এ বছর জুলাইয়ে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী পদে ৯২ বছর বয়সী মাহাথির মোহাম্মদকে মনোনীত করেছে মালয়েশিয়ার বিরোধীদলীয় জোট ‘পাকতান হারাপান’। ধারণা করা হচ্ছে, এর মাধ্যমে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাককে (৬৪) হটিয়ে পুনরায় ক্ষমতায় আসতে চলেছেন ১৯৮১ থেকে ২০০৩ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকা ‘আধুনিক মালয়েশিয়ার রূপকার’ মাহাথির।
উল্লেখ্য, বাম ও মধ্যমপন্থীদের ‘পাকতান হারাপান’ জোটের প্রধান ছিলেন আনোয়ার ইব্রাহিমের (৭০) স্ত্রী ওয়ান আজিজাহ। সেই আনোয়ার, যাকে ১৯৯৮ সালে স্বয়ং মাহাথির নিজ হাতে সহকারী প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে বরখাস্ত করেছিলেন। তখন থেকেই দা-কুমড়ো সম্পর্ক ছিলো তাদের। মাহাথিরের স্বপ্রণোদিত চেষ্টায় সেই সম্পর্কের বরফ বছর দেড়েক আগে গলতে শুরু করে। নাজিবকে হটাতে সেই মাহাথির আর আনোয়ারই বিস্ময়করভাবে বাঁধলেন জোট। কিন্তু সমকামিতার দায়ে কারারুদ্ধ আনোয়ারের পক্ষে নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া সম্ভব ছিলো না বিধায় তার সম্মতিতেই ৭ জানুয়ারি বিরোধী জোট নির্বাচনী লড়াইয়ে মাহাথির মোহাম্মদকে মনোনয়ন দেয়। যতটা তিক্ততার মাধ্যমে মাহাথির-আনোয়ার যৌথ অধ্যায় শেষ হয়েছিলো, ঠিক ততটাই নাটকীয়ভাবে নাজিবকে হটানোর অভিন্ন লক্ষ্যে গলা মেলালেন দুজন। সেই তিক্ত ইতিহাস ও নাটকীয় সদ্য-অতীতের ঘটনাবলিই থাকছে এই লেখায়।
মাহাথির-আনোয়ার তিক্ততার নেপথ্যে
১৯৯৮ সালে মাহাথির ও আনোয়ারের ক্ষমতাসীন দল ইউনাইটেড মালয়েস ন্যাশনাল অর্গানাইজেশনের নিজস্ব অধিবেশনে একটি পুস্তিকা প্রকাশিত হয়। ‘আনোয়ার কেন প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না তার ৫০ কারণ’ শিরোনামে খালিদ জাফরির ঐ পুস্তিকাটিতে আনোয়ারের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও সমকামিতাসহ গুরুতর সব অভিযোগ আনা হয়। সেই বইটির তথ্যকে ধরেই তদন্ত শুরু করে মালয়েশিয়ান পুলিশ। ইমেজ ক্ষুণ্ণ ও ‘পুলিশের তদন্তাধীন’ থাকাকে কারণ দেখিয়ে আনোয়ারকে ১৯৯৮ সালের ২ সেপ্টেম্বর দল ও সহকারী প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে বহিষ্কার করেন মাহাথির মোহাম্মদ, যেখান থেকেই মূলত দুজনের মধ্যকার তিক্ততার সূচনা।
