গত ২৭ এপ্রিল দুই কোরিয়ার মাঝে এক ঐতিহাসিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো। উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন সম্মেলনে যোগদান করতে দক্ষিণ কোরিয়ায় পানমুনজমে পদার্পণ করেন এদিন। ১৯৫১ সালের পর কিম জং উনই হচ্ছেন প্রথম উত্তর কোরীয় নেতা যিনি দক্ষিণ কোরিয়ায় গিয়েছেন। এটি দুই কোরিয়ার দ্বিপাক্ষিক সমঝোতা ও পুনর্মিলনের জন্য স্পষ্টতই একটি ঐতিহাসিক ব্যাপার।
তবে এই সম্মেলনের ফলে দুই কোরিয়ার সম্পর্কের আদৌ কোনো পরিবর্তন হবে কি? সম্মেলনে নেওয়া সিদ্ধান্তগুলো কী কী এবং এগুলো কি সত্যিই বাস্তবায়িত হবে? আজকের আলোচনা থাকছে এই সম্মেলন নিয়েই।
সম্মেলনটি কেন দক্ষিণ কোরিয়ায় অনুষ্ঠিত হলো?
কিম জং উন দক্ষিণ কোরিয়ার পানমুনজমে গিয়ে সেদেশের প্রেসিডেন্ট মুন জায়-ইনের সাথে দেখা করতে রাজি হন। এটি পিয়ংইয়ং এ ২০০০ সালের প্রথম আন্তঃকোরীয় সম্মেলনে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম ডায়-জুং এর অভিমতকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
কিম ডায়-জুং তৎকালীন উত্তর কোরীয় নেতা কিম জং-ইল এর চেয়ে প্রায় ১৭ বছরের বড় ছিলেন। তিনি বলেছিলেন, কনিষ্ঠ জনেরই উচিত জ্যেষ্ঠ নেতার নিকটে গিয়ে সাক্ষাৎ করা। সেক্ষেত্রে কিম জং-ইল এর উচিত দক্ষিণ কোরিয়ায় গিয়ে তার সাথে দেখা করা। কিন্তু তা আর কখনও হয়ে ওঠেনি।
কিম জং উনের দক্ষিণ কোরিয়ায় যাওয়া হয়তো তাই বিশেষ কোনো অর্থ বহন করে। হয়তো মুন জায়-ইনের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, এবারের সমেলনটি অন্যান্যবারের চেয়ে আলাদা হবে।
কারা ছিলেন কিম জং উনের সাথে?
মুন জায়-ইনের সাথে প্রাথমিক সাক্ষাতে কিম জং উন শুধু তার ছোট বোন কিম ইয়ো-জং ও সাবেক সামরিক গোয়েন্দা প্রধান কিম ইয়ং-চলকে সাথে নেন। তারাই কিমের সবচেয়ে কাছের উপদেষ্টা ও সহযোগী।
এছাড়া তিনি সম্মেলনের বিভিন্ন পর্যায়ের সাক্ষাতে বিভিন্ন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের নিয়ে যান। তিনি উত্তর কোরিয়ার দুজন শীর্ষ বৈদেশিক নীতি নির্ধারক, দুজন শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা এবং সংস্কৃতি ও খেলাধুলা সংক্রান্ত কর্মকর্তাদের সাথে নেন। এটি ভবিষ্যতে আরও কূটনৈতিক ও সামরিক মিথষ্ক্রিয়া এবং ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক বিনিময়ের প্রতি তার ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ নির্দেশ করে।
কিম জং উন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সাথে সাক্ষাৎকালে তার সাথে কোনো অর্থনৈতিক বা অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ব্যবস্থার কর্মকর্তা সাথে ছিলেন না। এটি অনেকক্ষেত্রেই নির্দেশ করে যে, কিম জং উন ও মুন জায়-ইনের বেশিরভাগ প্রাথমিক সাক্ষাৎ শুধু সৌজন্যমূলক এবং ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক ও যৌথ উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য আরও আলোচনা ও সাক্ষাৎ অপেক্ষা করছে।
দুই নেতার যুগ্ম বিবৃতি
রুদ্ধদ্বার আলোচনার পরে দুই নেতা একত্রে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সামনে বিবৃতি দেন। কিম জং উনের জন্য নিজের প্রতি সারাবিশ্বের পূর্বধারণাকে চ্যালেঞ্জ জানানোর একটি মুহূর্ত ছিল এটি। তার আত্মবিশ্বাসী ও স্বচ্ছন্দ বিবৃতি অনমনীয় ও স্বৈরাচারি শাসকের প্রতিমূর্তি থেকে তাকে কিছুটা হলেও অব্যাহতি দান করে।
দেশ দুটির নেওয়া সিদ্ধান্তের তুলনায় বিবৃতিটি ছোট। মুন জায়-ইন বলেন, “চেয়ারম্যান কিম জং উন ও আমি পরমাণু কর্মসূচি পুরোপুরি বন্ধ করতে সম্মত হয়েছি এবং এটিই আমাদের সাধারণ লক্ষ্য।”
মে মাসের এক তারিখ থেকে লিফলেট বিতরণ ও লাউডস্পিকারে ঘোষণাসহ সকল প্রকার প্রোপাগান্ডার কার্যক্রম বন্ধ করা হবে।
এছাড়াও জানানো হয় প্রেসিডেন্ট মুন জায় ইন উত্তর কোরিয়ার পিয়ংইয়ং সফরে যাবেন এবং উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ায় যেসব পরিবার বিভক্ত হয়ে আটকা পড়ে রয়েছে, তাদের সমস্যারও দ্রুত সমাধান করা হবে।
এই সম্মেলনের ঘোষণাগুলো কী?
