এইচ জি ওয়েলসের লেখা “ওয়ার অফ দ্য ওয়ার্ল্ডস” উপন্যাসখানা পড়েছেন কি? অন্য আরেকটি গ্রহ থেকে আসা আমাদের পৃথিবীকে আক্রমণকারী এক প্রজাতির সাথে যুদ্ধ করার পটভূমিতে এই উপন্যাস লেখা হয়েছিল, যেখানে শেষ পর্যন্ত অন্য গ্রহ থেকে আগত জীবেরা পরাজিত হয়েছিল। না, কোনো সুঠামদেহী, পেশীশক্তির অধিকারী সুপারম্যান কিংবা ব্যাটম্যানের জন্য নয়। তারা পরাজিত হয়েছিল ব্যাকটেরিয়া নামের এক ক্ষুদ্র অণুজীবের কাছে। আর আজকে, এইচ জি ওয়েলসের এই অসাধারণ সায়েন্স ফিকশনটি ছাপা হবার প্রায় ১২০ বছর পরে এসে বিজ্ঞানীরা আমাদেরকে জানাচ্ছেন, সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি খুব শীঘ্রই হতে চলেছে। তবে তার শিকার গল্প কিংবা উপন্যাসের পাতায় অন্য গ্রহ থেকে আসা এলিয়েন নয়। বাস্তবেই এবার এই ঘটনায় আক্রান্ত হতে চলেছে মানবসভ্যতা। মানবসভ্যতার জন্য হুমকিস্বরূপ এই প্রবল ক্ষমতা সম্পন্ন ব্যাকটেরিয়াগুলোই হচ্ছে সুপারবাগ।
সুপারবাগ হলো সেসব ব্যাকটেরিয়া, যেগুলো পারিপার্শ্বিক প্রতিকূলতার সাথে যুঝতে নিজেদেরকে এমনভাবে পরিবর্তিত করে ফেলে, যাতে তারা যেসব এন্টিবায়োটিকের প্রয়োগে মারা যেত, সেসব এন্টিবায়োটিক তাদের আর কোনো ক্ষতি করতে পারে না। তাই সুপারবাগের আক্রমণে কোনো মানুষ আক্রান্ত হলে তাদের সুস্থ করার জন্য চিকিৎসকদের হাতেও প্রয়োগ করবার মতো আর কোনো ওষুধ থাকে না।
সারাবিশ্বে বর্তমানে এই সুপারবাগ মানুষের জন্য হয়ে উঠেছে এক প্রবল আতঙ্কের বিষয়। জানা যায়, অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে বড়সড় মহামারীর সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে সারা বিশ্বের অগণিত মানুষ। দ্য অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ওইসিডি) এ সম্পর্কে ইতিমধ্যেই সতর্কতা জারি করেছে। তাদের তথ্যানুসারে, অধিকাংশ অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধই বিশেষ এই ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ ঠেকাতে ব্যর্থ হচ্ছে। সম্প্রতি প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে ওইসিডি জানিয়েছে, ২০১৫ সালে ইউরোপের ৩৩ হাজারেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয় অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী এই ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে। প্রতিবেদনে আশঙ্কা করা হয়েছে, ২০৫০ সালের মধ্যে ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়া মিলিয়ে প্রায় ২৪ লাখ মানুষের মৃত্যু হতে পারে এই ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে। এর মধ্যে ১৩ লাখ ইউরোপে, যার মধ্যে অন্তত ৯০ হাজার ব্রিটিশ নাগরিক।
