আফগানিস্তানে সম্প্রতি দুটি ভয়াবহ সন্ত্রাসবাদী হামলায় সাধারণ মানুষের পাশাপাশি প্রাণ হারিয়েছেন নয়জন সাংবাদিক। খবরটি শুধুমাত্র বেদনাদায়ক নয়, ভয়ঙ্করও। দক্ষিণ এশিয়ার এই যুদ্ধবিধস্ত দেশটিতে রক্তপাতের ঘটনা দিনদিন বেড়েই চলেছে। ষোল বছরের বেশি সময় ধরে সেখানে মার্কিন সৈন্যবাহিনী উপস্থিত রয়েছে; বেশ কয়েকটি নির্বাচিত সরকারও সেখানে ইতিমধ্যে প্রশাসনিক গুরুদায়িত্ব পালন করেছে- কিন্তু আফগানিস্তান যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই রয়ে গিয়েছে। আর সংবাদমাধ্যমের উপরে সন্ত্রাসবাদীদের এই আক্রমণ আফগানিস্তানের সমস্যাকে আরও জটিল করে তুলেছে। রিপোর্টার্স উইদআউট বর্ডারস-এর খবর অনুযায়ী, গত দুই বছরে আফগানিস্তানে প্রাণহানি ঘটেছে ৩৪ জন সাংবাদিকের, যা এককথায় চরম ভয়ঙ্কর ব্যাপার।
একে তো তালেবান সমস্যারই সমাধান করে উঠতে পারেনি পশ্চিমা শক্তিগুলো, তার উপরে এখন আফগানিস্তানের মাটিতে প্রভাব বেড়েছে ইরাক-সিরিয়াতে তাড়া খেয়ে পিছু হঠা ইসলামিক স্টেটেরও। এই দুইয়ের দাপটে এখন দেশটির সুরক্ষা রীতিমতো শিকেয় উঠেছে। প্রবল পরাক্রমশালী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও বুঝতে পারছে না যে কীভাবে এই সমস্যার সমাধান পাওয়া যেতে পারে।
আফগানিস্তানে সাংবাদিকদের উপরে অবিরাম আক্রমণের অর্থ অদূর ভবিষ্যতে সেদেশের ভেতরের খবর আর হয়তো আমাদের কাছে পৌঁছাবে না সেভাবে। অতীতে স্বনামধন্য পাকিস্তানী সাংবাদিক আহমেদ রশিদ যেমন অত্যন্ত ঝুঁকি নিয়েও আফগানিস্তানের হাঁড়ির খবর বিশ্বের সামনে তুলে ধরেছেন খবর বা বইয়ের মাধ্যমে, সেরকম সাংবাদিকতা আমরা আর হয়তো দেখতে পাব না সন্ত্রাসবাদীদের উপদ্রবে।
উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সংবাদমাধ্যমের উপরে আক্রমণ চলছে
সন্ত্রাসবাদীরা ইচ্ছে করেই সংবাদমাধ্যমের উপরে এই আক্রমণ চালাচ্ছে, সেখানকার নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে ভেস্তে দেওয়ার পরিকল্পনা করছে। কারণ, তাদের লক্ষ্যই হচ্ছে আফগানিস্তানের দুর্বল গণতন্ত্রকে সম্পূর্ণভাবে ধসিয়ে দেওয়া, যাতে সে আর ভবিষ্যতে মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে। আর সাংবাদিক হননের এই অভিযানের শিকার হচ্ছেন স্থানীয় রিপোর্টাররা, যারা দেশটিকে ভালোভাবে জানেন আর বহির্বিশ্বের সামনে সেখানকার আসল চিত্রটি সঠিকভাবে তুলে ধরতে পারেন। অনেক ক্ষেত্রে বিদেশী সাংবাদিকরা ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে পারেন না সরকারি নিয়ম-নিষেধাজ্ঞার কারণে। আর তখন সংবাদমাধ্যমগুলোর সমস্ত আশা-ভরসা হয় এই স্থানীয় সাংবাদিকরাই। তাই তাদের উপর আক্রমণের অর্থ আফগানিস্তানের ভেতরের খবর বাইরে আসার যোগসূত্রটিকে ধ্বংস করা। যারা আফগানিস্তানের পুনর্নির্মাণের জন্যে সন্ত্রাসবাদীদের সঙ্গে আমরণ লড়াই করছে, তাদের এখনই এই ভয়ঙ্কর প্রবণতাকে ব্যাহত করার জন্যে সর্বপ্রকার উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।