বহিষ্কৃত হবার ১৮ দিন পর গ্রেফতার হন আনোয়ার। সিডনি হেরাল্ড ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রসূত’ বলে মন্তব্য করেছিলো এ ঘটনাকে। সে বছরই সমকামিতার দায়ে আদালত আনোয়ারকে ৯ বছরের কারাদণ্ড প্রদান করেন। মানবাধিকার কর্মীদের ঐকান্তিক চেষ্টায় ২০০৪ সালে আদালত আরোপিত অভিযোগ তুলে নিলে মুক্তি পান আনোয়ার। সেই সাথে ‘৫০ কারণ’ বইটির লেখক ‘সরকারের মুখপাত্র’ খ্যাত সাংবাদিক খালিদ জাফরির বিরুদ্ধে দায়ের করা সাড়ে চার মিলিয়ন রিঙ্গিতের মানহানির মামলাও জিতে নেন আনোয়ার।
আনোয়ারকে বরখাস্ত প্রসঙ্গে পরবর্তীতে মাহাথিরের ভাষ্য
মাহাথির অবশ্য পরবর্তীতে আনোয়ারের বিরুদ্ধে তার সকল কৃতকর্মকে ‘দলীয় সিদ্ধান্ত’ এবং আনোয়ারের সাথে যা হয়েছে, তাকে ‘পুলিশী অ্যাকশন’ বলে নিজের প্রত্যক্ষ দায় এড়াতে চেয়েছেন। তাঁর ভাষ্যানুযায়ী, আনোয়ারের বিরুদ্ধে দলীয় সিদ্ধান্ত নেবার বছর তিনেক আগে থেকেই পুলিশের কাছ থেকে অজস্র নেতিবাচক তথ্য তিনি পাচ্ছিলেন। শুরুতে একে পুলিশী ষড়যন্ত্র ভেবে বিশ্বাস করতে না চাইলেও পরবর্তীতে ‘ভুক্তভোগী’দের জবানিতে তিনি বিশ্বাস করতে বাধ্য হন। এরপর থেকে পার্টির ভেতরেই নাকি শোর ওঠে আনোয়ারকে হটানোর! সব মিলিয়ে আনোয়ারকে বরখাস্ত করবার ক্ষেত্রে মাহাথিরের ভাষ্যে তিনি ছিলেন ‘নিরুপায়। তবে গুঞ্জন আছে, আনোয়ারের ক্যারিশমাটিক জনপ্রিয়তায় ঈর্ষাণ্বিত মাহাথির ইচ্ছা করেই আনোয়ারকে ফাঁসিয়েছিলেন, যাতে করে পরবর্তীতে আনোয়ার প্রধানমন্ত্রী হতে না পারেন।
সমকামিতার অভিযোগে আবার জেলে আনোয়ার
২০০৮ সালে নির্বাচনের আগে তিনি যখন নিজের নতুন দল জাস্টিস পার্টির নেতৃত্বে শক্তিশালী বিরোধী জোট ‘পাকতান রাকইয়াত’ গড়ে তোলেন, ঠিক তখনই আবারও মামলা। এক পুরুষ সহযোগীকে বলাৎকারের অভিযোগে আবারও বিচারের কাঠগড়ায় আনোয়ার। ২০১২ সালে আদালত তাকে ৫ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেন। ২০১৩ সালে উচ্চ আদালতে আপিল-অধীন মামলায় জামিনে বেরিয়ে নাজিব রাজাকের বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির অভিযোগ এনে আনোয়ার গড়ে তোলেন এক বিরাট জনজোয়ার। সে বছরের নির্বাচনে আনোয়ারের জোট হেরে গেলেও নাজিবের দল করে তাদের ৬ দশকের ইতিহাসের সবচেয়ে বাজে ফলাফল। ২০১৪ সালে আপিল বিভাগও উচ্চ আদালতের রায় অপরিবর্তিত রাখলে জেলে যেতেই হয় আনোয়ারকে। জেলে যাবার আগে আনোয়ার বলেছিলেন, “আমি নিরপরাধ, আল্লাহ স্বয়ং সাক্ষী। এ দিনই শেষ দিন নয়।” বর্তমানে তিনি সুঙ্গাই বুলোহ কারাগারে বন্দি রয়েছেন।