অ্যান্টিবায়োটিকের এই ব্যর্থতার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখা গেছে, ইদানীং অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলেই এই ব্যাকটেরিয়ার (সুপারবাগ) সংক্রমণ ঠেকাতে অধিকাংশ ওষুধই ব্যর্থ হচ্ছে। জানা গিয়েছে, ইন্দোনেশিয়া, ব্রাজিল এবং রাশিয়ার ব্যাকটেরিয়াঘটিত সংক্রমণের ৬০ শতাংশই অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী। ওইসিডির মুখোপাত্র মিশেল সেচিনি এই প্রসঙ্গে মন্তব্য করেন,
“পরিস্থিতি যেদিকে এগোচ্ছে, তাতে ২০৩০ সালের মধ্যে এই ব্যাকটেরিয়ার প্রকোপ বা সংক্রমণ চার থেকে সাতগুণ বৃদ্ধি পেতে পারে। শুধু তা-ই নয়, ছোটখাট কেটে-ছড়ে যাওয়া, ছোট অস্ত্রোপচার বা নিউমোনিয়ার মতো সাধারণ রোগও প্রাণঘাতী হয়ে দাঁড়াতে পারে! এই সুপারবাগের আক্রমণে শিশু ও বয়স্কদের মৃত্যুর আশঙ্কা বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে।”
তবে এরকম ভয়াবহ আতঙ্কের মুখেও আশার আলো দেখিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। এই আশার আলো হলো ফেজ থেরাপি। ফেজ থেরাপি সম্পর্কে অবশ্য অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কারের আগেও বিজ্ঞানীরা জানতেন। যেহেতু অ্যান্টিবায়োটিকের প্রচলনের আগেও বিভিন্ন ব্যাক্টেরিয়াঘটিত সংক্রমণে মানুষজন আক্রান্ত হতেন, তাই সংক্রমণকারী ব্যাকটেরিয়াকে মেরে ফেলতে চিকিৎসকেরা শরণাপন্ন হতেন ব্যাক্টেরিওফেজের।
ব্যাক্টেরিওফেজ হলো একধরনের ভাইরাস, যারা ব্যাকটেরিয়াকে খেয়ে ফেলে। এই ব্যাক্টেরিওফেজ বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। তাই যে ব্যাকটেরিয়াগুলো মানুষের দেহকে আক্রমণ করতো, সেই ব্যাকটেরিয়াগুলোকে হত্যা করবার জন্য এই ফেজ ভাইরাসকে প্রবেশ করানো হতো। সংক্রমণকারী ব্যাকটেরিয়াকে হত্যা করবার জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণে এই ব্যাক্টেরিওফেজ প্রবেশ করানোর প্রক্রিয়াকে বলা হয় ফেজ থেরাপি।
গাঠনিক দিক থেকে এই ভাইরাস খুবই সরল। বাইরের দিকে এদের একটি প্রোটিনের তৈরি আবরণ থাকে, যাকে বলা হয় ক্যাপসিড। আর অভ্যন্তরে থাকে বংশগতি রক্ষার জন্য নিউক্লিক এসিড (ডিএনএ বা আরএনএ)।
ডিএনএ ব্যাক্টেরিওফেজ ভাইরাস প্রথমে ব্যাকটেরিয়ার কোষস্তর ছিদ্র করে সেখানে নিজের ডিএনএ প্রবেশ করায়। এরপর ভাইরাসের ডিএনএ ব্যাকটেরিয়ার অভ্যন্তরে থাকা ডিএনএ-কে ধ্বংস করে ধীরে ধীরে পুরো ব্যাকটেরিয়ার ডিএনএ-কে অধিকার করে বসে। তারপর ব্যাকটেরিয়ার কোষের ভেতরে অনুলিপির মাধ্যমে অসংখ্য নতুন ভাইরাসের ডিএনএ তৈরি হয়। পাশাপাশি তৈরি হতে থাকে ভাইরাসের প্রোটিন খোলস। এরপর একটা সময় প্রোটিন খোলস আর ডিএনএগুলি একত্রিত হয়ে নতুন অসংখ্য ফেজ ভাইরাস রূপে ব্যাকটেরিয়ার কোষকে ভেঙে বের হয়ে আসে। ফলশ্রুতিতে ঐ ব্যাকটেরিয়াটির মৃত্যু হয়। মূলত এই কৌশল কাজে লাগিয়ে ফেজ থেরাপিতে ব্যবহৃত ভাইরাসগুলো অপকারী ব্যাকটেরিয়াগুলোকে মেরে ফেলতে পারে।
