভারতকে স্বস্তি দিয়েছিল ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষার্থে
২০১৫ সালে তৎকালীন বারাক ওবামা প্রশাসন এবং বিশ্বের অন্যান্য শক্তিগুলো মিলে ইরানের সঙ্গে পরমাণু বিষয়ক চুক্তি সম্পাদনা করার ফলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে নয়াদিল্লি। তার কারণ, তেহরান অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং ভূ-রাজনৈতিক অর্থে নয়াদিল্লির কাছে যথেষ্ঠ গুরুত্বপূর্ণ। ইরানের উপর পশ্চিমের একগাদা নিষেধাজ্ঞা চাপানো থাকলে ভারতের পক্ষে দু’পক্ষের সাথেই ভালো সম্পর্ক রাখতে যে যথেষ্ঠ ভারসাম্য দেখাতে হয়, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
সেদিক থেকে ওবামা, যার সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং তার পূর্বসূরি মনমোহন সিংয়ের বেশ ভালো সম্পর্ক ছিল, ভারতকে স্বস্তি দেন। ভারতও ইরানের সঙ্গে বহির্বিশ্বের সঙ্গে নতুনভাবে গড়ে ওঠা রসায়নের সুযোগ নিয়ে তেহরানের আরও কাছাকাছি আসার সংকল্প নেয়, লক্ষ্য ছিল ইরান এবং আফগানিস্তানের সঙ্গে হাত মিলিয়ে আঞ্চলিক শান্তিতে ব্যাঘাত ঘটানো পাকিস্তানকে কোণঠাসা করা।
ইরানের চাবাহার বন্দরের উন্নয়ন ভারতের বিদেশনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়
এ কাজে ভালো এগোচ্ছিলও ভারত। ২০১৬ সালের মাঝামাঝি মোদী স্বয়ং আফগানিস্তান এবং ইরানে যান ওই দুই দেশের সঙ্গে যোগাযোগ এবং সহযোগিতা আরও দৃঢ় করতে। ইরানের চাবাহার বন্দরের উপর একটি চুক্তিপত্রে সই করে ইরান এবং ভারত। পাকিস্তান-চীন কর্তৃক তৈরি হওয়া গবদর বন্দরের বিকল্প ভূ-রাজনৈতিক চাল হিসেবেই দেখা হয় ইরান-ভারতের এই সমঝোতাকে। চাবাহারের মাধ্যমে আফগানিস্তানের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা আরও উন্নত করার পরিকল্পনাও হয়। আর এসবই করা হয় পাকিস্তানের ভূমি এড়িয়ে, অথচ তাকে বেষ্টিত করেই।
পাকিস্তানকে এড়িয়ে ইরান, আফগানিস্তান হয়ে মধ্য এশিয়াকেও ভারতের হাতের কাছে নিয়ে আসতে পারে এই পরিকল্পনা। চাবাহার বন্দরের উন্নয়নার্থে ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করার প্রতিশ্রুতিও দেয় ভারত। সব মিলিয়ে, ভারত এবং ইরানের মধ্যে এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সহযোগিতার সম্ভাবনা তৈরি করেছিল এই চাবাহার কূটনীতি। দক্ষিণ এশিয়ায় চীন-পাকিস্তানের সহযোগিতা এবং তার ‘বেল্ট এন্ড রোড’ উদ্যোগের মধ্যে দিয়ে যে প্রভাব বিস্তার করার পরিকল্পনা করেছে চীন; ইরান-আফগানিস্তান-এর সঙ্গে হাত মিলিয়ে তার প্রতি-পরিকল্পনা করার দিকেও ভালোই এগোচ্ছিল ভারত।
এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসেও ইরানের রাষ্ট্রপতি হাসান রুহানি যখন ভারতে আসেন, এই দুই দেশের মধ্যে সাক্ষরিত হয় অনেকগুলো চুক্তি, যার মধ্যে একটি ভারতীয় কোম্পানিকে চাবাহার বন্দরের আংশিক ইজারা দেওয়ার কথাও বলা হয়।
কিন্তু ট্রাম্পের হঠকারী সিদ্ধান্ত ভারতের সমস্ত পরিকল্পনাকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিয়েছে
কিন্তু এই সমস্ত পরিকল্পনায় আপাতত প্রায় ঠাণ্ডা জল ঢেলেছে ট্রাম্পের ৮ মে-র সিদ্ধান্ত। একে তো ইরানের উপর নতুনভাবে নিষেধাজ্ঞার খাঁড়া নেমে এলে ইরানের থেকে তেল আমদানি করতে ভারতকে যথেষ্ঠ বেগ পেতে হবে; সেই সাথে জ্বালানির মূল্যের বড়সড় তারতম্যের ফলে মূল্যবৃদ্ধির ধাক্কায় তছনছ হতে পারে মোদীর ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের সামগ্রিক পরিকল্পনাও।
