জেরুজালেম নিয়ে ইজরায়েল আর ফিলিস্তিনিদের মধ্যে টানাপোড়েন আজ নতুন না। আধুনিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার হাজার বছর আগে থেকে এই পবিত্র শহরটি নিয়ে ইহুদি, খ্রিষ্টান আর মুসলিম ধর্মাবলম্বী মানুষদের মধ্যে কাড়াকাড়ি লেগে আছে। তবে বহু পুরনো এই বিতর্কের আগুন উস্কে ওঠে গত বছরের ৬ ডিসেম্বর, যখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা দেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জেরুজালেমকে ইজরায়েলের বৈধ রাজধানী হিসেবে মেনে নিয়েছে।
এই ঘোষণার প্রতিক্রিয়া হয়েছে মারাত্মক। বলতে গেলে গোটা বিশ্বই কিন্তু ইজরায়েল বা যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। ২১ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে একটি খসড়া প্রস্তাব আনা হয় ইয়েমেন আর তুরস্কের পক্ষ থেকে, যেখানে ১২৮টি দেশ জেরুজালেমকে ইজরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়।
তবে ইজরায়েল কিন্তু এতগুলো দেশের বিরুদ্ধে গিয়েও বিশেষ কোনো দুশ্চিন্তার ভাব দেখাচ্ছে না। ইহুদি রাষ্ট্রটি বরাবরই জাতিসংঘকে একটি শত্রুভাবাপন্ন সংস্থা হিসেবে দেখে থাকে। এর পেছনে কারণও আছে যথেষ্ঠ। এই গেল ২০১২ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ইজরায়েলের প্রবল আপত্তির বিরুদ্ধে গিয়ে ফিলিস্তিনকে পর্যবেক্ষক দেশ (নন মেম্বার অবজার্ভার স্ট্যাটাস) হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ১৩৮টি দেশ এই প্রস্তাবের পক্ষে সায় দিয়েছিলো। এরপর ২০১৫ সালে ফিলিস্তিন ভূখন্ডে ফিলিস্তিনিদের নিজস্ব পতাকা ওড়াবার অধিকারের পক্ষেও সায় দিয়েছিলো ১১৯টি দেশ। যদিও বরাবরের মতো এই প্রস্তাবেও ইজরায়েল প্রবল বিরোধিতা জানিয়েছিলো।
এতো গেল সাম্প্রতিক সময়ের কথা। জাতিসংঘে ইজরায়েলের অবস্থান বরাবরই নাজুক। এমনকি সেই ১৯৪৭ সালেও ইহুদি দলগুলো ভয় পাচ্ছিলো যে হয়তো পৃথক একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় দুই-তৃতীয়াংশ ভোট তারা জাতিসংঘে পাবে না। এই ভয় যে নিতান্ত অমূলক ছিল না তা-ও কিন্তু ভোটের সময় প্রমাণ হয়ে যায়। ইজরায়েলে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব অনুমোদন হয় বটে, তবে পক্ষে ভোট পড়েছিলো মাত্র ৩৩টি। বিপক্ষে ভোট পড়ে ১৩টি, ১০টি রাষ্ট্র ভোটদানে বিরত ছিল। মনে করা হয়, পুনরায় যদি ইজরায়েল প্রতিষ্ঠা নিয়ে ভোটাভুটি করা হত, তাহলে ইহুদি রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব অনুমোদন পেত না।