অ্যান্টিবায়োটিক বনাম ফেজ থেরাপি
সাধারণত অ্যান্টিবায়োটিক হলো একটি ব্রড স্পেকট্রাম ওষুধ (অর্থাৎ শুধুমাত্র সংক্রমণকারী ব্যাকটেরিয়া নয়, অ্যান্টিবায়োটিক আক্রমণ করে মানুষের শরীরে বসবাসকারী অন্যান্য উপকারী ব্যাক্টেরিয়াকেও)। অপরদিকে ফেজ থেরাপি কেবলমাত্র সংক্রমণকারী ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়াকেই আক্রমণ করে।
এন্টিবায়োটিক মূলত বিভিন্ন ধরনের অযাচিত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। গর্ভাবস্থায় অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ মা ও শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য নানা প্রেক্ষাপট থেকে হানিকর বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেছেন। এদিক থেকে ফেজ থেরাপি অপেক্ষাকৃত নিরাপদ এবং কম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার সম্ভাবনা ধারণ করে।
বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া, যেগুলোকে অন্যান্য শক্তিশালী অ্যান্টিবায়োটিক হত্যা করতে অক্ষম, সেগুলোও ফেজ মেরে ফেলতে পারে। অ্যান্টিবায়োটিকের উৎপাদন অর্থনৈতিক দিক থেকে অপেক্ষাকৃত বেশি খরচের। কিন্তু ফেজ ভাইরাস প্রাকৃতিকভাবেই আমরা পেতে পারি। আর বিশুদ্ধিকরণের মাধ্যমে ফেজ থেরাপি প্রয়োগে অপেক্ষাকৃত কম খরচ হয়। ভূপৃষ্ঠে ব্যাকটেরিওফাজ পাওয়া যায় না এমন কোনো স্থান নেই। পৃথিবীতে রয়েছে সমস্ত ব্যাক্টেরিয়াসহ সমষ্টিগত সকল প্রাণীর সংখ্যার চেয়ে কয়েকশ গুণ বেশি ফাজ ভাইরাস।
বিভিন্ন সমুদ্রে থাকা ব্যাকটেরিয়াগুলোর শতকরা প্রায় চল্লিশ ভাগ প্রতিদিন নিহত হচ্ছে ব্যাকটেরিওফেজের হাতে। তবে ব্যাকটেরিয়া কেবল টিকে আছে তাদের অতি উচ্চ প্রজনন হারের জন্য। ফাজ আর ব্যাকটেরিয়ার এই শত্রুতা আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিয়েছে মানবজাতির জন্য। আর তাই সব দিক থেকেই ফেজ থেরাপি হয়ে উঠছে ব্যাকটেরিয়া মোকাবেলায় একটি কার্যকরী অস্ত্র।
ইদানীং জর্জিয়াসহ ইউরোপের বেশ কিছু দেশে বিভিন্ন সুপারবাগ সংক্রমণে ফেজ থেরাপি ব্যবহৃত হচ্ছে অত্যন্ত কার্যকরভাবে। বর্তমানে ফাজ থেরাপি প্রয়োগে সবচেয়ে বেশি খ্যাতি অর্জন করেছে জর্জিয়ার এলিয়াভা ইনস্টিটিউট। এই প্রতিস্থানটিকে ফেজ থেরাপির অগ্রদূত বলা যায়। তাছাড়া রাশিয়াতে কিছু প্রতিষ্ঠানসহ লন্ডনের কয়েকটি হাসপাতালে সুপারবাগ সংক্রমণে আক্রান্ত রোগীর উপর ফেজ থেরাপি প্রয়োগ করে শতভাগ সফলতা পাওয়া যায়।
বিজ্ঞানীরা তাই এখন চেয়ে আছেন ভবিষ্যতের দিকে। আমরাও তাই ব্যাকটেরিয়ার সাথে এই দ্বন্দ্বযুদ্ধে কতখানি কার্যকরভাবে ফেজ ভাইরাসকে ব্যবহার করে নতুন প্রজন্মকে একটি সুস্থ ও সুপারবাগবিহীন ভবিষ্যৎ উপহার দিতে পারি সেই আশায় দিন গুনছি।