২০০১ সালে ৯/১১ হানার পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান আক্রমণ করলেও এই যুদ্ধ ক্ষণস্থায়ী না হওয়ার পিছনে বেশ কিছু কারণ ছিল। কৌশলগত ত্রুটির পাশাপাশি যুদ্ধের লক্ষ্য নিয়ে বিভ্রান্তি এবং আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নানা বিক্ষুব্ধ শক্তির উত্থান এবং তাদের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই, দুর্নীতি এবং আফগানিস্তানের প্রতিবেশী দেশগুলির সে দেশে নিজেদের কার্যসিদ্ধির স্বার্থপর প্রয়াস- সব মিলিয়ে আফগানিস্তানের সমস্যার নিরসন এবং শান্তিলাভের সম্ভাবনা রয়ে গিয়েছে বিশ বাওঁ জলেই।
ট্রাম্প আসার পরেও সমস্যা কমেনি
সমস্যা কমেনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের আগমনের পরেও। ট্রাম্পের মতে, আফগানিস্তানে শান্তি ফিরিয়ে নিয়ে আসার জন্যে দরকার পাকিস্তানে অবস্থিত তালেবানি শিবির এবং পাশাপাশি সেখানকার অন্যতম বড় সমস্যা হাক্কানি নেটওয়ার্ককে নির্মূল করা।
আর তার জন্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চায় আরও বেশি করে পাকিস্তানের সহযোগিতা আর যদি ইসলামাবাদ যদি তা না করে, তবে তাকেই বিদেশী অনুদান ইত্যাদি দেওয়া বন্ধ করে শাস্তির দিকে ঠেলে দেওয়া। ট্রাম্প গত বছর আফগানিস্তানে আরও বেশি মার্কিন সেনা পাঠানোর কথা ঘোষণা করেন এবং ভারতকে সেদেশে আরও বড় ভূমিকা পালন করতে আহ্বান জানান।
স্বাভাবিকভাবেই, পাকিস্তান এতে চটে যায় আর মার্কিন প্রশাসনের এই প্রবল চাপে তারা বাধ্য হয় চীন এবং রাশিয়ার মতো বিকল্প শক্তিগুলোর দিকে ঝুঁকতে। চীন এবং রাশিয়া আফগানিস্তানে তালিবানের সমর্থনে আগ্রহী যাতে ইসলামিক স্টেট বা অন্যান্য সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলো তাদের জাতীয় নিরাপত্তাকে বিঘ্নিত না করে। আর এই কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার নীতির জন্য আখেরে নিষ্পত্তি হচ্ছে না আফগান সমস্যার; যে যার নিজের স্বার্থ দেখার ফলে তৈরি হচ্ছে না সন্ত্রাসের মোকাবেলায় কোনো ঐক্যবদ্ধ শক্তি।
আর এই ঘটনা নতুন কিছু নয়। আফগানিস্তানের নিজস্ব রাজনৈতিক পরিকাঠামো ভেঙে পড়ার পর সেখানে স্নায়ু যুদ্ধ এবং পরে গৃহযুদ্ধের প্রভাবে যে জিহাদি সংস্কৃতি গড়ে ওঠে, তাতে আফগানিস্তান তো বটেই, পাশাপাশি পাকিস্তানে লাগোয়া অঞ্চলের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেও বড় বদল আসে। আর তারপর ৯/১১ ঘটার পরে এই সমস্ত সমীকরণই তোলপাড় হয়ে যায়। যে জিহাদিরা স্নায়ু যুদ্ধের সময়ে আমেরিকা, পাকিস্তান এবং চীনের পাশাপাশি পূর্বতন সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে লড়াইতে ব্যস্ত ছিল, ৯/১১-র পরে তারাই হয়ে ওঠে মার্কিন শক্তির এক নম্বর শত্রু। ওসামা বিন লাদেনের আল কায়েদাকে হারাতে ওয়াশিংটন যুদ্ধ শুরু করে তালেবানের সঙ্গে আর এই ডামাডোলের মধ্যে পুরোনো মিত্র পাকিস্তানের অবস্থানও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নজরে বদলে যায়।
