
অন্তর থেকেই অভিযাত্রিক যারা, তাদের সবসময়ের পছন্দের একটি সিনেমা হচ্ছে ‘ইন্টু দ্য ওয়াইল্ড (Into The Wild)’। সিনেমাটির মূল বার্তাটি ছিলো প্রোটাগনিস্ট অ্যালেক্সান্ডার সুপারট্র্যাম্পের অন্তিম একটি উপলব্ধিতে-
“সুখ তখনই সত্যিকারের হয়, যখন তা অন্যদের সাথে ভাগ করে নেওয়া যায়।”
তাই বৈরাগী হয়ে একা একা নয়, বরং ৪ সদস্যের পুরো পরিবার নিয়ে গ্যারেট জি ও জেসিকা জি ঘুরে বেড়াচ্ছেন বিশ্বময়। সেই সাথে ভ্রমণলব্ধ জীবনের সবটুকু খুশি অন্যদের মাঝে বিলিয়ে দিতে বিক্রি করে দিয়েছেন তাদের সমস্ত সম্পত্তি। স্ন্যাপচ্যাটের কাছে অ্যাপ বিক্রি করে মিলিয়নিয়ার হওয়া সেই দু’সন্তানের জনক-জননী গ্যারেট ও জেসিকার ‘দ্য বাকেট লিস্ট ফ্যামিলি’র গল্পই বলবো আজকের লেখায়।

Source: instagram.com
‘দুই’ থেকে যেভাবে ‘এক’ হলেন গ্যারেট এবং জেসিকা
গ্যারেট জি (Garrett Gee) ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের উতাহ প্রদেশের ও জেসিকা কলোরাডোর ডেনভারের আদিবাসিন্দা। ২০০৭ সালে উতাহর প্রোভো শহরতলীর একটি মরমোন চার্চের মিশনারী হিসেবে কাজ করতে গিয়ে তাদের দু’জনের প্রথম দেখা হয়। তা-ও কিনা রাশিয়ার ভ্লাদিভস্তকের একটি ফুলের দোকানে! সেই থেকে প্রণয় শুরু। ২০০৯ সালে চার্চের অধীনস্থ ব্রাইহাম ইয়াং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন তারা পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। জি পরিবারের অন্য দুই সদস্য হচ্ছেন গ্যারেট-জেসিকার কন্যা ডরোথি ও পুত্র ম্যানিলা।
গ্যারেট ২০১৫ অবধি ব্রাইহাম ইয়াং বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুটবলার ছিলেন এবং সেখান থেকেই ড্রপ আউট হন। অন্যদিকে জেসিকা যোগাযোগের (Communication) উপর স্নাতক করেছেন। পড়ার পাট চুকিয়ে ক্যারিয়ারে ব্যস্ত হয়ে বাড়ি-গাড়ি কিনে থিতু হওয়ার ক্লিশে পরিকল্পনায় তাদের কারোরই আগ্রহ ছিলো না। জীবনে থিতু হবার আগে জীবন ও সুখের নানান মানে জানার তীব্র তাগিদ থেকেই তারা ভাবলেন ভিন্ন কিছু করার! সেই থেকে রচনা হলো তাদের পারিবারিক ‘বাকেট লিস্ট’। সব ছেড়ে সন্তানদের নিয়ে দুনিয়া দেখার পরিকল্পনা সাজালেন দু’জন!

Source: thebucketlistfamily.com
এক স্টার্টআপেই মিলিয়নিয়ার: পরিকল্পনার পালে নতুন হাওয়া
বিয়ের পর ২০১১ সালে গ্যারেট প্রতিষ্ঠা করেন ‘স্ক্যান‘ নামক একটি মোবাইল অ্যাপ ও অ্যাপ নির্মাতা কোম্পানি। গ্যারেটের সম্ভাবনাময় ব্যবসায়িক স্টার্টআপ ‘স্ক্যান’ অল্প সময়েই গুগল ও সিলিকন ভ্যালির বিনিয়োগকারীদের অনুদান লাভ করে। এরপরই মূলত গ্যারেটের শূন্য ব্যাঙ্ক একাউন্ট তরতরিয়ে চড়ে যায় ১.৭ মিলিয়ন ডলারের কোঠায়। অবশেষে তার কোম্পানি তথা মোবাইল স্ক্যানিং অ্যাপটি স্ন্যাপচ্যাট ৫৪ মিলিয়ন ডলারে অধিগ্রহণ করে নেয়। ৪ বছর কাজ করে গ্যারেটও ছেড়ে দেন নিজের কোম্পানি।

