পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অদ্ভুত সব দ্বীপ। এসব দ্বীপের কোনোটির সাথে জড়িয়ে রয়েছে প্রকৃতি প্রদত্ত রহস্যময়তা, আবার কোনোটির সাথে মিশে আছে ইতিহাসের নানা ঘটনা। কোনো দ্বীপ প্রসিদ্ধ হয়ে আছে গুপ্তধন ও প্রাকৃতিক সম্পদের কারণে, আবার কোনোটা বিখ্যাত হয়ে আছে নৈসর্গিক সৌন্দর্যের কারণে। মাঝে মাঝে কিছু দ্বীপ পাওয়া যায় যেগুলো বেশ অদ্ভুত ধরনের। এরকম কিছু অদ্ভুত দ্বীপ সম্বন্ধে আলোকপাত করা হবে এখানে।
১. বিশপ রক
যুক্তরাজ্যের উপকূলে অবস্থিত বিশপ রক দ্বীপটি পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম দ্বীপ হিসেবে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। দ্বীপের মাঝখানে উঁকি দিয়ে আছে বিশাল এক লাইট হাউস। ১৮৫৮ সালে এই লাইট হাউসটি তৈরি করা হয়। অবাক করা বিষয় হচ্ছে, মাঝে-মাঝে প্রবল সামুদ্রিক ঝড়ে উপকূলবর্তী অঞ্চলসমূহের ব্যাপক ক্ষতি হলেও আজও এই দ্বীপ ও লাইট হাউসটির তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি।
২. স্পার্টলি দ্বীপ
দক্ষিণ চীনে প্রায় ১০০টি প্রবাল দ্বীপ নিয়ে তৈরি হয়েছে স্পার্টলি দ্বীপ। একধরনের সামুদ্রিক প্রাণী পলিপ-এর কারণে এই প্রবাল দ্বীপের সৃষ্টি। মেরিন পলিপ নিজেদের রক্ষা করতে নিজেদের শরীরের চারপাশে চুনাপাথরের আস্তরণ তৈরি করে থাকে। সেই আস্তরণের উপর আরো একটি আস্তরণ তৈরি করে নেয়। মারা গেলে পরে পলিপগুলো ওই চুনাপাথরের দেয়ালের মধ্যেই থেকে যায়। এরকম চুনাপাথর জমতে জমতেই তৈরি হয়েছে স্পার্টলি দ্বীপ। প্রবালের সৌন্দর্য দেখার জন্য প্রতিবছর প্রচুর মানুষ এই দ্বীপে আসেন।
৩. পামিরা দ্বীপ
খ্রিস্টপূর্ব ১৭০০ অব্দে এ দ্বীপটি আবিষ্কৃত হয়। উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত এ দ্বীপটি গুপ্তধনের কারণে বিখ্যাত হয়ে আছে। অনেকে মনে করতো এই দ্বীপে গুপ্তধন রয়েছে। একসময় এখানকার মাটি খুঁড়ে অনেক ধনসম্পত্তি পাওয়া গেছে বলেও প্রচার আছে। গুপ্তধন অনুসন্ধানকারীরা মনে করতো, জলদস্যুরা এই দ্বীপটিতে বিভিন্ন জাহাজ থেকে লুট করা সোনা-গয়না, ধনসম্পত্তি লুকিয়ে রাখতো।
দ্বীপটিতে বেশ কয়েক বছর আগে সন্দেহজনক কিছু মৃতদেহের সন্ধান পাওয়া যায়। তা থেকে ধারণা করা হয়, পরিবারসহ বেশ কয়েকজন লোক দ্বীপটিতে ঘুরতে আসে। কিন্তু তারা ফিরেনি কিংবা ফিরতে পারেনি। কিছুদিন বাদে তাদের মৃতদেহ পাওয়া যায়। তাই আমেরিকান সরকার এই দ্বীপে যাওয়া নিষেধ করে দিয়েছে।
৪. সিসিলি
ইতালির অন্তর্ভুক্ত ভূমধ্যসাগরের সবচেয়ে বড় দ্বীপ সিসিলি। এটি খুবই আকর্ষণীয়। নীলাভ জলরাশি, নরম বালুর সৈকত ও দ্বীপের মনোরম পরিবেশ পৃথিবী বিখ্যাত। দ্বীপের অন্যতম আকর্ষণ হলো আগ্নেয়গিরি মাউন্ট এটনা। ভূ-পৃষ্ঠ থেকে ৩ হাজার ৩৫০ মিটার উঁচুতে অবস্থিত এই আগ্নেয়গিরিটি ইউরোপে সর্বোচ্চ। মাউন্ট এটনা পৃথিবীর সক্রিয় আগ্নেয়গিরিগুলোর একটি।