ওদিকে ফিলিস্তিনিরা কিন্তু বরাবরই জাতিসংঘকে তাদের পাশে পেয়েছে। ১৯৭৫ সালে জাতিসংঘ ঘোষণা দেয় যে, জায়নবাদ (উগ্র ইহুদিবাদ) আসলে একপ্রকারের বর্ণবাদ। অথচ এই জায়নবাদীরাই কিন্তু পৃথক ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে সেই শুরু থেকে। ফলে ১৯৭৫ এর এই ঘোষণা ইজরায়েল প্রতিষ্ঠার পেছনে মূল আন্দোলনকেই একপ্রকার অবৈধ ঘোষণা করে। যদিও এই ঘোষণা আবার ১৯৯১ সালে বাতিল করা হয়। ২০০১ আর ২০০৯ সালে ডারবানে অনুষ্ঠিত বর্ণবাদ বিরোধী কনফারেন্সে দক্ষিণ আফ্রিকা ইজরায়েল রাষ্ট্রটিকে একটি বর্ণবাদী রাষ্ট্র হিসেবে অভিহিত করে। অভিযোগ করা হয় যে, ইজরায়েল সরকার জাতিগত হত্যাকান্ড চালাচ্ছে। কনফারেন্সে অংশগ্রহণকারীদের মাঝে ‘প্রোটোকলস অব দ্য এল্ডার্স অব জায়ন’ এবং অ্যাডলফ হিটলারের গ্রন্থ ‘মাইন কাম্ফ’ বিতরণ করা হয়। এই দুটি পুস্তকই তীব্র ইহুদি বিদ্বেষী বক্তব্যে পরিপূর্ণ।
২০০৩-১২, এই ৯ বছরে জাতিসংঘে ইজরায়েলকে কেন্দ্র করে মোট ৩১৪টি খসড়া প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়, যার ৪০ শতাংশই ভোটে পাস করে। শুধু তাই না, পরের বছর, ২০১৩ সালেই কেবল ইজরায়েলের বিরুদ্ধে ৬টি ঘোষণা প্রস্তাব পাস করা হয়। ইজরায়েলকে কেন্দ্র করে পৃথিবীর অন্য যেকোনো দেশের থেকে বেশি জরুরি বৈঠিক অনুষ্ঠিত হয়েছে জাতিসংঘে। অথচ এই জাতিসংঘই দারফুরের গণহত্যা নিয়ে একটিও নিন্দা প্রস্তাব পাস করতে পারেনি। পাকিস্তান, চীন, সৌদি আরব, সুদান বা জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে একবারও মানবাধিকার লংঘনের প্রস্তাব গৃহীত হয়নি জাতিসংঘে।
কাজেই জাতিসংঘের মতামত কেন ইজরায়েলকে প্রভাবিত করেনা তা বুঝতে হলে এই ইতিহাস জানা থাকা জরুরি। ইজরায়েল ধরেই নিয়েছে যে, জাতিসংঘ কোনোভাবেই তাদের পাশে থাকবে না এবং তাই এই সংস্থাটির কথা বিবেচনায় না এনেই তারা নীতি নির্ধারণ করে থাকে। ইজরায়েলিরা জাতিসংঘের ব্যাপারে কী মনোভাব পোষণ করে তা বুঝতে হলে দুটি মন্তব্যই যথেষ্ঠ। ইজরায়েলের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন গুরিয়েন একবার মন্তব্য করেছিলেন যে, জাতিসংঘ হলো পাগলের আখড়া। দ্বিতীয় উক্তিটি আরো সরস। ‘৫০ এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত ইজরায়েলী রাষ্ট্রদূত আবা এবান বলেছিলেন, “জাতিসংঘে যদি আলজেরিয়া এই নিন্দা প্রস্তাব তোলে যে, পৃথিবীটা চ্যাপ্টা এবং এর পেছনে দায়ী ইজরায়েল, তাহলে ১৬৪টা ভোট এই প্রস্তাবের পক্ষে পড়বে আর বিপক্ষে পড়বে মোটে ১৩টা।”
কিন্তু যত যা-ই হোক, জাতিসংঘ কোনো ছেলেখেলা না। এটি পৃথিবীর রাষ্ট্রগুলোর সবথেকে বড় সংস্থা। এদিকে ইজরায়েল একটি সাড়ে আট হাজার বর্গ মাইলের ছোট্ট দেশ, চারপাশে যা শত্রুভাবাপন্ন আরব জনগোষ্ঠী দ্বারা পরিবেষ্টিত। কিন্তু তবুও ইজরায়েলের এই বেপরোয়া মনোভাবের কারণ কী?