মার্কিন প্রশাসন পাকিস্তানকে চাপ দিতে থাকে তালেবানের বিরুদ্ধে কড়া অবস্থান নেওয়ার, কিন্তু রাজনৈতিক-ভৌগোলিক এবং কৌশলগত কারণে ইসলামাবাদের পক্ষে রাতারাতি তালেবানের বিরোধিতা করা সম্ভব ছিল না। পাকিস্তানের আফগান-লাগোয়া অঞ্চলে তালেবানের প্রভাব তো ছিলই, পাশাপাশি ভারতকে আফগানিস্তান থেকে দূরে রাখতেও পাকিস্তানের তালেবানকে প্রয়োজন ছিল। সবচেয়ে বড় কথা হলো, কাবুলের সঙ্গে নয়াদিল্লির বন্ধুত্ব নিবিড় হওয়া মানে পাকিস্তানের পূর্ব এবং পশ্চিম দুই প্রান্তেই জাতীয় নিরাপত্তা ব্যাহত হয়ে পড়া।
ইসলামাবাদের পক্ষে তা মেনে নেওয়া কখনোই সম্ভব নয়। আর তাই আফগানিস্তান নিয়ে তার নীতিতে রদবদল ঘটার আশাও প্রায় শূন্য, তা সে আমেরিকা যত চোখই রাঙাক না কেন। আর বিশেষ করে সামনে যেখানে পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচন, সেখানে তো ভারতের সুবিধা করে দেয় এমন নীতি পাকিস্তানী শাসকশ্রেণী কখনোই নেবে না।
ত্রুটি ছিল আমেরিকার কৌশলেই
অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, প্রাক্তন মার্কিন রাষ্ট্রপতি জর্জ ডাব্লিউ বুশ ৯/১১-র হানার বদলা নিতে আফগানিস্তানের উপরে বদলা নেওয়ার আক্রমণ চালিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু সমস্যাটিকে ঠিক অনুধাবন করতে পারেননি।
আল কায়েদাকে হারানোর জন্যে তার প্রশাসন টার্গেট করে তালেবানকে, যারা বিপদ বুঝে আশ্রয় নেয় পাকিস্তানের অন্দরে আর তাতে ওয়াশিংটন-ইসলামাবাদ সম্পর্কে আরও চিড় ধরে। আঞ্চলিক বিশেষজ্ঞদের মতে, আফগানিস্তানে শুধুমাত্র মারদাঙ্গার নীতি নিয়ে না চলে মার্কিন নেতৃত্বের প্রয়োজন ছিল সেদেশে গঠনমূলক, বহুত্ববাদের মধ্যে মিলনমূলক রাজনৈতিক নীতির প্রয়োগ করার।
মার্কিন নেতৃত্ব তার বদলে ঝুঁকে রইল সামরিক সমাধানের উপরেই; স্থানীয় যুদ্ধবাজ জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগিয়ে একধরনের গণতন্ত্র ‘রফতানি’র কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কিন্তু গণতন্ত্রকে উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা আদতে গুঁড়িয়ে দেয় সেই গণতান্ত্রিক প্রয়াসকেই- আফগানিস্তানেও তার অন্যথা হয়নি, যেমন হয়নি ইরাকে। আর এর ফলে যে ডামাডোলের সৃষ্টি হয়, তাতে সুবিধা হয় সন্ত্রাসবাদের মতো অশুভ শক্তির, যা গণতন্ত্রকে নিজের জাত শত্রু হিসেবেই দেখে। আফগানিস্তানে সন্ত্রাসবাদী শক্তিগুলোর প্রভাব বাড়তে বাড়তে এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে, তারা যখন তখন যেখানে ইচ্ছে আক্রমণ চালিয়ে মানুষ মারছে; সংবাদমাধ্যমকেও নিশানা করছে।