৫. ক্যাপ্রি
প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর, প্রাচুর্যময় পরিবেশ আর হালকা জলবায়ুর অসাধারণ একটি দ্বীপ ক্যাপ্রি। দ্বীপটি ইতালির নাপোলি শহরের দক্ষিণে অবস্থিত। পৃথিবীর নামকরা সব লেখক, শিল্পী, বুদ্ধিজীবী এই দ্বীপের অপার সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়েছেন। তাদের বিভিন্ন লেখায় ফুটে উঠেছে এই দ্বীপের অপার্থিব সৌন্দর্য।
৬. এলসমেয়ার দ্বীপ
সম্পূর্ণ বরফের এক দ্বীপ এলসমেয়ার। গ্রিনল্যান্ডের পশ্চিমে কানাডার আর্কটিক আর্কিপেলাগোর উপর অবস্থিত এটি। দ্বীপটি ৭৫ হাজার ৭৬৭ বর্গ মাইল এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। সারা বছরই বরফে ঢাকা থাকে। এখানেই আবিষ্কৃত হয়েছিল ৩৫৭ মিলিয়ন বছরের পুরনো এক জীবাশ্ম যা প্রাণীজগতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি আবিষ্কার। একে ঘিরে রয়েছে আর্কটিক কর্ডিলার পর্বতমালা। সমস্ত দ্বীপে হাতে গোনা মাত্র ১৫০ জন মানুষ বসবাস করে।
৭. হাসিমা দ্বীপ
জাপানের নাগাসাকি থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এ দ্বীপ। জাপানিরা দ্বীপটিকে ডাকে ‘গুনকানজিমা’ নামে। এর অর্থ ব্যাটলশিপ। এটি প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর। ১৭৭৪ সালে এখানে একটি কয়লা খনি আবিষ্কৃত হয়। খনি পাওয়া গেলে জাপান সরকার দ্বীপটিকে অধিকার করে নেয়। সরকারের উদ্যোগে শুরু হয় খনি খননের কাজ। একসময় প্রায় ৫ হাজার পরিবার বাস করতো দ্বীপটিতে।
দ্বীপের চারপাশে বড় বড় অট্টালিকা এমনভাবে নির্মাণ করা হয়েছিল দূর থেকে দেখলে মনে হতো এখানে নোঙর করে আছে বড় এক যুদ্ধ জাহাজ। কিন্তু বেশ কয়েক বছর ধরে কয়লা তোলার পর একসময় কয়লা ফুরিয়ে আসতে থাকে। কয়লা উত্তোলন ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায়। দ্বীপে থাকা লোকগুলো কর্মহীন হয়ে পড়ে। একে একে সকলে এই দ্বীপ ছেড়ে চলে যায়। তারপর নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও সামুদ্রিক ঝড়ে দ্বীপটি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে। তবে দ্বীপের সেই অট্টালিকাগুলো এখনো ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে।
৮. সিশ্যালস
আফ্রিকা মহাদেশের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত ১৫৫টি দ্বীপ নিয়ে গঠিত দ্বীপ রাষ্ট্র সিশ্যালস। ভারত মহাসাগরের এই দ্বীপমালায় এখনো এমন কিছু জায়গা রয়েছে যেখানে কোনো জনবসতি তো নেই-ই, এমনকি কোনো মানুষের পা পর্যন্ত পড়েনি। এক অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভুমি এই দ্বীপ। যেন সৃষ্টির অপরূপ মায়াময় এক নিসর্গ। সিশ্যালস ভ্রমণ মানেই নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার মতো প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করা। ১৭৭ বর্গ মাইলের এই ভূ-খণ্ডে ইউনেস্কো স্বীকৃত ২টি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট রয়েছে।
