অধিকৃত ফিলিস্তিনের জেরুজালেম তথা আল-কুদসকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। বুধবার আন্তর্জাতিক সময় রাত ১০টার সময় এ ঘোষণা দেন তিনি। গত ক’দিন ধরেই এরকম স্বীকৃতি আসবে বলে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল। ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস সহ বিশ্বনেতাদের সাথে টেলিফোনে এরকম সম্ভাবনার কথা জানিয়েছিলেন ট্রাম্প। তারই ধারাবাহিকতায়, বিশ্বনেতাদের প্রচণ্ড নিন্দা এবং প্রতিবাদ সত্ত্বেও এই ঘোষণা দিলেন তিনি। একইসাথে তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে মার্কিন দূতাবাস তেল আবিব থেকে জেরুজালেমে সরিয়ে নেওয়ার প্রস্তুতি শুরু করারও নির্দেশ দিয়েছেন।
ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, “আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এটাই জেরুজালেমকে আনুষ্ঠানিকভাবে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার সময়।” তিনি তার এই পদক্ষেপকে ফিলিস্তিন এবং ইসরায়েলের মধ্যে ‘শান্তির জন্য গুরুত্বপূর্ণ’ বলেও উল্লেখ করেন। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহু এই ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, ফিলিস্তিনের সাথে যেকোনো শান্তি আলোচনার প্রথম শর্ত হচ্ছে, জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকার করে নিতে হবে। তিনি অন্যান্য রাষ্ট্রকেও যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপ অনুসরণ করার আহবান জানান।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই বিশ্বের একমাত্র দেশ, যারা জাতিসংঘের সিদ্ধান্তের বাাইরে গিয়ে এরকম বিতর্কিত একটি সিদ্ধান্ত নিলো। যদিও ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারণাতেই এই সিদ্ধান্তের প্রতিশ্রুতি ছিল, তারপরেও তিনি সত্যি সত্যিই জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী ঘোষণা করে মধ্যপ্রাচ্যকে আরও অস্থিতিশীলতার দিকে ঠেলে দেবেন, এটি হয়তো অনেকের কাছেই অপ্রত্যাশিত ছিল। তবে ট্রাম্প প্রশাসনের এক কর্মকর্তা জানিয়েছিলেন, জেরুজালেমকে রাজধানী ঘোষণা করলেও এতে আল-আকসা মসজিদ সহ জেরুজালেমের অন্যান্য পবিত্র ধর্মীয় স্থাপনার ব্যাপারে যে ‘স্ট্যাটাস কো’ আছে, তার কোনো পরিবর্তন ঘটবে না।
চলুন তবে এক নজরে দেখে নেওয়া যাক, জেরুজালেম কেন এত গুরুত্বপূর্ণ এবং ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত কেন অন্যায় এবং বিতর্কিত সিদ্ধান্ত:
- ধর্মীয় এবং ঐতিহাসিক কারণে মুসলমান, খ্রিস্টান এবং ইহুদী- তিনটি ধর্মের অনুসারীদের কাছেই জেরুজালেম বা আল-কুদস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই শহরের পূর্ব অংশে আল-আকসা মসজিদ, ডোম অফ রক এবং বৃহত্তর হারাম শরিফ অবস্থিত।
- ইসরায়েলের সৃষ্টির পর থেকে জাতিসংঘের পরিকল্পনা অনুযায়ী জেরুজালেমের নিয়ন্ত্রণ থাকার কথা ছিল আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের হাতে। কিন্তু ইসরায়েল ১৯৪৮ সালের যুদ্ধের পর পশ্চিম জেরুজালেম এবং ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের পর পূর্ব জেরুজালেম দখল করে নেয়।
- ইসরায়েল পুরো অখণ্ড জেরুজালেমকে তাদের রাজধানী বলে দাবি করে। কিন্তু জাতিসংঘ সহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কেউই তাদের এ দাবির সাথে একমত পোষণ করেননি।
- বিশ্বের কোনো রাষ্ট্রের দূতাবাস জেরুজালেমে অবস্থিত না। যে রাষ্ট্রগুলো ইসরায়েলকে বৈধ রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকার করে, তাদের সবার দূতাবাস তেল আবিব শহরে।
- পূর্ব জেরুজালেমের উপর ফিলিস্তিনরা নিজেদের অধিকার দাবি করে এবং দ্বিরাষ্ট্র সমাধানের ভিত্তিতে স্বাধীন, সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে পূর্ব জেরুজালেমকে ফিলিস্তিনের রাজধানী করার প্রত্যাশা ব্যক্ত করে।
- বর্তমানে পূর্ব জেরুজালেম ইসরায়েল দ্বারা অধিকৃত। জর্ডানের সাথে করা এক সমঝোতা চুক্তি বা ‘স্ট্যাটাস কো’ অনুযায়ী জর্ডান ভিত্তিক ‘ওয়াক্বফ’ কর্তৃপক্ষ মসজিদ আকসা সহ হারাম শরীফ নিয়ন্ত্রণ করে। আর এর বাইরে মূল শহরটি নিয়ন্ত্রণ করে ইসরায়েলি সেনারা।
- ডোনাল্ড ট্রাম্পের এ হঠকারী সিদ্ধান্তের ফলে জেরুজালেমের স্ট্যাটাস কো, স্থিতিশীলতা এবং শান্তির সকল সম্ভাবনা হুমকির মুখে পড়বে বলে আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন বিশ্ব নেতৃবৃন্দ।
- ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস ট্রাম্পকে হুঁশিয়ার করে বলেছেন, এই পদক্ষেপ শান্তি প্রক্রিয়াকে এবং এই অঞ্চলের পাশাপাশি সারা বিশ্বের শান্তি, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতাকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করবে।
- তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়িপ এরদোয়ান এই পদক্ষেপকে মুসলমানদের জন্য ‘রেড লাইন’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। এই পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলে তিনি ইসরাইলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করারও হুমকি দেন।
- জর্ডানের বাদশাহ দ্বিতীয় আব্দুল্লাহও বলেন, এরকম সিদ্ধান্ত এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তাকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান এবং বাদশাহ আব্দুল্লাহ বুধবার এক বৈঠকের পর যৌথ সংবাদ সম্মেলন করে ফিলিস্তিনের প্রতি তাদের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেন।
- এছাড়াও ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি, সৌদি আরবের বাদশাহ সালমান বিন আব্দুল আজিজ, মিসরের প্রেসিডেন্ট আব্দুল ফাত্তাহ আল-সিসি, জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী সিগমার গ্যাব্রিয়েল, ইউরোপীয় ইউনিয়নের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি ফেদেরিকা মোগেরিনি, জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তনিও গুতিয়েরেস এই পদক্ষেপের নিন্দা জানিয়েছেন।
- ফিলিস্তিনি সংগঠন হামাস হুঁশিয়ারি করে জানিয়েছে, এরকম কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হলে তারা নতুন করে ইন্তিফাদা বা গণ-অভ্যুত্থান শুরু করবে এবং আগামী শুক্রবারকে ‘বিক্ষোভ দিবস’ দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে।
ফিচার ইমেজ: Brendan Smialowski/AFP/Getty Images