ইরান নিউক্লিয়ার ডিল বা ইরান পারমাণবিক চুক্তি আবার নতুন করে আলোচনায় উঠে এসেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চুক্তিটিকে সর্বকালের সবচেয়ে বাজে চুক্তি হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি হুমকি দিয়েছেন, আগামী মে মাসের ১২ তারিখের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র আর এই চুক্তি মেনে চলবে না। তাহলে বিশ্ব কি আবারও উপস্থিত হতে যাচ্ছে নতুন এক পারমাণবিক সংকটের দ্বারপ্রান্তে? কী এই ইরান পারমাণবিক চুক্তি? কেনই বা এটি এত গুরুত্বপূর্ণ? চলুন জেনে নিই।
কী এই ইরান নিউক্লিয়ার ডিল?
ইরান পারমাণবিক চুক্তি, যার প্রকৃত নাম Joint Comprehensive Plan of Action (JCPOA) তথা সম্মিলিত সর্বাঙ্গীন কর্ম পরিকল্পনা, স্বাক্ষরিত হয় ২০১৫ সালের ১৪ই জুলাই। যদিও চুক্তিটির প্রধান দু্ইটি পক্ষ হিসেবে ইরান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন ওবামা প্রশাসনকে দেখা হয়, কিন্তু বাস্তবে এটি দ্বিপাক্ষিক কোনো চুক্তি না। ইরান ছাড়াও চুক্তিটিতে স্বাক্ষর করে নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী পাঁচ সদস্য যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স, রাশিয়া ও চীন এবং জার্মানি (পি৫+১)। চুক্তিটি সর্বসম্মতভাবে অনুমোদন করে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন।
ইরানের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রের অভিযোগ ছিল যে, ইরান গোপনে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির লক্ষ্যে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ করে আসছিল। তবে ইরান সব সময়ই দাবি করে এসেছে, তারা পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির জন্য না, বরং শান্তিপূর্ণভাবে বিদ্যুৎশক্তি ব্যবহারের লক্ষ্যেই পারমাণবিক কর্মসূচী পরিচালনা করে আসছিল। উল্লেখ্য, ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ একটি দ্বৈত উদ্দেশ্যে ব্যবহারযোগ্য প্রকল্প, যা শান্তিপূর্ণভাবে পারমাণবিক শক্তি উৎপাদনে অথবা সামরিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যেতে পারে।
আন্তর্জাতিক রীতি অনুযায়ী, শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের উদ্দেশ্যে পারমাণবিক কর্মসূচীর অনুমোদন থাকলেও অস্ত্র নির্মাণের উদ্দেশ্যে তার ব্যবহার নিষিদ্ধ। আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থা (IAEA) এর অনুসন্ধান অনুযায়ী, ইরান ২০০৩ সাল থেকে শুরু করে ২০০৯ সাল পর্যন্ত পারমাণিক অস্ত্র নির্মাণের চেষ্টা করেছিল। এ সময়ে তারা শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের জন্য যতটুকু প্রয়োজন, তার চেয়েও অনেক বেশি লক্ষ্যমাত্রায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করেছে এবং প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি পারমাণবিক কেন্দ্র স্থাপন ও ভারী পানি, ইউরেনিয়াম ও প্লুটোনিয়াম মজুত করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ অনুযায়ী, ইরান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ এমন পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল যে, তারা চাইলে মাত্র দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে পারমাণবিক বোমা তৈরির সক্ষমতা অর্জন করতে পারত। তবে আইএইএর মতে, ২০০৯ সালের পর থেকে ইরানের অস্ত্র তৈরির প্রচেষ্টার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
ইরানের পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী হয়ে ওঠার সম্ভাবনাকে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন, ইসরায়েলি এবং ইউরোপীয় স্বার্থের জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অন্যদিকে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির প্রচেষ্টার অভিযোগে ইরানের উপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের আরোপিত বিভিন্ন অবরোধের কারণে ইরানের অর্থনীতি দিনে দিনে দুর্বল হয়ে আসতে থাকে। ফলে একটি শান্তিপূর্ণ সমাধানের লক্ষ্যে উভয় পক্ষ ২০১৩ সাল থেকে আলোচনা শুরু করে, যার ধারাবাহিকতায় শেষপর্যন্ত ২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত হয় ইরান নিউক্লিয়ার ডিল।
কী আছে এই চুক্তিতে?
