ট্রাম্পের আগেই কিমের সাথে জিনপিং এর বৈঠক: চীনের তুখোড় কূটনৈতিক চাল

বর্তমান বিশ্বরাজনীতিতে পশ্চিমকে যে এতটুকু জমি ছাড় দিতে রাজি নয় চীন, তা প্রমাণিত হলো সম্প্রতি উত্তর কোরিয়ার সর্বোচ্চ নেতা কিম জং উনের বেইজিং ভ্রমণে। ঘটনাটি এমন এক মুহূর্তে ঘটল যখন কিমের সঙ্গে সামনাসামনি বসে তার পরমাণু শক্তিবৃদ্ধির পরিকল্পনায় রাশ টেনে বিশ্বের সামনে শান্তিকামী নায়কের তকমা হাসিল করার কথা ভাবছিলেন মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প। এমন সময়ই কিমকে বেইজিং এ ডেকে এনে তার সঙ্গে চীন-উত্তর কোরিয়া দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে উন্নত করার আলোচনা করে ট্রাম্পের পাল থেকে বেশ খানিকটা হাওয়া টেনে নিলেন চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং, যাকে সম্প্রতি সেদেশের সংবিধান অনির্দিষ্টকালের জন্যে রাষ্ট্রপতি থাকার অনুমোদন দিয়েছে।

চীনের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বেইজিং এ করমর্দনরত উত্তর কোরিয়ার সুপ্রিম নেতা কিম জং উন; Source: Twitter

অবশ্য কিমের সঙ্গে ট্রাম্পের প্রস্তাবিত বৈঠকের দিনক্ষণ এখনও স্থির হয়নি; বলা হচ্ছে তা হতে পারে আগামী মে মাসে। তবে শি-র সঙ্গে আলোচনার পরে ধরেই নেওয়া যায় যে, সেই বৈঠকে কিমের অবস্থান যথেষ্ঠ পোক্ত হবে। ট্রাম্পের চোখে চোখ রেখে কিম তাকে বুঝিয়ে দিতে পারবেন যে তার সঙ্গে পূর্ব এশীয় অঞ্চলের অন্যতম প্রধান শক্তি চীন রয়েছে। কূটনৈতিকভাবে তা ওয়াশিংটনের কর্তাদের এবং ওই অঞ্চলে ওয়াশিংটনের জোটসঙ্গীদের কাছে যে বেশ তাৎপর্যপূর্ণ, তা বলে দেওয়ার অপেক্ষা রাখে না।

এই বৈঠকের মাধ্যমে শক্ত বার্তা দিল চীন

চীনের জন্যও কিমের এই সফর গুরুত্বপূর্ণ। সাম্প্রতিক সময়ে উত্তর কোরিয়ার পরমাণু পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে চীনের উপরে উত্তরোত্তর চাপ বাড়িয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কিমকে নিরস্ত করার জন্যে। কিন্তু বেইজিং পিয়ংইয়ংকে বাগে আনতে পারেনি। তাতে আরও ক্ষোভ বেড়েছে ওয়াশিংটনের। একদিকে পশ্চিমের চাপ, অন্যদিকে কিমের বেয়াড়া কার্যকলাপে বেশ অস্বস্তিতে ছিল চীন।

মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প; Source: Author: Gage Skidmore; flickr.com

উত্তর কোরিয়ার উপরে নিষেধাজ্ঞাকে সমর্থন করলেও চীনের ভয় ছিল, যদি কোনোভাবে কিম সাম্রাজ্যের পতন ঘটে, তবে চীনের দক্ষিণ সীমান্তটি বিপদের সম্মুখীন হয়ে পড়বে। পিয়ং ইয়ং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়ার বিরুদ্ধে চীনের যাকে বলে ‘বাফার স্টেট’ বা প্রতিরক্ষা প্রাচীরের কাজ করে।

যদি সেই প্রাচীরটি ধসে পড়ে, তবে একদিকে যেমন শত্রু শিবিরের আঁচ চীনের সীমান্তের কাছাকাছি চলে আসবে, অন্যদিকে উত্তর কোরিয়ার পতন হলে তা চীনে শরণার্থী সমস্যারও সৃষ্টি করবে। সবদিকে থেকে বিচার করলেই তাই কিমের সঙ্গে শি-এর এই বৈঠক চীনকে আশ্বস্ত করবে। নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও চীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে এই বার্তা দিতে পারবে যে, উত্তর কোরিয়া প্রশ্নে বেইজিং যথেষ্ঠ প্রাসঙ্গিক।

উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ মহড়া; Source: Author: Mariusstad; Wikimedia Commons

শি তাদের বৈঠকে কিমের উত্তর কোরিয়াকে যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে আরও গতি আনতে পরামর্শ দিয়েছেন, তা নিছক নয়। উত্তর কোরিয়াকে তার বিচ্ছিন্নতা থেকে বের করে আনার কাজটি করে দেখাতে পারলে মার্কিনীদের বিরুদ্ধে চীন নিঃসন্দেহে এক কূটনৈতিক জয় হাসিল করবে। ট্রাম্প পরে সেই একই কাজ করলেও তা আগে করে দেখানোর কৃতিত্ব নেবেন শি জিনপিং।

এছাড়াও, কিমের সঙ্গে শি-র বৈঠকের গুরুত্ব শুধুমাত্র উত্তর কোরিয়ার পরমাণু শক্তি পরীক্ষার বিষয়টির মধ্যেই সীমিত নয়, তার ব্যাপ্তি অনেক বড়। চীনের প্রতিবেশী অঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার জোটসঙ্গীদের সামরিক উপস্থিতি এবং মহড়ায় বেইজিং খুশি নয় মোটেই। উত্তর কোরিয়ার পরমাণু হুমকির বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা গড়ে তুলতে দক্ষিণ কোরিয়ায় মার্কিনী থাড মিসাইল লঞ্চার প্রতিস্থাপন নিয়েও চীনের অস্বস্তি অজানা নয়।

