সিরিয়া যুদ্ধে রক্তক্ষয়: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা শক্তির হতাশাজনক ভূমিকা

সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের নির্মম ছবিগুলো যেন আজকাল আমাদের আর নাড়া দেয় না। ক্রমাগত মৃত্যুর মিছিল একটা সময়ের পর আমাদের সূক্ষানুভূতিগুলোকেও নষ্ট করে দেয় আর সিরিয়ার ক্ষেত্রেও সেটাই ঘটেছে। বিশ্বের বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের মতে, ২০১১ সাল থেকে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটির ১২,০০০ এরও বেশি নাগরিক রাজধানী শুধু দামাস্কাসেরই পূর্ববর্তী অঞ্চলে প্রাণ হারিয়েছেন। এছাড়াও গত দু’সপ্তাহে সিরিয়া সরকার তাদের সামরিক অভিযান আরও জোরদার করাতে মারা গেছেন পাঁচশরও বেশি মানুষ, যাদের মধ্যে রয়েছে অনেক শিশু।

আন্তর্জাতিক সূত্র অনুযায়ী, সিরিয়ার একনায়ক বাশার আল-আসাদ এর সামরিক বাহিনী যে শুধু আক্রমণ হেনেই ক্ষান্ত হচ্ছে তা নয়, সঙ্গে সঙ্গে তারা প্রয়োগ করছে ক্লোরিনের মতো প্রাণঘাতী গ্যাসও। ক্লোরিন গ্যাস যেহেতু নানা কাজে ব্যবহৃত হয়, তাই তাকে যুদ্ধের কাজে নিষিদ্ধ করা আন্তর্জাতিক আইনের পক্ষে কঠিন, আর এর ফায়দা তুলছে আসাদের সেনা।

সিরিয়ার রাষ্ট্রপতি বাশার আল-আসাদ; Source: Author: Fabio Rodrigues Pozzebom; agenciabrasil.ebc.com.br

সিরিয়ায় বছরের পর বছর ধরে এই চলতে থাকা নিধনযজ্ঞের চরম রূপ দেখে বিশ্বের নানা প্রান্তে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন এবং শান্তিকামী মানুষের মন কেঁদে উঠলেও, এই সমস্যার কোনো আশু সমাধান কারো চোখেই পড়ছে না। উল্টো নানা শক্তির হস্তক্ষেপের ফলে সিরিয়ার পরিস্থিতি দিন দিন আরও ঘোরালো হয়ে উঠছে। বর্তমান আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ক্ষমতার চূড়ান্ত লড়াই এখন অনুষ্ঠিত হচ্ছে সিরিয়াতেই। আর কোনো পক্ষই এখন এক চুল জমি ছাড়তেও রাজি নয়; তাতে নির্দোষ মানুষের প্রাণ গেলেও না।

সিরিয়ায় পশ্চিমের নীতিগত ব্যর্থতা

সিরিয়ার এই রক্তক্ষয়ী সংঘাত বন্ধ না হওয়ার অন্যতম বড় কারণ হচ্ছে পশ্চিমের নীতিগত ব্যর্থতা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামার সিরিয়া প্রসঙ্গে ঔদাসীন্য দেখিয়েছিলেন এবং এজন্য তাকে স্বদেশে যথেষ্ঠ সমালোচিতও হতে হয়। আদতে কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে এবং শুধুমাত্র  আসাদকে সাবধানবাণী শুনিয়ে ওবামা ওয়াশিংটনকে বিশ্বের দরবারে খাটো করেছেন বলে অভিযোগ ওঠে। ওবামার সিরিয়াকে চেপে ধরার সিদ্ধান্ত ঠিক ছিল না ভুল ছিল তা বিতর্কের বিষয়, কিন্তু তার সিদ্ধান্তের ফলে সিরিয়ায় যে শূন্যতা সৃষ্টি হয় এবং রাশিয়া, তুরস্ক এবং ইরানের মতো মার্কিন-বিরোধী দেশগুলো যে তার ফায়দা লুঠতে উঠেপড়ে লাগে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ওবামা যদি সিরিয়ার ব্যাপারে কঠোর অবস্থান নিতেন, তাহলে হয়তো আজ সেদেশের মানবনিধন যজ্ঞ বন্ধ করা যেত।

জাতিসংঘও চূড়ান্ত ব্যর্থ সিরিয়াকে বাগে আনতে

বহুমাত্রিক স্তরেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ার একনায়ক আসাদের উপরে চাপ সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়েছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের মাধ্যমে দামাস্কাসের উপর কঠিন নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারত পশ্চিমা শক্তিগুলি, কিন্তু তা তারা পারেনি। সিরিয়ায় তরফ থেকে একটি সীমিত প্রতিশ্রুতি যদিওবা পেয়েছিল তারা যে, রাশিয়াকে আসাদ নিজেদের ভয়ঙ্কর নার্ভ গ্যাসগুলিকে অক্রিয় করার অনুমোদন দেবে; কিন্তু শেষপর্যন্ত মার্কিন আধিকারিক দেখেন যে সে প্রতিশ্রুতি সিরিয়া রাখেনি এবং তার এই সিদ্ধান্তের পিছনে মস্কোর প্রচ্ছন্ন মদদ ছিল।

মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প; Source: Author: Gage Skidmore; Wikimedia Commons

গত এপ্রিলে মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প সিরিয়াতে ফের একটি সারিন গ্যাস আক্রমণের পরপরই সেখানকার একটি বিমানঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হানার নির্দেশ দেন এবং বিশেষজ্ঞদের মতে এই আক্রমণের পরে সিরিয়াতে সারিন আক্রমণের ঘটনা পুনরায় ঘটেনি। কিন্তু আন্তর্জাতিক মহলের মতে, সিরিয়া সমস্যা মোকাবেলায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের করার কথা ছিল এর চেয়ে অনেক বেশি। যে দেশকে আন্তর্জাতিক দুনিয়ার ‘বড় ভাই’ বলে ডাকা হয়, বিশ্বের নানা প্রান্তে নানা সমস্যায় এক লাফে ‘ঝাঁপিয়ে পড়ে’ যেই মহাশক্তিধর রাষ্ট্র, সিরিয়া সমস্যায় সে এত কুঁকড়ে থেকে বিপক্ষকে সুবিধা করে দিল কেন? এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতেই ব্যস্ত বিশ্লেষক মহল।

আফগানিস্তান এবং ইরাকের পর পশ্চিমা শক্তিগুলো ছিল দ্বিধাগ্রস্ত

সিরিয়া সমস্যায় পশ্চিমা বিশ্বের অবস্থান প্রথম থেকেই ছিল গোলমেলে। শুধুমাত্র ওবামার সিদ্ধান্ত নয়, এই ব্যর্থতা ছিল সম্মিলিত। হয়তো আফগানিস্তান এবং ইরাক যুদ্ধে প্রবল বিতণ্ডার পরে সিরিয়া প্রশ্নে প্রথম থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন পশ্চিম ছিল দ্বিধাগ্রস্ত। শুধুমাত্র ‘ভালো কিছু করার’ অভিপ্রায় নিয়েই পশ্চিমা শক্তিগুলি সিরিয়ার জট খোলার চেষ্টায় ছিল; তাদের নেতারা মধ্য এশিয়ার দেশটির জন্যে ‘এই দেখো কত ভালো কাজ করলাম’- এমন বার্তা প্রদর্শনেই যেন বেশি ব্যস্ত ছিল, আসল সমাধান খোঁজার থেকে।

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন; Source: Wikipedia

গায়ের জোরে আসাদকে হঠানোর পরিকল্পনা সফল হয়নি

পশ্চিমের চিরাচরিত ধারণা হচ্ছে, যেকোনো দেশের সমস্যার একমাত্র সমাধান হচ্ছে সেখানে তাদের ‘শত্রুভাবাপন্ন’ নেতৃত্বকে বদল করা। অতীতে বিশ্বের নানা দেশেই গোপন হস্তক্ষেপ বা সোজাসুজি বোমা মেরে এমন নেতৃত্বকে হঠিয়েছে মার্কিনীরা। সিরিয়ার আসাদ সম্বন্ধেও তাদের অবস্থান একই রকমের ছিল। মনে করা হয়েছিল, গৃহযুদ্ধ বাঁধার পর এক বছরও এই একনায়ক তার মসনদে টিকবেন না। শান্তি স্বাভাবিকভাবেই ফিরবে সিরিয়ার মাটিতে।

প্রাক্তন মার্কিন রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামা, পরিবারসহ; Source: Barack Obama Twitter handle @BarackObama

কিন্তু পশ্চিমের এই আশা পূর্ণ হয়নি। এক বছর তো দূরের কথা, এখন সপ্তম বছরে এসেও আসাদের প্রস্থানের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। রাশিয়ার সমর্থন (ভূরাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক নানা কারণেই সিরিয়াকে মস্কোর বিশেষ দরকার) আসাদের হাত যেমন শক্ত করেছে, অন্যদিকে আসাদ-বিরোধী শিবিরের কোনো পরিষ্কার নীতি ও দৃষ্টিভঙ্গি না থাকাতে গড়ে ওঠেনি কোনো আসাদের বিকল্প নেতৃত্ব। আর যত দিন গড়িয়েছে, পশ্চিমের এই নীতিগত অক্ষমতা আরও প্রকট হয়েছে; মার্কিন বিরোধিতার সুর শক্তিশালী হয়েছে, আসাদ আরও সহমর্মিতা কুড়িয়েছেন।