২০১৫ সাল পর্যন্ত ইরান ২০ শতাংশ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার সক্ষমতা অর্জন করেছিল, যা ছিল শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনের চেয়ে (৩-৪ শতাংশ) অনেক বেশি, কিন্তু পারমাণবিক বোমা নির্মাণের জন্য প্রয়োজনের (৯০ শতাংশ) চেয়ে অনেক কম। চুক্তি অনুযায়ী, ইরান পরবর্তী ১৫ বছর পর্যন্ত ৩.৬৭ শতাংশের বেশি ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করতে পারবে না। ইতোমধ্যেই সমৃদ্ধকৃত ১০,০০০ কেজি ইউরেনিয়ামের মজুতের মধ্যে মাত্র ৩০০ কেজি রেখে অবশিষ্ট ইউরেনিয়াম পারমাণবিক ক্ষমতাধর অন্য কোনো দেশের (রাশিয়া) কাছে হস্তান্তর করতে হবে। পরবর্তী ১৫ বছর পর্যন্ত ইরান এই ৩০০ কেজির চেয়ে বেশি আংশিক সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম মজুত রাখতে পারবে না।
এছাড়াও চুক্তি অনুযায়ী ইরানের ২০,০০০ পারমাণবিক কেন্দ্রের মধ্যে মাত্র ৫,০৬০টি কেন্দ্র পরবর্তী ১০ বছর পর্যন্ত সক্রিয় রাখা যাবে। সীমিত পারমাণবিক চুল্লীগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় ভারী পানি রেখে বাকি সব পানি আন্তর্জাতিক বাজারে ন্যায্যমূল্যে বিক্রি করে দিতে হবে এবং পরবর্তী ১৫ বছর পর্যন্ত নতুন কোনো ভারী পানি উৎপাদন করা যাবে না। অন্যদিকে এই চুক্তি অনুযায়ী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইরানের উপর থেকে বিভিন্ন ধরনের অবরোধ উঠিয়ে নিয়ে ইরানকে দেশগুলোর সাথে ব্যবসায়িক সম্পর্ক স্থাপন এবং দেশগুলোর অর্থনৈতিক ও ব্যাংকিং সুবিধা ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি করে দেবে। জ্বালানী তেলসহ ইরানের বিভিন্ন পণ্যও আন্তর্জাতিক বাজারে বিনা বাধায় বিক্রি করার সুযোগ দেওয়া হবে।
চুক্তির শর্ত কি মেনে চলা হচ্ছে?
চুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকে আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থা ইরানের উপর কঠোর নজরদারি করে আসছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত ইরান চু্ক্তির কোনো শর্ত ভঙ্গ করেছে বলে তারা কোনো প্রমাণ পায়নি। ২০১৬ সাল থেকে এখন পর্যন্ত তারা ১১ বার নিশ্চিত করেছে যে, ইরান চুক্তির কোনো শর্ত ভঙ্গ করেনি। কিন্তু বিপরীত দিকে ইরানের পক্ষ থেকে বারবার অভিযোগ করা হয়েছে যে, যুক্তরাষ্ট্র চুক্তির শর্ত যথাযথভাবে মেনে চলছে না, তারা ইরানের উপর বিভিন্ন ধরনের অবরোধ অব্যাহত রেখেছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অবশ্য চুক্তি অনুযায়ী ইরানের উপর থেকে অধিকাংশ অবরোধ উঠিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই বারবার দাবি করে আসছিলেন যে, ওবামা প্রশাসনের করা এই চুক্তিটি ছিল একটি ভুল চুক্তি। তিনি বিভিন্ন সময় চুক্তিটি বাতিলেরও হুঁশিয়ারি করেছিলেন। সরাসরি চুক্তি বাতিলের ব্যাপারে এখনও পরিস্কার কোনো সিদ্ধান্ত গৃহীত না হলেও, গত জানুয়ারি মাসে ট্রাম্প আবারও হুঁশিয়ার করেন যে, আগামী মে মাসে তিনি ইরানের উপর থেকে প্রত্যাহার করা অবরোধগুলো পুনর্বহাল করবেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আইন অনুযায়ী, অবরোধ প্রত্যাহারের নির্দেশ প্রেসিডেন্টকে প্রতি চার মাস পরপর নিশ্চিত করতে হয়। আগামী মে মাসের ১২ তারিখে প্রেসিডেন্টের সামনে এই নির্দেশ পুনরায় উপস্থাপন করার কথা। আশঙ্কা করা হচ্ছে, ইসরায়েলের মার্কিন দূতাবাস জেরুজালেমে স্থানান্তর করার মতোই এক্ষেত্রেও হয়তো ট্রাম্প অবরোধ প্রত্যাহারের বিষয়টি নবায়ন করবেন না। ফলে অস্থিতিশীল মধ্যপ্রাচ্যে সংকট আবারও নতুন করে ঘনীভূত হতে পারে। এমনিতেই সিরিয়াতে ইসরায়েলের সাথে ইরানের কয়েকবার ছোটখাট সংঘর্ষ হয়েছে। এই চুক্তি বাতিল হলে ইরান যদি আবারও পারমাণবিক কর্মসূচি চালু করে, তাহলে এই দুই দেশের সম্পর্কও আরো জটিল আকার ধারণ করতে পারে।
Featured Image Source: Reuters