সাংবাদিক রশিদ তার একটি লেখায় জানিয়েছেন, আফগানিস্তান প্রসঙ্গে ট্রাম্পের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি কোনো অর্থপূর্ণ নীতিগত বদল করতে চায়, তাহলে তা করতে হবে স্পেশাল ইন্সপেক্টর জেনারেল ফর আফগানিস্তান রিকন্সট্রাকশন জন সপকোর পরামর্শ মেনে। মার্কিন কংগ্রেস এই এজেন্সিটিকে তৈরি করে ২০০১ সাল থেকে আফগানিস্তানের ব্যাপারে ওয়াশিংটন কী কী ভুল করেছে তার একটি খতিয়ান তৈরি করতে।
সেই মতো, সপকো গত বছর সেপ্টেম্বরে আফগানিস্তানের পরিস্থিতির উন্নয়নার্থে বেশ কিছু পরামর্শও দেন। তিনি বলেন, আফগানিস্তানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম বড় ব্যর্থতা হচ্ছে সামরিক। বছরের পর জলের মতো অর্থ খরচ করেও মার্কিন সেনারা আফগানিস্তানের সামরিক শক্তিকে এখনও নিজেদের প্রতিরক্ষা সামলানোর মতো অবস্থায় দাঁড় করতে পারেনি। আর এই ব্যর্থতা প্রত্যক্ষ করা গিয়েছে আফগানিস্তান ছাড়া ইরাকেও। রশিদ বলেন, সপকোর বক্তব্যকে অনেকেই গুরুত্ব দিলেও খোদ ট্রাম্প প্রশাসন তা নিয়ে কতটা কী ভাবছে তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়।
প্রত্যেকটি শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে
আফগানিস্তানে সংবাদমাধ্যম এবং সাংবাদিকদের রক্ষা করতে হলে প্রথমেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ অন্যান্য বড় শক্তিগুলোকে নিজেদের স্বার্থপর নীতিকে ত্যাগ করে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। সন্ত্রাসবাদ নির্মূলের লড়াইয়ে পাকিস্তানের ভূমিকা যতই নেতিবাচক হোক না কেন, ট্রাম্পের পক্ষে তাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা অসম্ভব। কারণ, আফগানিস্তানের প্রতিবেশী তো বটেই, তালেবানকে বাগে আনতে গেলে পাকিস্তানের সহযোগিতা পেতেই হবে আর সেই সহযোগিতা চোখ পাকিয়ে হবে না।
পাকিস্তানের উপরে ট্রাম্পের তর্জন-গর্জন শুনে ভারতের নীতিপ্রণয়নকারীরা পুলকিত হচ্ছেন ঠিকই, কিন্তু তাদের একথা মেনে নিতেই হবে যে কৌশলগত এবং ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকে আফগানিস্তান সমস্যার সমাধানে ভারতের চেয়ে পাকিস্তানের গুরুত্ব অনেক বেশি। স্নায়ু যুদ্ধের সময়ে আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়নকে চাপে রাখতে পাকিস্তানের উপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্ভরতার কথা আমরা সবাই জানি। আজকেও তার বিশেষ তারতম্য নেই।
নানা শক্তির (যার মধ্যে রয়েছে ইরান এমনকি মধ্য এশিয়ার প্রজাতন্ত্রগুলোও) সংঘাতে আজ আফগানিস্তানের সমস্যার প্রকৃত সমাধান নাগালের বাইরে চলে গিয়েছে প্রায়। রাজনৈতিক সমাধানের পথ নিয়ে ভাবছে না কেউই। আর এই পরিস্থিতিতে যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রতিনিয়ত আফগানিস্তান থেকে খবর নিয়ে আসছেন, তাদের রক্ষার কথা নিয়ে কতটুকু ভাবছে আন্তর্জাতিক মহল?
উত্তরটা অজানা নয়। কিন্তু পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে, প্রশ্নটা বারেবারেই উঠবে হয়তো।
Featured Image Source: Jawad Jalali/EPA (এএফপির সাংবাদিক শাহ মারাইয়ের কফিন নিয়ে স্বজনরা)