মধ্যপ্রাচ্যের নতুন রাজনীতি
মধ্যপ্রাচ্যের ইজরায়েল বিরোধী আরব জোট আর আগের মতো শক্তিশালী নেই। একটা সময় মিশরের গামাল আব্দেল নাসের, সিরিয়ার হাফেজ আল আসাদ, সাদ্দাম হোসেনের ইরাক বা সৌদি আরব এবং জর্ডানের রাজারা ইজরায়েলের বিরুদ্ধে যথেষ্ঠ তোলাপাড়া করেছিলেন। কিন্তু পর পর চারটি যুদ্ধে (১৯৪৭, ১৯৫৬, ১৯৬৭ এবং ১৯৭৩ এর আরব-ইজরায়েল যুদ্ধ) ভীষণ বাজেভাবে হারার পর তাদের সেই কন্ঠ আজ অনেকটাই স্তিমিত। এদিকে মধ্যপ্রাচ্যে নতুন খেলোয়াড় হিসেবে উদয় হয়েছে শক্তিশালী দেশ ইরান। শিয়া মুসলিম অধ্যুষিত এই দেশটিকে মধ্যপ্রাচ্যের সুন্নি মুসলিম প্রধান দেশগুলো ভয়ানক শত্রুর নজরে দেখে। এ কারণেই সৌদি আরব বা মিশরের মতো কট্টর ইজরায়েল বিরোধীরা আজ ইহুদি রাষ্ট্রটির সাথে প্রকাশ্যে বা গোপনে নানা কর্মকান্ডে অংশ নিচ্ছে। যদিও জাতিসংঘে এই দেশ দুটি ইজরায়েলের বিরুদ্ধেই কথা বলে, তবে এটা পরিষ্কার যে আসলে রাজনীতির মাঠে তারা ইহুদি দেশটিকে একপ্রকার মিত্র হিসেবেই ধরে নিয়েছে। যতদিন মিশর বা সৌদি আরবের মতো শক্তিশালী আরব মিত্র পাশে আছে, ইজরায়েল জাতিসংঘকে বিশেষ গুরুত্ব না দিলেও কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি হবে না।
ইজরায়েলের শক্তি
ইজরায়েল যখন জাতিসংঘে যোগ দেয় তখন সালটা ছিলো ১৯৫০। ৬০ তম সদস্য হিসেবে জাতিসংঘে যোগ দেওয়ার পর জর্ডান নদী দিয়ে অনেক পানি গড়িয়েছে। বিশ্বে অনেকগুলো নতুন দেশ তৈরি হয়েছে। ইজরায়েলের পরে আরো ১৩৩টি দেশ জাতিসংঘে যোগ দিয়েছে। কিন্তু যুদ্ধ, অর্থনীতি বা সামাজিক উন্নয়ন সূচকে তাদের মধ্যে খুব কম রাষ্ট্রই ইজরায়েলের সমকক্ষ হতে পেরেছে।
ইজরায়েলকে উন্নত বিশ্বের কাতারে ফেলা হয়, তাদের নাগরিকদের মাথাপিছু গড় আয় প্রায় ৪০ হাজার মার্কিন ডলার। ইজরায়েলের আভ্যন্তরীণ সামাজিক বা রাজনৈতিক জীবনও তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি শান্ত আর স্থিতিশীল। সামরিক বাহিনীর কথা বলতে গেলে এ কথা তো ওপেন সিক্রেট যে, মধ্যপ্রাচ্যের একমাত্র পরমাণু শক্তিধর দেশ ইজরায়েল। সম্মুখ যুদ্ধই বলুন বা অন্য দেশের ভূখন্ডে মোসাদ, সিনবেতের চালানো বিপদজনক সব গোপন অপারেশনের কথাই বলুন, ইজরায়েলের সামরিক বাহিনীর কৃতিত্ব অস্বীকার করবার কোনো উপায় নেই। তাই সামরিক, অর্থনৈতিক আর সামাজিক সূচকে শক্তিশালী অবস্থান রাষ্ট্রটিকে এহেন বেপরোয়া মনোভাব গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞেরা।
জাতিসংঘের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা
জাতিসংঘ কাড়ি কাড়ি নিন্দা প্রস্তাব আনতে পারে, কিন্তু সাধারণ পরিষদে সেটা পাস হলে মৌলিক কোনো পরিবর্তন আসলে হয় না। অবরোধ আরোপই বলুন বা সামরিক পদক্ষেপ, এই সিদ্ধান্তগুলো নেওয়া হয় জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে। পাচঁটি স্থায়ী আর দশটি অস্থায়ী সদস্যবিশিষ্ঠ এই নিরাপত্তা পরিষদে যেকোনো প্রস্তাব গ্রহণ ঠেকিয়ে দিতে স্থায়ী সদস্যের একটি ভেটোই যথেষ্ঠ। নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যরা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, ফ্রান্স এবং যুক্তরাজ্য। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ইজরায়েলের ঘনিষ্ঠতম মিত্র বিধায় নিরাপত্তা পরিষদ ইজরায়েলের বিরুদ্ধে একরকমের ক্ষমতাহীন বললে মিথ্যা বলা হবে না। কাজেই জাতিসংঘ যেখানে স্রেফ কিছু নিন্দা প্রস্তাব আনা ছাড়া কার্যকরী কিছু করতে পারছে না, সেখানে ইজরায়েল যে বেপরোয়া হয়ে উঠবে সেটাই তো স্বাভাবিক!
ফিচার ইমেজ: wikimedia.commons