পূর্বে প্রকাশিত একটি লেখায় উঠে এসেছিল চীন প্রযুক্তি খাতে ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রকেও হার মানাতে যাচ্ছে। সেখানে বলা হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রকে ধরে ফেলার জন্য যেভাবে চীন এগিয়ে যাচ্ছে তাতে প্রযুক্তিখাতে যুক্তরাষ্ট্রের একক আধিপত্য এবং ঔদ্ধত্যের শেষের শুরু হতে বেশি সময় বাকি নেই। কথাটি বাস্তব। কারণ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন দেশ হিসেবে গড়ে উঠার জন্য চীন এই খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, পুরো বিশ্বের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কেন্দ্রীয় বাজার যেন তাদের দেশে হতে পারে সে দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে চীন।
তাদের লক্ষ্য হলো ভবিষ্যতে পৃথিবীতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে যে যে কাজ হবে এবং একে ভিত্তি করে যে ধরনের প্রযুক্তিগত পণ্য তৈরি হবে তার মানদণ্ড তৈরি হবে চীন থেকে। যেমনটি এখন যুক্তরাষ্ট্রের হার্ডওয়ার বাজারের ক্ষেত্রে দেখা যায়। এরকমটি ভাবার কারণ হচ্ছে এটা করতে পারলে তাদের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের হার বেড়ে যাবে যা দেশের উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত দরকারি। এছাড়া এরকমও বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র যেমন ইন্টারনেট তৈরি ও ব্যবহারের কিছু নিয়মকানুন ও মানদণ্ড বেঁধে দিয়েছে যেটা পৃথিবীর অন্য সবাইকে মেনে চলতে হয়, এরকম কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জগতেও চীনের প্রভাবকে তাদের সরকার বজায় রাখতে চায়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সরকারি কর্মকর্তা এবং শিল্প ব্যবসায়ীরা গত নভেম্বর মাসে চীনের বেইজিংয়ে একত্রিত হয়েছিলেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নীতিমালা নিয়ে আলোচনা করার জন্য। একত্রিত হওয়ার উদ্দেশ্য ছিল দেশে এবং দেশের বাইরে কীভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা শিল্পের বাজার তৈরি করা যাবে তা নিয়ে আলোচনা করা এবং এই ক্ষেত্রে বাইরের দেশের জন্য কারিগরি মানদণ্ড তৈরির প্রস্তাবনা দেয়া। এছাড়া কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ফলে দেশে এবং সমাজে কোন ধরনের পরিবর্তন সংঘটিত হতে পারে সেগুলোও সেখানে আলোচনার প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল।
চীনের গবেষকদের AI (Artificial Intelligence) নিয়ে মতামত সে দেশের সরকারি পর্যায়ে গৃহীত হয়েছে এবং তারা প্রত্যেকে ভবিষ্যৎ বাজারে টিকে থাকার জন্য এখন থেকেই শিল্প-বাণিজ্য এবং বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে কৃত্রিম-বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগের স্বপক্ষে মতামত দিয়েছে। এছাড়া তাদের লক্ষ্য থাকবে তাদের দেশে তৈরি হওয়া এই শিল্প যেন পৃথিবীর বাকি সব রাষ্ট্র ব্যবহার করতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, চীন যদি তাদের এই প্রস্তাবনা বাস্তবায়ন করে ফেলতে পারে তাহলে প্রযুক্তি বাজারে এশিয়ার আধিপত্য বিস্তার সময়ের ব্যাপার মাত্র। কারণ ইতোমধ্যে আলিবাবা এবং টেনসেন্ট যথাক্রমে আমাজন এবং ফেসবুককে টক্কর দিচ্ছে।
চীন এককভাবে AI শিল্পে যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে এবং তাদের সরকার যেভাবে এর উপর বিনিয়োগ করছে তা যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য উন্নত রাষ্ট্রগুলোর জন্য মাথাব্যথার কারণ। চীনের জনসংখ্যা এবং কর্মক্ষম জনশক্তি অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় বেশি হওয়ার কারণে তাদের যেকোনো বাজার তৈরি করতে এবং সেগুলোর যোগান দিতে বেশি বেগ পেতে হয় না। বিশেষ করে সঠিক দিকনির্দেশনা পেলে তারা যেকোনো কাজ করতে পারে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রেও সকল দিক দিয়ে যে সমর্থন তারা পাচ্ছে তাতে এই খাতে তাদের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াবে।