এসবের পাশাপাশি রয়েছে বিদেশনীতিতে বড় ধাক্কা খাওয়ার আশঙ্কা, আর এখানেই মোদী সরকারের ভয়টা আরও বেশি। কারণ, যে সামান্য সাফল্য মোদী বিদেশনীতি বা বিশেষ করে পাকিস্তান নীতিতে পেয়েছেন, তা এই ইরান-আফগানিস্তানকে কেন্দ্র করেই। ইরান এবং আফগানিস্তানের সঙ্গে বন্ধুত্বটিকে গাঢ় করে পাকিস্তানকে রীতিমতো একঘরে করে ফেলার এই নীতি ইসলামাবাদের ঘরোয়া রাজনীতিতেও যথেষ্ঠ চিন্তার কারণ হয়ে উঠছিল। ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত সেই চিন্তাকে নিঃসন্দেহে কমাবে আর বাড়াবে ভারতের উদ্বেগকে।
নিরপেক্ষতা বজায় রাখাও হতে পারে কঠিন
এই উদ্বেগ নিরপেক্ষতা বজায় রাখারও। মোদীর শাসনকালে ভারত ইরানের পাশাপাশি তার বৈরী দেশ যেমন ইসরায়েল এবং সৌদি আরবের সঙ্গেও সম্পর্কে জোর দিয়েছে। পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ পশ্চিমের অন্যান্য দেশগুলো তো রয়েছেই। কিন্তু ৮ মে-র পর পরিস্থিতি ভারতের পক্ষে খুব সহজ না-ও থাকতে পারে। ইরানের শত্রুদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখা নিয়ে তেহরানের নেতৃত্বের দৃষ্টিভঙ্গি কতটা ভারতের অনুকূলে থাকবে, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়। তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমের চক্ষুশূল হওয়ার পরে স্বাভাবিকভাবেই ইরান চীন এবং রাশিয়ার দিকে ঝুঁকতে পারে, যে শিবিরের অন্যতম আগ্রহী সদস্য এখন পাকিস্তানও।
গত মার্চে ইরানের বিদেশমন্ত্রী জাভেদ জরিফ তার পাকিস্তান সফরে ইসলামাবাদকে আমন্ত্রণ জানান চাবাহারের উন্নয়নের যজ্ঞে যোগ দিতে। তিনি চাবাহার এবং গবদর বন্দরের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনের ইচ্ছাও প্রকাশ করেন। বিশ্ব রাজনীতিতে কোণঠাসা হয়ে পড়া ইরানের পক্ষে এখন নতুন বন্ধু খোঁজা খুব একটা অপ্রত্যাশিত কিছু নয়। কিন্তু সেই নতুন মিত্রদের মধ্যে যদি থাকে পাকিস্তান এবং চীন, তবে ভারতের পক্ষে যে তা আশাব্যঞ্জক খবর নয়, সেটাও বলা বাহুল্য।
সমস্যা অন্যদিকেও। গত বছরই ইউরেশিয়া-কেন্দ্রিক সুরক্ষা সংগঠন সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশন বা এসসিও-তে ভারত এবং পাকিস্তানের আনুষ্ঠানিক অন্তর্ভুক্তি হয়েছে; আবার সংগঠনের অন্যতম প্রধান শক্তি চীন ইরানের অন্তর্ভুক্তি নিয়েও আগ্রহী। যদি চীন-রাশিয়া এবং মধ্য এশিয়ার প্রজাতন্ত্রগুলোর এই সংগঠনে পাকিস্তান এবং ইরানের সঙ্গে ভারতও থাকে, তবে তা আমেরিকা, ইসরায়েল এবং সৌদি আরবের পছন্দসই না-ও হতে পারে। ঐতিহাসিকভাবে নির্জোট নীতি নিয়ে চলা ভারতের বিদেশনীতির পক্ষে তা এক বড় চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসবে, একথা বলা যায় নির্দ্বিধায়। অন্যদিকে, চীনকে কোণঠাসা করতে যে চার-দেশীয় জোট রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ভারত এবং অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে, তাতেও নয়াদিল্লির ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে।
ট্রাম্পের ‘মার্কিন স্বার্থ প্রথমে’ নীতির ফলে অন্যান্য অনেক দেশের মতোই ভারতের স্বার্থও বেশ কিছু ক্ষেত্রে ক্ষুণ্ণ হচ্ছে, যার ফলে তাকে নতুন করে চিন্তাভাবনা করতে হচ্ছে নিজের বিদেশনীতি নিয়ে। ইরানের সঙ্গে তার নিবিড় সম্পর্কও এখন কঠিন পরীক্ষার সামনে পড়তে চলেছে, আর তাকে সামলাতে হবে ভারতকেই।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে বা এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে ভারতের বৃহত্তর ভূমিকা আশা করলেও, মোদী সরকারকে একথা ভুলে চলবে না যে, ওয়াশিংটনের সে আশা আসলে ভারতকে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধিতে কাজে লাগানো। কিন্তু ভারতের প্রকৃত প্রয়োজনে ট্রাম্পের কোনো ইতিবাচক এবং কার্যকরী ভূমিকা এখনও পর্যন্ত দেখা যায়নি। ইরান চুক্তিভঙ্গের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি কী নীতি নিয়ে চলতে হবে, তা ভারতকে শীঘ্রই ভেবে বের করতে হবে।
Featured Image Source: Observer Research Foundation