আপনার পরিচিত কিছু প্রাণীর কথা বলুন তো? জিরাফ কিংবা পাণ্ডার মতো প্রাণীগুলো কি এই তালিকায় পড়ে? নিশ্চয়ই আপনি চেনেন এদেরকে। কিন্তু কতটুকু? আপনি কি জানেন যে, আপনি আজ যাকে পাণ্ডা বলে জানেন, জিরাফ নামে ডাকেন সেটি একটা সময় অন্য কোনো নামে পরিচিত ছিল? অবাক হচ্ছেন! হওয়ারই কথা। চলুন আজ আপনার পরিচিত সব প্রাণীদের অজানা এবং আসল নামগুলো জেনে অবাক হওয়া যাক আরো একটু বেশি!
পান্ডা
দুষ্টু, মিষ্টি দেখতে পাণ্ডাদের নিশ্চয়ই ভালো লাগে আপনার? কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, একটা সময় পান্ডা বলতে কেবল বোঝানো হতো লাল রঙয়ের পান্ডাদেরকে। বর্তমানে পান্ডা বলতেই যে সাদা-কালো রঙ মেশানো প্রাণীদের বুঝি আমরা, তখন সেরকমটা একেবারেই ছিল না। আর তাই তখন পান্ডাদের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘পার্টি-কালারড বিয়ার’। এদেরকে তখন ভাল্লুকের একটি প্রজাতি হিসেবে গোনা হতো। সাদা পান্ডাদের এই নামের পেছনে ছিল নেপালীদের হাত। ১৮৬৯ সালে প্রথম সাদা রঙয়ের পাণ্ডাদের দেখা পাওয়া যায়। তবে এদের পুরোপুরি নামকরণ করা হয় ১৯০১ সালে। বিংশ শতক আসতে আসতে বড় পাণ্ডাদের পরিচিতি সবখানে ছড়িয়ে পড়ে। তবুও কিছু ভুল তখনও হয়। ১৯২০ সালের একটি বিজ্ঞান পত্রিকায় বড় পান্ডাদের ছবি ছাপিয়ে তাকে নাম দেওয়া হয় ‘রেকুন বিয়ার’। তবে বর্তমানে এমন ভুল করার আর অবকাশ নেই। সাদা-কালো রঙয়ের মিশেলে পান্ডাকে এখন চেনে সবাই!
জিরাফ
জিরাফকে এখন জিরাফ নামেই চিনি আমরা সবাই। তবে একটা সময় কিন্তু জিরাফের নাম মোটেও এমন কিছু ছিল না। তখন জিরাফকে সবাই জানতো ক্যামেলেপার্ড নামে। কিন্তু ইন্টারনেটে ক্যামেলেপার্ড অর্থ এখনো জিরাফ দেখতে পাবেন। বর্তমান নাম পেতে জিরাফকে অপেক্ষা করতে হয়েছে ১৯ শতকের শেষ পর্যন্ত। ক্যামেলেপার্ড শব্দটি গ্রীক শব্দ ক্যামিলেপার্ডালিস থেকে এসেছে। ক্যামিলেপার্ডালিস এসেছে গ্রীক ক্যামেলোস (উট) এবং পারডালিস (চিতা) শব্দ থেকে। নামটি অবশ্য ভুল কিছু নয়।
চিতার শরীরের রঙয়ের খেলা আর উটের মতো উচ্চতা- সব মিলিয়ে জিরাফের মতো শারীরিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী কোনো প্রাণীকে এমন একটি নাম দেওয়া যেতেই পারে। জিরাফ নামটি প্রথম ব্যবহৃত হয় ১৬ শতকে। জিরাফ নামটির ইতিহাসও কিন্তু কম নয়। জিরাফ শব্দটি আসে ফ্রেঞ্চ ‘জিরাফে’ থেকে। জিরাফে শব্দটি এসেছিল আরবি ‘জারাফা’ থেকে। জারাফা শব্দটি আসে পার্সিয়ান ‘জারনাপা’ শব্দ থেকে। জারনাপা শব্দটিকে ভাঙলে ‘জার’ ও ‘নাপা’ নামক দুটো শব্দ পাওয়া যায়। জারনা অর্থ ‘বাঁশী’ আর পা অর্থ বাংলায় করলে দাঁড়ায় ‘পা’। তো, জিরাফের লম্বা পায়ের কথা মাথায় রেখেই এর নাম হয়ে যায় জিরাফ। তবে মানুষের মুখে নাম বদলে গেলেও বৈজ্ঞানিক নামে জিরাফ এখনো ‘জিরাফা ক্যামিলেপার্ডালিস’ নামেই পরিচিত।
ওয়ালরেস বা সিন্ধুঘোটক
বর্তমানে ‘ওয়ালরেস বা সিন্ধুঘোটক’ নামটি বেশ পরিচিত হলেও একটা সময় এই পরিচিত বোকা বোকা প্রাণীটির নাম ছিল ‘মোর্স’ কেবল তাই নয়, সামুদ্রিক গরু বা সমুদ্রের হাতি নামেও ডাকা হতো একে। আর সেটা যে প্রাণীটির দশাসই শরীরের জন্য তা বলার দরকার পড়ে না। যদিও বর্তমানে সীল মাছ ‘সামুদ্রিক গরু’র উপাধিটি প্রায় কেড়ে নিয়েছে ওয়ালরেসের কাছ থেকে। ওয়ালরেস নামটির উৎপত্তি কোথা থেকে সেটা ঠিক জানা যায়নি। ধারণা করা হয়, ওয়ালরেস এসেছে ডাচ ওয়ালরস থেকে, যেটি কিনা সেখানে এক প্রজাতির তিমিকে বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। তবে সত্যিই সিন্ধুঘোটকের নামের উৎপত্তি এমন কিনা তা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না।