চীন এবং যুক্তরাষ্ট্র উভয় দেশের অর্থনীতি এআই শিল্পের ফলে ফুলে ফেঁপে উঠবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে একটি সমস্যার দেখা দিতে পারে। দুই দেশের মধ্যেকার প্রতিদ্বন্দ্বিতা। ষাটের দশকে যেটা দেখা গিয়েছিল রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে। কোন দেশ কত দ্রুত এবং কত কম খরচে গ্রাহকদের কাছে পৌঁছাতে পারবে এবং কাদের বাজার জনগণের উপর কিংবা ব্যবসায়ী কিংবা সাধারণ গ্রাহকদের উপর প্রভাব ফেলবে– এই জায়গাতেই দুই দেশের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা শুরু হবে।
গত বছরের নভেম্বর মাসে চীনে যে সভাটি হয় সেখানে উপস্থিত ছিল আলিবাবা, টেনসেন্ট, সিনোভেশন ভেঞ্চার, অ্যান্ট ফিনানশিয়াল নামক চীনের সব জায়ান্ট টেক কোম্পানি যারা সফলভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার করছে। এছাড়া সেখানে উপস্থিত ছিল চায়না একাডেমি অব ইনফরমেশন থেকে আসা কিছু গবেষক। সেখানে যে যে বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছিল সেগুলো হলো–
১) ন্যাশনাল এআই প্ল্যান– ঠিক সেরকম, যেরকমটি যুক্তরাষ্ট্রে ওবামা প্রশাসন তৈরি করেছিলো,
২) কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে বাস্তবে মানব উন্নয়নে এবং মানব সাহায্যে ব্যবহার করা,
৩) এ বিষয়ে গবেষণার ক্ষেত্র আরো কি কি হতে পারে সেই বিষয়ে আলোচনা এবং আরও উন্নত গবেষণার ক্ষেত্র তৈরি করা,
৪) কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে স্ব-নিয়ন্ত্রিত অস্ত্র যা সামরিক বাহিনীতে ব্যবহার করা যেতে পারে,
৫) ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তার ব্যাপার ইত্যাদি।
এই সভাতে ব্যক্তিগত তথ্যের বিষয়ে আলোচনাটি গুরুত্বের সাথে করা হয়। কারণ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার একটি অংশ হচ্ছে তথ্য এবং উপাত্ত নিয়ে সে তথ্য যাচাই করা। তারপর সে তথ্যের উপর ভিত্তি করে একটি নকশা দাঁড় করানো এবং নতুন কিছু বের করে আনা যেটা বাস্তবে ব্যবহার করা হবে। অনেক সময় ব্যক্তিগত তথ্য-উপাত্ত নিয়ে বিশ্লেষণ করে দেখা হয় যে ব্যবহারকারীর পছন্দের জিনিস কী কী, তারা কোথায় যাওয়া আসা বেশি করে, ইন্টারনেটে কোন কোন জিনিসের প্রতি তার আকর্ষণ বেশি ইত্যাদি। এই কাজগুলো কিন্তু গুগল, ফেসবুক, আমাজন ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানও করে।
আমরা যখন কোনো বিষয়ের উপর বেশি বেশি করে খুঁজতে থাকি (সার্চ বা অন্যান্য কর্মকাণ্ড) তখন কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠান আমাদের সেই তথ্য বিশ্লেষণ করে ওই বিষয়ের উপর অন্যান্য ফলাফল আমাদের সামনে এনে ফেলে। এটা কিন্তু ব্যক্তিগত তথ্যের উপর ভিত্তি করেই হয়। চীনের এই সভাতেও এই বিষয়ে বিস্তর আলোচনা হয় এবং এখানে ২০১৬ সালে National People’s Congress এই বিষয়ে যে আইন প্রণয়ন করে সেই আইন মেনে কাজ করার নির্দেশ দেয়া হয়। তাছাড়া এখানে আরেকটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয় যে, প্রযুক্তি নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যক্তিগত তথ্য হিসেবে ব্যবহারকারীর ছবি সংরক্ষণ করবে যেন পরবর্তীতে যেকোনো রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার খাতিরে কোনো ব্যক্তিকে যেন নজরদারির ভেতর আনা যায়।
সবচেয়ে বেশি আলোচনার বিষয় হচ্ছে চীন তাদের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই বাজারের প্রায় সবকিছুই নিজেরা তৈরি করবে দেশীয় জনশক্তি ব্যবহার করে। সেটা হার্ডওয়ার থেকে সফটওয়্যার এবং গবেষণা থেকে শুরু করে বাস্তবে ব্যবহার করা পর্যন্ত। এখানে আরেকটি ব্যাপার বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তাদের গবেষক, টেক কোম্পানি এবং নীতি নির্ধারকদের সম্মিলিত চিন্তার গভীরতা এবং প্রসারতা দেখলে সত্যি অবাক হতে হয় যে একটি আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নির্ভর দেশ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য কীরকম উঠে পড়ে লেগেছে তারা। গবেষকদের কথা আলাদাভাবে যদি বলি তাহলে বলতে হয়, প্রতি বছর চীন থেকে এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ সব গবেষণাপত্র (রিসার্চ পেপার) বের হচ্ছে যেগুলো বিশ্বের অন্যান্য দেশকে জানান দিচ্ছে যে চীনেই পরবর্তী টেক বুম তৈরি হতে যাচ্ছে।
ফিচার ইমেজ- investors business daily