Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

অনুরাগ কাশ্যপ: বলিউডের প্রথা ভাঙার গল্প

১৯৯৩ সালের জুন মাস, কিছু জামাকাপড় আর বই ভর্তি ব্যাগ নিয়ে এক তরুণ এসে হাজির হলেন বোম্বেতে। স্বপ্নের শহর বোম্বে। প্রতিদিন শত শত মানুষ আসে এই শহরে; নতুন জীবন গড়ার, নতুন কিছু করার স্বপ্ন নিয়ে। মুষ্টিমেয় কয়েকজন সফল হয়, আর বাকিরা স্বপ্ন বুকে চাপা দিয়ে লড়ে যায় টিকে থাকার সংগ্রামে। তরুণটি এসেছিলেন সিনেমা নির্মাতা হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে।

বোম্বেতে তো এসেছেন, কিন্তু চেনেন না যে কিছুই, শুধু জানেন পৃথ্বী থিয়েটারে যেতে হবে তাকে। রূপালী পর্দায় আর পর্দার আড়ালে কাজ করতে চাওয়া স্বপ্নবিলাসীদের মিলনমেলা এ পৃথ্বী থিয়েটার। বাইরে থেকে এসে হুট করে এখানে জায়গা করে নেয়া সহজ কাজ নয়। জায়গা করে নেয়া তো পরের কথা, পৃথ্বী থিয়েটারে ঢোকারই সুযোগই পেলেন না তিনি। কিন্তু এখানে ঢুকতে তো তাকে হবেই, এর জন্যই তো গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেও নিজের ক্যারিয়ারের ইতি টেনে ছুটে এসেছেন এখানে।

পৃথ্বী থিয়েটার; Image Source: prithvitheatre.org

যার কথা বলছি, তিনি বর্তমান সময়ে বলিউডের সেরা সিনেমা নির্মাতাদের একজন, অনুরাগ কাশ্যপ। ছোটবেলায় ইচ্ছা ছিল বিজ্ঞানী হওয়ার। ছেলেকে নিয়ে ইঞ্জিনিয়ার পিতাও একই স্বপ্ন দেখেছিলেন। দিল্লির বিখ্যাত হ্যান্স রাজ কলেজ থেকে ১৯৯৩ সালে প্রাণিবিদ্যায় গ্র্যাজুয়েশনও সম্পন্ন করেন তিনি। কিন্তু গ্র্যাজুয়েশনের পর যে কী হলো! বছরখানেক বিভিন্ন থিয়েটার গ্রুপের সাথে ঘুরে, মাথায় ভূত চাপলো সিনেমা বানাতে হবে। তিনি বুঝতে পারলেন, আসলে বিজ্ঞানী নন, তিনি একজন সিনেমা নির্মাতা হতে চান।

এ স্বপ্নই তাকে টেনে এনেছে পৃথ্বী থিয়েটারে। যেকোনো মূল্যে এ স্বপ্নের পেছনে ছুটতে রাজি তিনি। সোজা চলে গেলেন থিয়েটারের ক্যাফেতে। ক্যাফের মালিককে বললেন, আমি আপনার এখানে ওয়েটার হিসেবে কাজ করতে চাই। জবাব আসলো, ওয়েটারের দরকার নেই আমাদের। অনুরাগ হাল ছাড়তে রাজি নন। তিনি বললেন, আমি ফ্রিতে কাজ করবো। গ্র্যাজুয়েট একটা ছেলে ফ্রিতে ওয়েটারের কাজ করতে চাইছে, বিষয়টা অদ্ভুত ঠেকারই কথা। তিনি আসলে পৃথ্বী থিয়েটারের ভেতরে ঢোকার একটা সুযোগ খুঁজছিলেন।