লাল পান্ডা
অবশ্যই যখন পান্ডা নামে সাদা-কালো রঙয়ের কোনো প্রাণী এসে স্থান দখন করে নেবে, পান্ডা নামটিকে ছিনিয়ে নেবে, তখন তো কিছুদিন আগেও পান্ডা নামে পরিচিত ছিল এমন প্রাণীটির সমস্যা হবেই। নাম নিয়ে একটু ঝামেলা তো পোহাতেই হবে তখন তাকে, তাই না? লাল পান্ডার ক্ষেত্রেও এমনই কিছু একটা হয়েছিল। যেমনটা প্রথমে বলেছি, হুট করে সাদা-কালো বড় পান্ডারা ‘পাণ্ডা’ নামে স্বীকৃতি পেয়ে যায়। ফলে লাল রঙয়ের পান্ডারা পড়ে যায় বিপত্তিতে। মনে করা হয়, লাল পাণ্ডাদের নাম দিয়েছিল নেপালীরা। পাণ্ডা নামটি এসেছিল নিগোল পোনিয়া থেকে। যার অর্থ দাঁড়ায় ‘যারা বাঁশ খায়’। সাদা-কালো পান্ডারা চলে এলে লাল পান্ডারা নিজেদের নাম হারিয়ে ফেলে। তখন তাদের নাম ‘ওয়াহ’ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। কারণ ছিল এই যে, লাল পান্ডারা ডাকার সময় ওয়াহ ঘরানার একটি শব্দ করে। তবে সেই সিদ্ধান্ত বলবৎ হওয়ার আগেই লাল পাণ্ডাদের নাম ‘রেড পান্ডা’ বা লাল পান্ডা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হয়।
খরগোশ
একটা সময় এই খরগোশদের নাম ছিল ‘কোনি’। কী ভাবছেন? তাহলে কখন সেখান থেকে নাম বদলে নিজেদের বর্তমান নামে পরিচিত হলO এই ছোট্ট লোমশ প্রাণীরা? তখন র্যাবিট অর্থও ছিল খরগোশ। তাদের বাচ্চারা পরিচিত ছিল কোনি নামে। তবে ১৯ শতকে র্যাবিট নামটি কোনিকে টেক্কা দিয়ে সামনে এগিয়ে যায়। বড় এবং ছোট সব খরগোশকেই র্যাবিট নামে ডাকা হয় এরপর থেকে। কোনি শব্দটি একেবারে অন্য এক অর্থ নিয়ে ফেলে ইংরেজি ভাষায়। মনে করা হয়, দ্বীপে অনেক বেশি খরগোশ ছিল বিধায় ওলন্দাজরা কোনি দ্বীপের নামকরণ এমনটা করেছিল।
গুয়েনা ফাউল
টার্কি খেতে কেমন লাগে আপনার? নিশ্চয়ই চমৎকার। গুয়েনা ফাউলও কিন্তু খেতে দারুণ। তবে দেখতেও তারা অনেকটা টার্কির মতো। গুয়েনা ফাউল প্রথম আসে আফ্রিকা থেকে। ইউরোপীয়ানদের বেশ ভালো লাগে গুয়েনা ফাউলকে। সেখানে বেশ পরিচিত হয়ে যায় এরা। টার্কি থেকে আগত মনে করে টার্কি মুরগী বলে ডাকতো তারা পাখীটিকে। পরবর্তীতে ইউরোপিয়ানরা আমেরিকায় গেলে সেখানে এই দুটো পাখীকে মিলিয়ে ফেলা হয়। গুয়েনা ফাউলকে টার্কি বলে ডাকাটা ছিল ভুল। আর সেই ভুলকেই চালিয়ে যায় সবাই। পরবর্তীতে অবশ্য এই ভুল ঠিক করে নেওয়া হয়। আমেরিকার টার্কি এবং ইউরোপের গুয়েনা ফাউল (টার্কি) নিজেদের আসল নাম ফিরে পায়।
প্লাটিপাস
হাঁসের মতো বিশাল এক ঠোঁটের অধিকারী প্লাটিপাসেরা পানিতে থাকতেই বেশি ভালোবাসে। হাঁসের ঠোঁটের সাথে সাদৃশ্য থাকার কারণেই প্লাটিপাসকে একটা সময় ‘ডাক মোল’ নামে ডাকা শুরু হয়। ডাক মোল বা ওয়াটার মোল- যে নামেই ডাকা হোক না কেন, এর পেছনে কারণ ছিল একটিই। আর সেটি হলো মানুষের ভেতরে বিশ্বাস যে, ছুঁচোর সাথে কোনো না কোনোভাবে সংযোগ আছে প্লাটিপাসের। ১৭৯৯ সালে প্লাটিপাসকে খুঁজে পাওয়া গেলে পুরো পৃথিবী অবাক হয়ে যায় অদ্ভুত রকমের এই প্রাণীটিকে দেখে। থাবা এবং পা-ও আছে প্লাটিপাসের। ফলে প্লাটিপাস কোনো স্তন্যপায়ী প্রাণী, পাখী, সরীসৃপ নাকি অন্যকিছু সেটা নিয়ে সবায় দ্বিধায় পড়ে যায়। পরবর্তীতে একে স্তন্যপায়ী হিসেবে জানা যায় আর নামকরণ করা হয় প্লাটিপাস।
ফিচার ইমেজ : Love Rabbits