দু’দেশের কর্তৃপক্ষ একটি ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেন। এ ঘোষণাপত্রটির নাম ‘পানমুনজম ডিক্লারেশন ফর পিস, প্রসপারিটি অ্যান্ড ইউনিফিকেশন অন দা কোরিয়ান পেনিনসুলা।’ এই ঘোষণাপত্রের প্রধান ঘোষণা তিনটি। এগুলোর মাঝে ছোট ছোট আরও কিছু বিস্তারিত দিক রয়েছে।
১। উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া জনগণের রক্তের সম্পর্ক পুনঃসংযোগ করে সমৃদ্ধি ও একতা ফিরিয়ে আনবে এবং আন্তঃকোরীয় সম্পর্কের মাধ্যমে ব্যাপক ও যুগান্তকারী অগ্রগতি ঘটাবে।
এর আওতায় প্রধানত রয়েছে দুই কোরিয়ার উন্নতির জন্য বিভিন্ন সাক্ষাৎ, যোগাযোগ ও একত্রে কাজ করা এবং বিভক্ত পরিবারগুলোর আত্মীয়-স্বজনের একত্রীকরণ অথবা তাদের সমস্যার সমাধান করা। সাথে সাথে আগের প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়ন করা।
২। উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া তীব্র সামরিক উত্তেজনা উপশম করতে একত্রে প্রচেষ্টা চালাবে এবং কোরীয় উপদ্বীপে যুদ্ধের ঝুঁকি বাস্তবিকভাবে অপসারণ করবে।
এর আওতায় রয়েছে ভূমি, আকাশপথ বা সমুদ্রপথে কোনো প্রকার হামলা বা সহিংসতা না চালানো, কয়েকটি অঞ্চলকে শান্তিপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে পরিণত করা, সামরিক সদস্যদের সাথে নিয়মিত সাক্ষাৎ করা ইত্যাদি।
৩। উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া কোরীয় উপদ্বীপে একটি স্থায়ী, দৃঢ় ও শান্তিপূর্ণ শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করবে। বর্তমানের অস্বাভাবিক যুদ্ধবিরতির অবসান ও কোরীয় উপদ্বীপে একটি বলিষ্ঠ শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা একটি ঐতিহাসিক লক্ষ্য এবং এটি আর বিলম্ব করা উচিত নয়।
এর আওতায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকটি ছিল কোরিয়া যুদ্ধের ৬৫তম যুদ্ধবিরতিতে কোরিয়া যুদ্ধ পুরোপুরিভাবে শেষ বলে ঘোষণা করার লক্ষ্যে তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অথবা যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সাথে বৈঠক করবে। অপর গুরুত্বপূর্ণ দিকটি হচ্ছে কোরিয়া উপদ্বীপ অঞ্চলে পারমাণবিক তৎপরতা বন্ধে দুই কোরিয়ার সম্মতি।
উত্তর কোরিয়ার পরমাণু কেন্দ্র বন্ধ
কোরীয় উপদ্বীপে পরমাণু তৎপরতা বন্ধ করায় দুই কোরিয়া সম্মত হয়েছে সেটা আমরা এর মাঝেই জেনেছি। কিন্তু কিম জং উন খুব শীঘ্রই এটি বাস্তবায়িত করতে যাচ্ছেন।
সম্মেলনে জানা যায়, আগামী মে মাসেই উত্তর কোরিয়ার পরমাণু কেন্দ্রটি বহির্বিশ্বের সামনে প্রকাশ্যে বন্ধ করে দেওয়া হবে। দুই কোরিয়ার বৈঠককালে কিম জং উন প্রেসিডেন্ট মুন জায়-ইনকে এ কথা জানান বলে প্রকাশ করেছে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র ইয়ুন ইয়াং-চ্যান।
তিনি আরও জানান, কিম জং আরও বলেছেন, এ প্রক্রিয়াটি বহির্বিশ্বের সামনে স্পষ্ট করে তুলে ধরতে তিনি দক্ষিণ কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রতিনিধিকে আমন্ত্রণ জানাবেন। এ পরমাণু কেন্দ্রটিতে ২০০৬ সাল থেকে ৬টি পারমাণবিক পরীক্ষা চালানো হয়েছে।
দুই কোরিয়ার এ সম্মেলন কতটুকু সফল তা ভবিষ্যতে তাদের কর্মকাণ্ডই বলে দেবে। এক্ষেত্রে বিশেষ করে উত্তর কোরিয়ার পরমাণু সংক্রান্ত পদক্ষেপগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ। আগামীতে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে উত্তর কোরিয়ার আলোচনাও বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
Featured Image Source: Korea Summit Press Pool/Getty Images