ইতিহাসে পুরুষদের পাশাপাশি সবসময় এগিয়ে এসেছেন নারীরাও। ইতিহাস তৈরিতে, ইতিহাসের অংশ হতে কাজ করেছেন তারা, সাহায্য করেছেন পুরুষ সঙ্গীকেও। আমেরিকার ইতিহাসটাও খুব একটা ভিন্ন কিছু নয়। যুক্তরাষ্ট্রের হোয়াইট হাউজে এখনো অব্দি নারী প্রেসিডেন্ট হয়তো উঠে আসতে পারেননি। তবে ফার্স্ট লেডি হয়ে প্রেসিডেন্টদের জীবনে এবং হোয়াইট হাউজে অসামান্য অবদান রেখেছেন তাদের অনেকে। তবে এবার হোয়াইট হাউজে আসা এখন অব্দি সমস্ত ফার্স্ট লেডি নয়, কথা বলবো সেই তিনজন নারীকে নিয়ে যারা প্রথম মৃত্যুবরণ করেছিলেন হোয়াইট হাউজের চার দেয়ালের মধ্যে। যারা কেবল ফার্স্ট লেডি হয়েই সন্তুষ্ট ছিলেন না, বরং এরচাইতেও অনেক বেশি অবদান রেখেছেন হোয়াইট হাউজ ও হোয়াইট হাউজে রাজ করা প্রেসিডেন্টদের পেছনে। চলুন জেনে নিই হোয়াইট হাউজে মৃত্যুবরণ করা প্রথম তিন নারীর নাম।
লেটিশিয়া টেলর
হোয়াইট হাউজে প্রথম ফার্স্ট লেডি হিসেবে মৃত্যুবরণ করেন লেটিশিয়া টেলর। তবে এমনটা হওয়ার কথা ছিল না একেবারেই। আর দশজন সাধারণ মানুষের মতোই মৃত্যুবরণ করার কথা ছিল লেটিশিয়ার। তবে স্বামী জন হুট করেই প্রেসিডেন্ট পদ লাভ করার পর হোয়াইট হাউজে বাস করতে শুরু করেন এই নারী আর সেখানেই মৃত্যু হয় তাঁর। লেটিশিয়া জন্মগ্রহণ করেন ১৭৯০ সালে। টাইডওয়াটার ভার্জিনিয়াতে বেড়ে ওঠা এই নারী প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা পান নি। স্বামী জন টেলর রাজনৈতিক জীবন নিয়ে অনেক বেশি ব্যস্ত থাকায় সংসার, ঘরকন্না আর দৈনন্দিন সমস্ত কাজ নিয়ে সবসময় ব্যস্ত থাকতে হয়েছে লেটিশিয়াকে। সেদিক দিয়ে জীবনকে এই নারী দেখেছিলেন বাস্তবতার চোখ দিয়ে, শিখেছিলেন অভিজ্ঞতা থেকে, হয়ে উঠেছিলেন স্বশিক্ষিত। লেটিশিয়া এবং জনের বিয়ে হয় ১৮১৩ সালের ২৯শে মার্চ। জন যে সময়টা কংগ্রেস সদস্য কিংবা ভার্জিনিয়ার প্রশাসক হিসেবে কাটিয়েছেন, সেই সময়ে লেটিশিয়া সামলান ঘরের সব দায়িত্ব। স্ত্রীকে খুব একটা রাজনৈতিক জীবনের সাথে জড়াননি জন। সবসময় তাঁকে এই সবকিছুর বাইরে রেখেছিলেন তিনি। শুধু একবার শীতকালীন সোশ্যাল সিজনে ওয়াশিংটনে স্বামীর সাথে যোগ দেন লেটিশিয়া।
মোট আট সন্তানের জন্ম দেন এই নারী। তবে তাদের মধ্যে একজনের মৃত্যু হয়। ১৮৩৯ সালে হঠাৎ করেই থেমে যায় লেটিশিয়ার জীবন। স্ট্রোকের মাধ্যমে অবশ হয়ে যায় শরীর। বিছানার মধ্যে আটকে যায় তার দিন। তবে নিজের কাজ থেকে দূরে থাকেননি তিনি। বিছানায় থেকেই সব কাজ সামলাতেন লেটিশিয়া। তিনি কখনোই চাননি যে জন রাজনীতি ছেড়ে অন্য কাজে মন দিক। ধর্মগ্রন্থ পাঠ, ঘরকন্না নিয়েই জীবন কেটে যাচ্ছিল লেটিশিয়ার। তবে কিছুদিনের মধ্যেই সবকিছুতে পরিবর্তন আসে। জন ১০ম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথগ্রহণ করেন। তাকে সঙ্গ দেন তার মেয়ে। তবে পেছন থেকে বিছানায় আবদ্ধ হয়েও সবদিকে নজর রাখছিলেন লেটিশিয়া। ১৮৪২ সালের ১০ সেপ্টেম্বর আরেকটি স্ট্রোক এসে লেটিশিয়ার জীবনকে পুরোপুরি থামিয়ে দেয়। হোয়াইট হাউজের মৃত ব্যক্তিদের তালিকায় ফার্স্ট লেডি হয়ে নাম লেখান তিনি। ১৮৪৪ সালে আবার বিয়ে করেন জন টেলর। তবে, লেটিশিয়া টেলরকে ভোলেনি হোয়াইট হাউজ কিংবা আর কেউ।
ক্যারোলাইন হ্যারিসন
আমেরিকার ২৩তম প্রেসিডেন্ট বেঞ্জামিন হ্যারিসনের স্ত্রী ছিলেন ক্যারোলাইন হ্যারিসন। ব্যাপারটি এমন নয় যে ক্যারোলাইন কেবল একজন ফার্স্ট লেডি ছিলেন। তিনি স্বমহিমায় এখনো পর্যন্ত হোয়াইট হাউজের সর্বত্র আছেন। ওয়াশিংটনের অনেকগুলো দাতা সংস্থার সাথে কাজ করেন ক্যারোলাইন। সেইসাথে কাজ করেন জন হপকিন্স মেডিকেল স্কুল এবং ডটার অব আমেরিকান রিভল্যুশনের জন্য। হোয়াইট হাউজকে নিজের মতো করে সাজিয়ে নেন এই ফার্স্ট লেডি। হোয়াইট হাউজে প্রথম বিদ্যুৎ নিয়ে আসেন তিনি। সেইসাথে ভবনটির নানারকম সংস্কার করার মাধ্যমে একে দর্শনীয় করে তোলার কাজটিও খুব যত্ন করে সমাপ্ত করেন ক্যারোলাইন।
জন স্কট এবং মেরি পট নীল স্কট দম্পতির পাঁচ সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয় সন্তান হয়ে জন্ম নেন ক্যারোলাইন। শিক্ষিত ক্যারোলাইনের সাথে বেঞ্জামিনের দেখা হয় ক্যারোলাইনের বাবার মাধ্যমে। একে অন্যকে ভালোবেসে ফেলেন তারা। এই দম্পতির বিয়ে হয় ১৮৫৩ সালের ২০শে অক্টোবর। অসম্ভব মেধাবী হওয়া স্বত্ত্বেও বেঞ্জামিনের জন্য নিজের পেশাগত জীবনকে পাশে সরিয়ে সংসারকে আপন করে নেন ক্যারোলাইন। ১৯৫৪ এবং ১৯৫৮ সালে তাদের দুটি সন্তান জন্ম নেয়।
সংসার, নিজের ছবি আঁকার শখ এবং সন্তানদেরকে নিয়ে বেশ ভালো ছিলেন ক্যারোলাইন। ১৮৮৮ সালে স্বামীর নির্বাচনের সময় অনেক বেশি কথা হয় ক্যারোলাইনকে নিয়ে। গণমাধ্যম ক্যারোলাইনের প্রতি নিজেদের দৃষ্টি ফেললে সেই সুযোগ কাজে লাগান এই নারী। হোয়াইট হাউজের মূল স্থাপনাকে ঠিক রেখে দু’পাশে স্থান বাড়িয়ে তোলার পরিকল্পনা করেন ক্যারোলাইন। এই কাজে তিনি সাহায্য নেন স্থপতি ফ্রেড ডি. ওউয়েনের। হোয়াইট হাউজের একপাশে আর্ট গ্যালারি এবং অন্যদিকে অফিস- এমনটাই ছিল ক্যারোলাইনের পরিকল্পনা। তবে এই পরিকল্পনা নাকচ করে দেওয়া হয়।