ফ্রিতে কাজ করে দেয়ার লোভনীয় প্রস্তাব ছাড়লেন না ক্যাফের মালিক। অনুরাগও পেয়ে গেলেন পৃথ্বী থিয়েটারে ঢোকার সুযোগ। শুরু হলো তার নতুন সফর। পৃথ্বী থিয়েটারে নিয়মিত প্রচুর রিহার্সাল হতো। সেখানে স্ক্রিপ্ট পড়ে শোনানোর জন্য কাউকে না কাউকে দরকার পড়তো। অনুরাগ সে কাজটা করে দিতেন, কোনো কিছুর প্রত্যাশা ছাড়াই। শুধু স্ক্রিপ্ট পড়াই নয়, সামনে যা পেতেন তা-ই করতেন তিনি। স্টেজ ঠিক করে দেয়া থেকে শুরু করে স্ক্রিপ্ট লেখা পর্যন্ত।

অনুরাগ কাশ্যপ; Image Source: IBTimes-India

তার সবচেয়ে বড় দক্ষতা ছিলে তিনি বেশ দ্রুত লিখতে পারতেন। এমনকি দিনে একশ পৃষ্ঠার মতো লিখে ফেলতে পারতেন তখন। এসময় স্যাটেলাইট টেলিভিশনগুলোতে ধারাবাহিক তৈরি করার হিড়িক পড়ে। কিন্তু এত দ্রুত এত বেশি পর্বের ধারাবাহিক নির্মাণ করার ক্ষেত্রে তাদের ঝামেলায় পড়তে হতো। তিনি তাদের জন্য স্ক্রিপ্ট লেখতে শুরু করলেন, কোনো টাকা এমনকি কোনো ক্রেডিট ছাড়াই।

সময়ের সাথে সাথে পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে। ‘ত্রিকাল’ নামের একটি ধারাবাহিকের শেষে প্রথমবার তার নাম আসলো, ডায়ালগ লেখক হিসেবে। এরপর ধীরে ধীরে টাকাও আসতে শুরু করল। লেখক হিসেবে বেশ খানিকটা নামও হয়ে গেছে ততদিনে। ১৯৯৮ সালে মুক্তি পাওয়া ‘সত্য’ (Satya) সিনেমার শেষে প্রথম তার নাম আসে গোটা সিনেমার সহ-লেখক হিসেবে।

‘সত্য’ সিনেমাটি লেখা তার জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি সিদ্ধান্ত ছিল। কারণ একই সময়ে বলিউডের বিখ্যাত প্রযোজক মহেশ ভাট তাকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, ‘কাভি কাভি’ নামের একটি ধারাবাহিক লিখে দেয়ার জন্য। মহেশ ভাটের সাথে মাত্র এক মাসের চুক্তিতে তাকে আড়াই লক্ষ টাকার প্রস্তাব দেয়া হয়। এদিকে রাম গোপাল ভার্মা প্রস্তাব দেন ‘সত্য’ সিনেমা লিখে দেয়ার জন্য। সেখানে চুক্তি ছিল, প্রতি মাসে মাত্র দশ হাজার টাকা করে দশ মাসে এক লক্ষ টাকার।

সত্য (১৯৯৮) সিনেমার পোস্টার; Image Source: flipkart.com

সেই ১৯৯৫ সালে, বাইশ বছরের একটি ছেলের কাছে আড়াই লক্ষ টাকা খুবই লোভনীয় প্রস্তাব। কিন্তু অনুরাগ কাশ্যপ তো টাকার জন্য এখানে আসেননি, তিনি সিনেমার প্রথা ভাঙতে এসেছেন। তিনি যদি এখানে বসে বসে টাকার জন্য ‘কাভি কাভি’ বা এই ধরনের ধারাবাহিকই লিখে যেতে থাকেন, তবে তো সেই সিস্টেমের ফাঁদেই পড়ে যাবেন। রাম গোপাল ভার্মা তখন তার কাছে অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব, কারণ তিনি বলিউডের গৎবাঁধা সিনেমার ধরনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী সিনেমা তৈরি করছেন। অনুরাগ কাশ্যপও তো তা-ই চান।