অহম ভুলে এগিয়ে এলেন মাহাথির, বরফ গললো দু’পক্ষের: কীভাবে, কেন
২০১৬ এর ৯ সেপ্টেম্বরে হুট করেই আনোয়ার ইব্রাহিমের বিচারকার্য চলাকালে আদালতে উপস্থিত হন মাহাথির। তৎক্ষণাৎ হজম করবার পক্ষে তা একটি বড় চমকই ছিলো বটে। বরখাস্ত করবার ১৮ বছর পর প্রথমবারের মতো আনোয়ারের মুখোমুখি হন মাহাথির। হাসিমুখে করমর্দনের পর আদালত কক্ষেই একান্তে আলাপ করেন দুজন। বাবার সাথে পুরনো ‘শত্রু’র ঐতিহাসিক এ মোলাকাতকে মালয়েশিয়ার রাজনৈতিক অগ্রযাত্রায় তাৎপর্যপূর্ণ বলেও বিবৃতি দেন আনোয়ারের মেয়ে নুরুল ইজ্জাহ। তখন থেকেই কানাঘুষা চলছিলো যে মাহাথির হয়তো তার পূর্বের ভুলের মাশুল দিতে চাইছেন। ওদিকে মাহাথিরও চুপ ছিলেন, খোলাসা করে কিছুই বলছিলেন না। প্রায় ১০ মাস পর ২০১৭ এর জুলাইয়ে গার্ডিয়ান পত্রিকার কাছে মুখ খুললেন তিনি।
২০০২ সালে ক্ষমতা ছেড়েছিলেন মাহাথির। এরপরে মালয়েশিয়ায় এসেছেন আরো দুজন প্রধানমন্ত্রী। মাহাথিরের মতে এ দুজনের শাসনামলে দেশ আগের থেকে বরং পিছিয়েছে। ৫ম প্রধানমন্ত্রী আব্দুল্লাহ বাদাউইর বেশ বদনাম প্রচলিত রয়েছে জরুরী সকল বৈঠকে ঘন্টা ধরে ঝিমুনোর। ওদিকে ৬ষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক ওয়ানমালয়েশিয়া ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্ক কেলেঙ্কারী নিয়ে ২০০৯ সাল থেকে ভুগছেন, আন্দোলনকারীদের অবিরত সমালোচনায় জেরবার নাগিব রাজাক তাই বিদ্রোহী-দমনেই বেশি ব্যস্ত। এ দুইয়ের অযোগ্যতার কথা তুলে ধরে মাহাথিরের বিস্ফোরক,
“পঞ্চম প্রধানমন্ত্রী আসলে হওয়া উচিত ছিলো আনোয়ারেরই।”
সেই আনোয়ার এখন জেলে। ভোগ করছেন ৫ বছরের সাজা। মাহাথির এটাও সাফ জানিয়ে দিলেন যে, মালয়েশিয়ার মহামান্য রাজা যদি আনোয়ারকে ক্ষমা করেন, তবে তিনি তাকেই পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সমর্থন দেবেন।
আনোয়ারের অবর্তমানে বিরোধী দল তথা নাজিব বিরোধী ঐক্যজোটের দায়িত্ব পালন করছেন আনোয়ারের স্ত্রী ওয়ান আজিজাহ ও কন্যা নুরুল ইজ্জাহ। অতীতের ভুলের আক্ষেপে কতটা পোড়েন কিংবা ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে চাইছেন কিনা, এ প্রশ্নের জবাবেও মাহাথিরের অসহায় আত্মসমর্পণ, “পাস্ট ইজ পাস্ট”। ওদিকে টুইটার ও ফেসবুক পেজের মাধ্যমে আনোয়ারও সমর্থক প্রতি ব্যক্তিগত দ্বৈরথ-ইতিহাস ভুলে দেশের জন্য এক হবার আহবান জানিয়েছেন।
অতীত ভুলে আনোয়ারকে সঙ্গে কেন চাইলেন মাহাথির