৯. লিলিপ্যাড সিটি
আটলান্টিক মহাসাগরে ‘লিলিপ্যাড সিটি’ হলো কৃত্রিম ভাসমান দ্বীপ। পৃথিবীর আবহাওয়া দিন-দিন বদলাচ্ছে। সমুদ্রে জলের স্তরও বাড়ছে। পুরো পৃথিবী যদি জলমগ্ন হয়ে যায়, তাহলে কেমন হবে জীবন? তার বাস্তবতা অনুধাবন করতে বিজ্ঞানীরা তাদের গবেষণার স্বার্থে এই ভাসমান দ্বীপটি বানিয়েছেন।
এখানে প্রায় ৫০ হাজার মানুষের থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। এর মাঝে কৃত্রিম লেগুনও তৈরি করা হয়েছে। লেগুনে বৃষ্টির পানি জমা হয় এবং স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে তা পরিশোধিত হয়।
১০. সার্ক আইল্যান্ড
বিশ্বের তারকাখচিত এক দ্বীপ সার্ক আইল্যান্ড। ফ্রান্সের নরম্যান্ডি উপকূল থেকে মাত্র ২৫ মাইল পশ্চিমে এবং লন্ডনের দক্ষিণ উপকূল থেকে মাত্র ৮০ মাইল দূরে অবস্থিত দ্বীপটি। দ্বীপের মোট আয়তন ৫.৪৫ বর্গ কিলোমিটার। প্রায় একশো বছর আগেও দ্বীপটি রোমানদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। বর্তমানে যুক্তরাজ্য বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের অংশ না হয়ে এটি ইউরোপের সবচেয়ে ছোট সামন্ত রাষ্ট্র হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। দ্বীপের জনসংখ্যা ছয়শরও কম।
দ্বীপের আয়ের প্রধান উৎস হল পর্যটন। কারুশিল্পেও এ দ্বীপের বেশ সুনাম আছে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক সৌন্দর্য সংরক্ষণ সংস্থা আন্তর্জাতিক ডার্ক স্কাই এসোসিয়েশন বিশ্বের একমাত্র তারকা উজ্জ্বল দ্বীপ হিসেবে সার্ক আইল্যান্ডকে ঘোষণা করেছে। ২০০৯ সালে আঁধার রাতের তারকা উজ্জ্বল অঞ্চলের তালিকাভুক্ত হয় সার্ক দ্বীপটি।
পর্যটকদের কাছে খুবই আকর্ষণীয় দ্বীপটি। মেঘ নির্মল রাতের আকাশে তারাদের উজ্জ্বলতা, নক্ষত্রবীথি ও বিক্ষিপ্ত উল্কাপিণ্ডের লুকোচুরি দ্বীপটিকে করেছে মায়াময়। রাতের আকাশে ছায়াপথের নিয়ত বিচরণ এ দ্বীপের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। রাতের আঁধারে তারার আলোই দ্বীপের একমাত্র আলো।
প্রকৃতির এই আলো যেন অক্ষুন্ন থাকে সেজন্য দ্বীপের কোনো রাস্তায় আলোর ব্যবস্থা রাখা হয়নি। এমনকি দ্বীপে মোটরযান চলাচলও সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। ঘোড়ার গাড়িই দ্বীপের প্রধান বাহন। শুধুমাত্র ফসল চাষাবাদ এবং তা আনা নেয়ার ক্ষেত্রে কিছু ট্রাক্টর ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হয়েছে। তারকাদেরএই স্বর্গীয় বিচ্ছুরণ দেখার জন্য এবং জ্যোতির্বিজ্ঞান গবেষণার জন্য এই দ্বীপে গবেষক থেকে শুরু করে ভ্রমণ পাগল পর্যটকদের ভিড় লেগেই থাকে।
ফিচার ইমেজ- xlstravelservice.com