Source: facebook.com/thebucketlistfamily
অর্ধ-বিলিয়নিয়ার হওয়ার উদযাপন হিসেবে প্রশান্ত মহাসাগরে ৬ মাসের একটি রোমাঞ্চকর পারিবারিক সফরের পর গ্যারেট ও জেসিকা ঠিক করলেন স্থায়ীভাবে বেরিয়ে পড়ার। তারা তাদের গাড়ি, আসবাবপত্র, পারিবারিক অন্যান্য সকল সম্পত্তি বিক্রি করে দিলেন, পেলেন প্রায় ৫১,৫০০ ডলার। নিজেদের অসংখ্য ছবি ও জার্নালে ভরা দুটো বাক্স ছাড়া তাদের স্থায়ী কোনো সম্পত্তিই শেষ অবধি অবশিষ্ট থাকলো না। সবশেষে পরিকল্পনা হলো চূড়ান্ত : সমস্ত অর্থ দিয়ে তারা দেশে-বিদেশে ঘুরবেন এবং সেসব জায়গার বিভিন্ন মানুষের প্রয়োজনে এবং কল্যাণে অর্থ ব্যয় করবেন।
আপন আলোয় উদ্ভাসিত করি অপরে
জেসিকার শৈশব-কৈশোর প্রায় পুরোটা কেটেছে ক্ষীণ দৃষ্টিশক্তি নিয়ে। ল্যাজিক অপারেশন করে দেড় বছর আগে সুস্থ হবার পর তার বাকেট লিস্টে তিনি যোগ করেছিলেন এক বিশেষ পরিকল্পনা- ৫ জন দরিদ্র ক্ষীণ দৃষ্টিধারীকে বড়দিনের উপহার হিসেবে ল্যাজিক করাবেন। যেই ভাবা সেই কাজ, ২০০ জনের খসড়া তালিকা থেকে বেছে নিয়ে ৫ জনকে ২০১৬ এর বড়দিনে ল্যাজিক করিয়েছেন তারা। এরপর আরো ২ জনকেও ল্যাজিক করানো হয়েছে। নেপালে তারা সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য খুলেছেন একটি স্কুল।
২০১৬ এর শেষভাগে তারা চাইলেন, তাদের মতোই একটা পরিবারকে ডিজনিল্যান্ডে একটা ট্যুর স্পন্সর করবেন। ৫ সদস্যের একটা পরিবারকে সেই আনন্দভ্রমণ করালেনও জি পরিবার। যেহেতু এ পুরো সফরনামা জুড়ে তাদের প্রাধান্য তিনটি বিষয়ে-
(১) রোমাঞ্চ
(২) সংস্কৃতি ও
(৩) জনসেবা
সুতরাং প্রতিদিন, প্রতি সপ্তাহেই তারা কাউকে না কাউকে সাহায্য করেন। তবে কাদের করলেন, কেন করলেন- সব কিছু তারা প্রচার করেন না। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, জি পরিবার এগুলোকে ‘সাহায্য’ বলেন না, তারা বলেন ‘উপহার’। তাদের এ কার্যক্রম নিয়ে জনপ্রিয় পিপল ম্যাগাজিনেও ফিচার হয়েছে।

গার্ডেন অব গডে; Source: instagram.com
ব্যক্তি গ্যারেট ও জেসিকা
গ্যারেট যেহেতু একজন মোবাইল অ্যাপ ডেভেলপার, ভ্রমণের পাশাপাশি তিনি তার নতুন ব্যবসা পরিকল্পনা নিয়েও কাজ করছেন, শীঘ্রই তিনি তা প্রকাশ করবেন। ওদিকে শরীরচর্চা নিয়েও ‘কিছু করে দেখানো’র পরিকল্পনা তার। ভালোবাসেন ফুটবল আর জলের নিচে ছবি তুলতে। ‘উই বট আ জু’, ‘দ্য সিক্রেট লাইফ অব ওয়াল্টার মিটি’, ‘টুমোরোল্যান্ড’ ও ‘অ্যাবাউট টাইম’- এই কয়টি সিনেমা দেখলে গ্যারেটের জীবনকে চেনা যাবে, বলে মনে করেন গ্যারেট জি।
ওদিকে পরিবারের স্বঘোষিত ‘ক্যাপ্টেন’ জেসিকার বক্তব্য হলো, তিনি তিনটি বাচ্চাকে লালন পালন করেন – ডরোথি, ম্যানিলা এবং গ্যারেটকে (নিজের স্বামী)। পেশায় তিনি একজন অনলাইন ব্যবসায়ী ও ওয়েব ডিজাইনার। তিনি ভালোবাসেন স্কুবা ডাইভিং আর বাগান করতে।