হোয়াইট হাউজকে না বাড়িয়ে এর মধ্যেই যতটা সম্ভব কাজ করার কথা বলা হয়। হোয়াইট হাউজকে সবার জন্য দর্শনীয় একটি স্থান করে তুলতে চেষ্টা করেন ক্যারোলাইন। বিভিন্ন দেশ থেকে নিয়ে আসেন সেরা সব উপাদান, আমেরিকার ইতিহাস তুলে ধরেন। সেইসাথে বিদ্যুতের ব্যবস্থাও করেন। হোয়াইট হাউজকে আজকের অবস্থানে আনার পেছনে যথেষ্ট ভূমিকা ছিল এই নারীর। ১৮৯২ সালে যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় এই নারীর। হোয়াইট হাউজে মৃত্যুবরণ করা দ্বিতীয় ফার্স্ট লেডি হন তিনি। তাকে সমাধিস্থ করা হয় ইন্ডিয়ানাপোলিসের মাউন্ট সিমেট্রিতে।
এলেন উইলসন
এলেন উইলসনের জন্ম ১৮৬০ সালের ১৫ মে। উড্রো উইলসনের প্রথম স্ত্রী হিসেবে হোয়াইট হাউজে জীবন কাটান এলেন। আর সেখানেই মৃত্যু হয় তার। প্রেসিডেন্ট উইলসনের ফার্স্ট লেডি নয়, বরং নিজের জন্য আর নিজের নামে পরিচিত হন এলেন সবার কাছে। ওয়াশিংটন ডিসিতে বসবাসকারী আফ্রিকান-আমেরিকানদের জীবনমান উন্নয়নের চেষ্টা করেন এই নারী। তবে উড্রো উইলসনের দ্বিতীয় স্ত্রীর চাইতে কম জনপ্রিয় ছিলেন এই নারী। কেন? তার কর্মকান্ডের জন্য। মানুষ হাসতে ভালোবাসতো এলেনকে নিয়ে। এলেন স্যামুয়েল এক্সেন ও মার্গারেট এক্সনের সাত সন্তানের মধ্যে সবচাইতে বড় ছিলেন। সপ্তম সন্তানের জন্মদানের সময় এলেনের মা মারা যান। ফলে কিছুদিনের মধ্যেই শোকে মারা যান এলেনের বাবাও।
পুরো পরিবারের সব দায়িত্ব এসে পড়ে এলেনের কাঁধে। সেই সময় তার বয়স ছিল মাত্র ২১ বছর। ১৮৮৫ সালের ২৪ জুন এলেন এবং উড্রো উইলসন বিয়ে করেন। উইলসন যে সময় নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, এলেন তখন নিজের ঘর সাজানোর চেষ্টা করেন। শিল্পী হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করেন তিনি। পরবর্তীতে সেই কাজগুলো মানুষের কাছে জনপ্রিয়তা পায়। বিশেষ করে ফার্স্ট লেডি হওয়ার পর এলেনের কাজগুলো সবার চোখে পড়ে অনেক বেশি করে।
এছাড়া ফার্স্ট লেডি থাকাকালীন সময়ে নিজস্ব আরো অনেক কর্মকান্ড সম্পাদন করেন তিনি, নারীদের নিয়ে কিছু কাজ করেন যার ফলে অনেক বেশি চর্চা হতে থাকে এলেনের নাম। তবে মাত্র ১৭ মাস এই জীবন কাটাতে পেরেছিলেন এলেন। ১৯১৪ সালের আগস্ট মাসে মৃত্যুবরণ করেন এই নারী। রোমে বাবা-মায়ের কবরের পাশে সমাহিত করা হয় তাকে। ফার্স্ট লেডি হিসেবে রাজনৈতিক জীবন, সামাজিক কর্মকান্ড এবং ঘরোয়া কাজকে কীভাবে একসাথে মিলিয়ে নিয়ে সফলভাবে কাজ করতে হয় সেটা চমৎকারভাবে দেখিয়ে দিয়েছিলেন এলেন উইলসন। হোয়াইট হাউজের তৃতীয় নারী ফার্স্ট লেডি হিসেবে হোয়াইট হাউজের মধ্যেই মৃত্যুবরণ করেন তিনি।
ফিচার ইমেজ: WhiteHouse.gov