আসাদ-বিরোধী শক্তিকে সামরিক সমর্থন যোগানো হয়নি আশানুরূপভাবে

সামরিকভাবেও, পশ্চিমা শক্তিগুলো সিরিয়াতে আসাদ-বিরোধী শিবিরকে সেভাবে সমর্থন যোগাতে পারেনি। মুখে বড় কথা বললেও সামরিক সাহায্যে ঘাটতি ছিল বরাবরই। অন্যদিকে রাশিয়া, ইরান এবং হিজবুল্লাহর সামরিক সাহায্যে আসাদের সেনা আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে; কোণঠাসা হয় বাশারের বিরোধীরা। ২০১৩ সালে সিরিয়ার বিরুদ্ধে বলবৎ থাকা ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা ওঠার পরেও সেদেশে আসাদ বিরোধীদের হাতে যথেষ্ঠ অস্ত্রের যোগান দেয়নি মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা দেশগুলি। আশ্চর্যজনক শোনালেও এটাই সত্যি।

সিরিয়াতে অস্ত্র যোগানোর প্রশ্নে পশ্চিমের এই দোলাচলের কারণ ছিল অনেকগুলোই। সিরিয়ার সমস্যা যেহেতু শুধু সিরিয়ার ঘরোয়া রাজনৈতিক টানাপোড়েন নয়, সেখানে একইরকম গুরুত্বপূর্ণ মধ্য এশিয়ার আঞ্চলিক নানা সমস্যাও। যেমন- ইসলামিক স্টেট তথা আইএস এর উত্থান, কট্টরপন্থী সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে লড়াই ইত্যাদি। তাই শুধুমাত্র আসাদ এবং আসাদ-বিরোধী শক্তিগুলোর মধ্যে অস্ত্রের লড়াই কখনোই সীমাবদ্ধ ছিল না। অস্ত্রের যোগান দিলেও তা আসলে কার হাতে গিয়ে পৌঁছাচ্ছে, তা নিয়ে বিস্তর ধোয়াঁশা ছিল পশ্চিমা দেশগুলির মনে, আর তাতেই এই কৌশলগত ব্যর্থতা। পশ্চিমের প্রধান লক্ষ্য হয়ে ওঠে ইসলামিক স্টেটের পরাজয়, আর এর ফলে বাশার কিছুটা হলেও সুবিধা পেয়ে যান।

যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার এজাজ শহর; Source: Author: Christiaan Triebert; flickr.com

সিরিয়া প্রশ্নে প্রথম থেকেই পশ্চিমের কিছু না করার নীতি শেষ পর্যন্ত সাহস জুগিয়েছে আসাদ এবং তার বন্ধু রাষ্ট্রগুলোকেই। শুধুমাত্র মুখে আসাদের বাপান্ত করে যে লাভ কিছু হওয়ার নয়, তা এতদিন বাদে পশ্চিমা শক্তিগুলো হাড়ে হাড়ে বুঝছে। ২০১৬ সালের ডিসেম্বর মাসে যখন সিরীয় সেনা পুনরায় আলেপ্পো শহর দখল করে, তখনই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ পশ্চিমের অন্যান্য দেশ এবং আরব রাষ্ট্রগুলোর নৈতিক পরাজয় ঘটে যায়। কারণ, ততদিন পর্যন্ত তারা সমর্থন করেছিল আসাদ-বিরোধী শক্তিকে। আর শেষ অবধি যখন আসাদ তার বিরোধীদের ছত্রাখান করে দেয়, তখন দূর থেকে অসহায়ভাবে তা নিরীক্ষণ করা ছাড়া আর কোনো বিকল্পই খোলা ছিল না এই দেশগুলোর। প্রয়োজনের সময়ে সিরিয়া থেকে দূরে সরে থেকে তারা পরোক্ষভাবে আসাদের হাতই শক্ত করেছে, আর তাই আসাদ যখন চূড়ান্ত আঘাত হেনেছেন বিপক্ষের বিরুদ্ধে, তখন তারা কিছু বলার নৈতিক অধিকারও হারিয়েছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পিছু হঠাও তৈরি করেছে শূন্যতা

ট্রাম্পের সময়ে পশ্চিমা বিশ্বেও দেখা দিয়েছে নানা টানাপোড়েন। আটলান্টিকের দুই পাড়ের মধ্যে সম্পর্ক এখন বিশেষ ভালো নেই। ট্রাম্পের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন পিছু হঠতে ব্যস্ত; আমেরিকার পুরোনো মিত্রদেশগুলোর সঙ্গেও তার সম্পর্কে শৈত্য দেখা দিয়েছে। আর এই সুযোগে বিশ্ব রাজনীতিতে কর্তৃত্ব বাগাতে ব্যস্ত চীন, রাশিয়ার মতো দেশগুলো। সিরিয়া সমস্যাকেও আরও তীব্রতর করেছে আন্তর্জাতিক রাজনীতির এই নয়া প্রবণতা। আর এর ফলে সিরিয়াতে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের কোনো বিরামের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না; অন্তত এই মুহূর্তে তো নয়ই।

ফিচার ইমেজ: CNN.com

Related Articles

Exit mobile version