পেঙ্গুইনের সাথে খেলছে ছোট্ট ডরোথি; Source: thebucketlistfamily.com
কেন ঘোরেন তারা? তা-ও বাচ্চার ‘ঝামেলা’ নিয়ে?
এমনিতে খুব আমুদে ও স্ফূর্তিবাজ এই পরিবার। তারা কেবল ‘চিল’ এর জন্যই বাকেট লিস্ট বানান আর ঘোরেন? মোটেও না। খুব গুছিয়ে ৭টি উদ্দেশ্যের কথা তারা বললেন-
- পরিবার হিসেবে আরো এককাট্টা হতে
- সকলের খুব ভালো বন্ধু হওয়ার জন্য
- সেবা ও সহমর্মিতার আদর্শ নির্ভর এক জীবনের জন্য
- স্বল্পেই সুখী হবার দীক্ষা পেতে
- আরো মুক্তমনের মানুষ হওয়ার জন্য
- প্রকৃতি ও পৃথিবীকে ভালোবাসতে ও শ্রদ্ধা করতে
- জীবনভর গল্প করবার জন্য স্মৃতিপাতা তৈরি করতে

সুইজারল্যান্ডে হিমবাহে সকালের গোসল সারছেন গ্যারেট, ডরোথি ও ম্যানিলা; Source: instagram.com
আর বাচ্চা? কী দরকার এত ঝামেলা পোহানোর? ওদের শৈশবকাল ধীর-স্থিরভাবে পার করে বড় হবার পর ঘুরলে ওদের জন্যেও কি ভালো হতো না? এরও জবাব আছে গ্যারেট ও জেসিকার কাছে।
“প্রাণীজগৎ ও খাদ্য নিয়ে জানা আর সকলের প্রতি ভালোবাসাপরায়ণ হওয়া শেখানোর জন্য বাচ্চাদের নিয়ে ঘোরার থেকে ভালো বিকল্প কী হতে পারে বলতে পারেন?”
কতটুকু পূরণ হলো বাকেট লিস্ট, কতটুকু বাকি?
বাকেট লিস্ট থেকে টোঙ্গায় দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে হাম্পব্যাক তিমির সাথে ডাইভ, নিউজিল্যান্ডের দূর শহরান্তে বাগান করা, ফিজির প্রিস্টিন বিচে পুরো পরিবার নিয়ে দাপিয়ে বেড়ানো, অচেনা দ্বীপে ম্যানিলাকে প্রথম হাঁটতে শেখানোর মতো দারুণ কিছু পরিকল্পনা বাস্তব করেছে জি পরিবার। এশিয়া, ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, ওশেনিয়া মহাদেশ এবং ক্যারিবিয়ান ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্র মিলিয়ে প্রায় ৪০টির মতো দেশে ইতিমধ্যে ঘুরেছেন তারা। টানা ৯৪ সপ্তাহ যাবত তারা ঘুরে চলেছেন বিশ্বজুড়ে। সমস্ত ভ্রমণের ছবি তারা ইনস্টাগ্রাম ও ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেন। সেই সঙ্গে তাদের ভিডিও প্রকাশের জন্য আছে নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেল।

টোঙ্গায় গ্যারেটের তিমির সাথে সাঁতার; Source: facebook.com/thebucketlistfamily
ওদিকে বাকেট লিস্টে জেসিকা যোগ করেছেন নতুন কিছু পরিকল্পনা, বা বলতে পারেন স্বপ্নও। ভবিষ্যতের তন্বী-তরুণী ডরোথিকে প্রেমের পোশাক কিনে দিবেন, বড়সড় একটি মৌচাকের মালিক হবেন আর বড় হওয়া ম্যানিলাকে দেখবেন ফুটবল দিয়ে গোল করতে! আর গ্যারেটের প্ল্যান হলো- অর্কা তিমির সাথে সাঁতার কাটা, বারমুডার দ্বীপে গুপ্তধনের অনুসন্ধান চালানো আর কোনো এক বাতিঘরে কয়েক রাত কাটানো। তবে আপাতত গ্যারেট, জেসিকা, ডরোথি ও ম্যানিলার পরিকল্পনা হলো পরিবারের আসন্ন পঞ্চম সদস্যকে স্বাগত জানানো, যে কিনা বেড়ে উঠছে জেসিকার গর্ভে।

জি পরিবারের এবারের ক্রিসমাস ইভ; Source: facebook.cm/thebucketlistfamily
এসব করতে গিয়ে নানান প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হয়েছিলো তাদের- মশার কামড় থেকে লাগেজ চুরি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে শুরু করে ডরোথির আহত হওয়া। তবু তারা হাল ছাড়েননি, জানেন না কবে থিতু হবেন। তারা কেবল জানেন, তারা ‘শিখছেন’! সেই শেখার নেশায়, জগৎ আবিষ্কারের নেশায়, ভালোবাসা ও কল্যাণ ছড়িয়ে দেবার নেশায় তারা বিকিয়েছেন তাদের সমস্তটা। পাঠক, কী ভাবছেন? আপনিও বেরিয়ে পড়বেন নাকি?
ফিচার ইমেজ:twitter.com