কিমের সঙ্গে শি-এর বৈঠক সেদিক থেকেও একটি সার্বিক চিত্র মেলে ধরে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেমন নিজের আঞ্চলিক জোটসঙ্গীদের হাত প্রায়শই ধরে থাকে, তেমনই চীনও নানা সমস্যা থাকা সত্ত্বেও উত্তর কোরিয়ার হাত ছাড়তে রাজি নয়।

যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এই বৈঠক বেশ অস্বস্তিকর

চীনের উপর চাপ দেওয়া এবং চীন এবং উত্তর কোরিয়ার মধ্যকার সম্পর্কে শৈত্য ট্রাম্প প্রশাসনকে আশান্বিত করেছিল। শত্রু শিবিরে এক অদৃশ্য ভাঙন আখেরে তাদেরকেই লাভবান করবে বলে ভেবেছিল ওয়াশিংটন। কিন্তু বেইজিং এ কিম-শি বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে যে নতুন করে ঘুঁটি সাজাতে হবে, সে কথা অনস্বীকার্য। একা কিমকে লক্ষ্য করে নিজের শর্ত আরোপ করার কৌশল আর ট্রাম্প-কিম বৈঠকে কাজ করবে না। এখন ফের সেই পুরোনো বেইজিং-পিয়ং ইয়ং বনাম ওয়াশিংটন-সিউল-টোকিও জোটের সমীকরণই কার্যকরী হবে।

ড্যানিয়েল রাসেল, যিনি প্রাক্তন মার্কিন রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামার এশিয়া-প্যাসিফিক নীতি প্রণয়নের পিছনে এক বড় দায়িত্ব পালন করেছিলেন, তিনি বলেন, কিম-এর তরফেও শি-এর সঙ্গে তার বৈঠক বেশ ফলপ্রসূ। তার মতে, উত্তর কোরিয়া সবসময়েই চেয়েছে তার বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা আন্তর্জাতিক জনমত যাতে ঐক্যবদ্ধ না হতে পারে। চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও উত্তর কোরিয়া সমস্যায় জড়িত রয়েছে জাপান, রাশিয়া এবং দক্ষিণ কোরিয়া।

সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রপতি ওবামার সাথে শি জিনপিং; Source: OSNet Daily

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কথা বলার আগেই চীনের নৈতিক সমর্থন পেয়ে কিম আন্তর্জাতিক মহলকে ঐক্যে পৌঁছাতে ফের একবার ধাক্কা দিলেন। উত্তর কোরিয়া প্রসঙ্গে অন্তত চীন এই মুহূর্তে তার অবস্থান নরম করবে, আর তাতেই ব্যাহত হবে ট্রাম্পের কিমকে শিক্ষা দেওয়ার অভিপ্রায়। এই শিক্ষার ব্যাপারটিকে বাস্তবায়িত করতে ট্রাম্পকে এখন চীনের নেতৃত্বের সঙ্গেও যোগাযোগ, বার্তালাপ বাড়াতে হবে। কিন্তু শুল্ক-যুদ্ধের মাঝে তা যে খুব সহজ হবে না, তা একটি শিশুও বোঝে।

অন্যদিকে, রাশিয়াও ওয়াশিংটনকে কূটনৈতিকভাবে চাপে রাখতে কিম-শি বৈঠককে সমর্থন জানিয়েছে। যার অর্থ, উত্তর কোরিয়া প্রসঙ্গে মস্কোকেও ধর্তব্যের মধ্যে রাখতে হবে ট্রাম্পকে। আর এই বহুপাক্ষিক জটিলতার মধ্যেই রয়েছে কিমের সাফল্য। এরপরে ওয়াশিংটন তাকে চোখ টাটাতে গেলেই সে চীন এবংং রাশিয়ার মতো বড় শক্তিগুলোর ছায়ায় আশ্রয় নেবে।

ওয়াশিংটনের অন্দরমহলও দ্বিধাবিভক্ত

সমস্যা আছে খোদ ওয়াশিংটনের অন্দরেও। সম্প্রতি ট্রাম্প প্রশাসনের নতুন নিরাপত্তা উপদেষ্টা নিয়োজিত হয়েছেন কট্টরপন্থী জন বোল্টন। দায়িত্বভার নেওয়ার কথা এপ্রিল মাসের গোড়ায়। অন্যদিকে, প্রাক্তন সিআইএ কর্তা মাইক পম্পিও হয়েছেন সে-দেশের নতুন বিদেশ সচিব। এরা দুজনেই উত্তর কোরিয়ার প্রসঙ্গে কড়া মনোভাব পোষণ করেন।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নবনিযুক্ত জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টন; এপ্রিল মাসে তার দায়িত্বভার নেওয়ার কথা; Source: Twitter

উত্তর কোরিয়াকে আরও সময় দেওয়া উচিত, নাকি তার সঙ্গে অচিরেই যুদ্ধে যাওয়া উচিত- এই বিতর্ক এখন ট্রাম্পের প্রশাসনে চলবে। আর এই দোলাচলের ফলে উত্তর কোরিয়া নিয়ে মার্কিন বিদেশনীতি ব্যাহত হবে যথেষ্ঠরকম। আর কিম, শি এবং রুশ রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিন ঠিক এই সুযোগেই পোক্ত করবে নিজেদের অবস্থান।

Featured Image Source: KOREAN CENTRAL NEWS AGENCY 

Related Articles

Exit mobile version