১৯৮৪ সালে হৃদযন্ত্রে বাইপাস অস্ত্রোপচারের পর বয়সের ভারে ন্যুব্জ মাহাথির শারীরিকভাবে আগের মতো সবল নেই। শারীরিক মন্দার প্রতিফলন পড়েছে রাজনৈতিক জীবনেও। তার নয়া রাজনৈতিক দল ‘বুরসাতু’ এককভাবে মালয়েশিয়ার পার্লামেন্টে যাবার যোগ্যতা রাখে না, কেননা তৃণমূলে নেই পর্যাপ্ত জনবল- এ সৎ উপলব্ধিও খুব ভালোভাবেই আছে দূরদর্শী রাজনীতিক মাহাথিরের। ওদিকে ‘দুর্নীতিবাজ’ নাজিবও যেভাবে ক্ষমতার গদি জাঁকিয়ে বসেছেন, তাতে তাকে হঠানোটাও হয়ে পড়েছে দুরূহ। ঠিক এ কারণেই মাহাথির চাইছেন পূর্বতন শত্রুদের সাথে সকল ঝামেলা মিটিয়ে নতুন রাজনৈতিক ঐক্যের ডাক দিতে। তাই আনোয়ারের পিপলস জাস্টিস পার্টি, ডেমোক্র্যাটিক অ্যাকশন পার্টি, ন্যাশনাল ট্রাস্ট পার্টি, এমনকি রক্ষণশীল ডানপন্থী আমানাহ পার্টিকে সাথে নিয়ে নাজিবের বিরুদ্ধে গড়তে চান প্রবল নির্বাচনী প্রতিরোধ। গত শতাব্দীর শেষ দশকে সহকারী আনোয়ারকে নিয়ে মালয়েশিয়ার গ্রামীণ অর্থনীতি ও পণ্য উৎপাদনে যদি বিপ্লব আনা যায়, তবে এবারও আনোয়ারকে সাথে নিয়েই ‘জগদ্দল পাথর’ নাজিবকে হঠানো যাবে বলে বিশ্বাস মাহাথিরের।
‘সাপে নেউলে’ জোটের উপলক্ষ কেন নাজিব-ই
যদিও নাজিব রাজাকের ক্ষমতাধীনে মালয়েশিয়ার প্রবৃদ্ধি খুব একটা খারাপ নয়, ৫.১, কিন্তু রিঙ্গিতের যা পড়তি দাম, তাতে প্রবৃদ্ধির কার্যকরী অঙ্কটা ম্লান হয়ে যায়। ওদিকে মার্কিন বিচার বিভাগ কর্তৃক বিচারিক নথিপত্র ফাঁসের মাধ্যমে ওয়ানমালয়েশিয়া ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্কের বিশাল অর্থ জালিয়াতের অভিযোগ রয়েছে নাজিব ও তার ঘনিষ্ঠ বলয়ের বিরুদ্ধে। দেশটির নিজস্ব বিচারিক আদালতেও বিলিয়ন ডলার অর্থ পাচারের প্রমাণাদি উপস্থাপিত হয়েছে। পাচারকৃত অর্থ থেকে ১০ মিলিয়ন ডলার আবার খরচ হয়েছে নাজিবের স্ত্রী রোসমাহ মানসরের হীরা-জহরত কেনায়! ওদিকে স্বজনপ্রীতির অভিযোগে ২০১৩ সালের নির্বাচনেই প্রায় হারতে বসেছিলেন নাজিব। তাই তার বিরুদ্ধে জনমতও তুঙ্গে।
যা-ই হোক, পুনরায় মাহাথির মোহাম্মদের প্রধানমন্ত্রী হবার সম্ভাবনায় আলোড়ন উঠেছে গোটা বিশ্বে। তারপরও মূল আলোচনায় ঘুরে ফিরে আসছে কেবল নাজিবকে হটাতেই কতটা নাটকীয় ঘটনাক্রমে অতীত ভুলে গেলেন মাহাথির, ‘ইগো’ ভুলে কীভাবে মাথা নোয়ালেন আনোয়ারের দুয়ারে। এসবের বিপরীতে মাহাথিরের সাফ জবাব,
“আনোয়ার যেখানে কিছু মনে করছে না, সেখানে অন্যদের অতীত নিয়ে পড়ে থাকার কোনো মানে নেই।”
ফিচার ইমেজ: todayonline.com