তাই আর্থিকভাবে লাভবান না হলেও, তিনি রাম গোপাল ভার্মার সাথে কাজ করার এ সুযোগটি ছাড়লেন না। এ সিনেমাটিতে কাজ করার পর তার মনে আবার পুরানো স্বপ্ন মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। সেই ১৯৯৩ সালে যেই সিনেমা বানানোর স্বপ্ন দেখে বোম্বের পথ ধরেছিলেন। কিন্তু বলিউড তখন সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি নয়, বরং কিছু নির্দিষ্ট পরিবার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত একটা ব্যবসা মাত্র। তখনকার সিনেমাগুলোকে মোটা দাগে দুই ভাগে ভাগ করা যেত, প্রথমত তারকা অভিনেতা-অভিনেত্রী, নাচ-গানে ঠাসা ব্যবসায়িক সিনেমা, যেগুলো কেবল ব্যবসা করার জন্যই তৈরী। আর কিছু হতো আর্ট-ফিল্ম, যেগুলো অ্যাওয়ার্ড কুড়াবার জন্য বানানো হত, সিনেমা হলে কখনো মুক্তিই পেতো না।

অনুরাগ কাশ্যপের সিনেমা এ দুই ধরনের কোনোটার মধ্যেই পড়ে না। তার সিনেমার ওপর ভরসা করে এত টাকা ঢালবে কে? তিনি বুঝলেন তার যতটা সম্ভব কম খরচে সিনেমা নির্মাণ করতে হবে। কিন্তু কোনোভাবেই সিনেমাতে তার কোনো ছাপ পড়া যাবে না। ব্যয় কমানোর জন্য, কোনো তারকা অভিনেতাকে নেননি তার সিনেমায়। ডিজিটাল ক্যামেরা কেনার সামর্থ্য ছিল না সেসময়, এমটিভির ক্যামেরাম্যানকে ম্যানেজ করে অবসর সময়ে তাদের ক্যামেরা দিয়ে শ্যুট করেন। সেট তৈরি করার পেছনে খরচ করার বদলে পুরো শহরকেই তার শ্যুটিং-স্পট বানিয়ে নিলেন, স্টুডিওর বদলে শ্যুট করতে শুরু করলেন বাস্তব জায়গায়।

‘পাঁচ’ সিনেমার পোস্টার; Image Source: cinestaan.com

বলা চলে এমন কোনো কৌশল বাদ দেননি, যা দ্বারা কম খরচে একটি বড় সিনেমা তৈরি করা সম্ভব হয়। অবশেষে নির্মিত হয় তার প্রথম সিনেমা ‘পাঁচ’ (Paanch)। বড় বাজেটের সিনেমার একটি গানের চেয়েও কম খরচে তিনি গোটা সিনেমা বানিয়ে ফেললেন। বছরের পর বছর ধরে এত সংগ্রামের পর এবার তিনি তার প্রথম কাজ নিয়ে হাজির। তিনি দুনিয়াকে দেখাতে চাইলেন, বলিউডেও এমন সিনেমা বানানো সম্ভব।

কিন্তু সিনেমাটিকে ছাড়পত্র দিতে রাজি হলো না সেন্সর বোর্ড। ভারতীয় সংবিধানে সিনেমাকে বলা হয় ‘স্বা‌স্থ্যকর বিনোদন’। কিন্তু তার সিনেমাটি না ছিল বিনোদনমূলক, না ছিল ‘স্বা‌স্থ্যকর’। তাই ছাড়পত্র দিতে রাজি হয়নি তারা। সে সিনেমাটি এখনো পর্যন্ত মুক্তি পায়নি। প্রচন্ড হতাশ হয়ে পড়েছিলেন তিনি, কিন্তু থেমে যাননি। তার নতুন সিনেমা ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’ নিয়ে কাজ শুরু করলেন। মুম্বাই বিস্ফোরণের উপর ভিত্তি করে এ সিনেমার গল্প।

এ সিনেমায় তিনি কল্পনার আশ্রয় নেননি। সিনেমায় সত্য ঘটনাগুলোকেই পুনরায় ধারণ করেছেন, ব্যবহার করেছেন এর সাথে জড়িতদের সত্যিকার নামও। ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’ সিনেমাটিকে এখন পর্যন্ত তার সেরা সিনেমা বলা হয়। কিন্তু ঝামেলা তার পিছু ছাড়েনি। ভারতীয় কোর্টে এটি নিষিদ্ধ হলো। সিনেমাটি মুক্তি না পেলেও এর পাইরেটেড সিডি ছড়িয়ে পড়ল। এর দুই বছর পর অবশ্য সিনেমাটি পুনরায় মুক্তি পায়। মুক্তি পাওয়ার সে গল্পটিও বেশ চমকপ্রদ।

‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’ সিনেমার পোস্টার; Image Source: cinestaan.com

একবার ভারতীয় কোর্টের একজন বিচারক, পাইরেটেড সিডিতে দুবাইতে বসে সিনেমাটি দেখলেন। জানতে পারলেন, সিনেমাটি তার দেশেরই, কিন্তু দেশে মুক্তি পায়নি। তিনি ফিরে এসে সেই মামলা পুনরায় চালু করলেন। অবশেষে ২০০৭ সালে এসে বড় পর্দায় মুক্তি পায় ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’। সিনেমা নির্মাণের সফরে প্রায় সাত বছর পর অনুরাগ কাশ্যপের সিনেমা বড় পর্দায় মুক্তি পেল। এ সাত বছর তার জন্য বড্ড বেশি দুঃসহ হয়ে উঠছিলো। বিবাহ বিচ্ছেদ হলো, অ্যালকোহলে আসক্ত হয়ে পড়লেন তিনি। তার ব্যক্তিগত জীবন এলোমেলো হয়ে গেলো প্রায়।

এতকিছুর পর যদিও ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’ মুক্তি পেল, কিন্তু ততদিনে সবাই সিনেমাটি দেখে ফেলেছেন। ঘরে ঘরে এ সিনেমার পাইরেটেড ডিস্ক মজুদ আছে। হলে এসে তেমন কেউ এ সিনেমা দেখার আগ্রহ পেল না। সিনেমাটি ব্যবসাসফল হতে পারেনি। অনুরাগ কাশ্যপের পরবর্তী সিনেমা ছিল ‘নো স্মোকিং’। পরাবাস্তব গল্পের এ সিনেমাটি বিদেশে অনেক অ্যাওয়ার্ড পেলেও, ভারতে তেমন কেউ বুঝতেই পারেনি। ব্যবসায়িক দিক থেকে আরেকটি ব্যর্থ সিনেমা।

‘নো স্মোকিং’ সিনেমার পোস্টার; Image Source: glamsham.com

এতকিছুর পরও অনুরাগ কাশ্যপ থেমে থাকেননি। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে না পেরে সিস্টেমকে বা অন্য কাউকে দোষারোপ করে লাভ নেই। কারো দায় পড়েনি তার নিজের স্বপ্নগুলো পূরণ করে দেয়ার। নিজের স্বপ্ন সফল করতে হলে নিজেকেই দায়িত্ব নিতে হবে, সংগ্রাম করতে হবে। তিনি তা করেছেন এবং সময়ের সাথে সাথে পরিস্থিতি বদলে গেছে। তার পরবর্তী সিনেমার অনেকগুলোই সফলতার মুখ দেখেছে। নিজেকে লেখক, পরিচালক প্রযোজক হিসেবে তিনি প্রতিষ্ঠিত করেছেন বলিউডে।

অনুরাগ কাশ্যপ নির্মাণ করেছেন ‘আগলি’, ‘দেব ডি’, ‘গুলাল’, ‘গ্যাংস অফ ওয়াসিপুর’, ‘রমন রাঘব ২’ এর মতো অসাধারণ সব সিনেমা। দর্শকের হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়ার জন্য সিনেমা নির্মাণ করেন না তিনি, বরং দর্শকের হৃদয়কে আঘাত করেন, তীব্র অস্বস্তিতে ভোগান। মানুষের, সমাজের অন্ধকার দিকগুলো উঠে আসে তার ক্যামেরায়। বর্তমানে বলিউডের অন্যতম সেরা পরিচালক হিসেবে প্রথমদিকেই আসে তার নাম। তারচেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো তিনি নিজের স্বপ্নের স্বার্থক রূপায়ন করেছেন, স্ব‌প্নবাজদের জন্য হয়ে উঠেছেন অনুকরণীয় এক দৃষ্টান্ত।

This article is in Bangla language. It's about bollywood film director anurag kashyap.

References:

For references check hyperlinks inside the article.

Featured Image: freepressjournal.in

Related Articles