চার দেয়ালের সীমারেখায় ডেস্কে বসে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে অনবরত কাজ করে যাওয়া মানুষগুলো সম্পর্কে এককথায় বলতে হয়, এরা চাকরিজীবী। জীবিকার তাগিদে মানুষকে দিনের সিংহভাগ সময় অতিবাহিত করতে হয় অফিসে। নানান ধরনের মানুষের সাথে সাম্য ও শখ্যতা বজায় রেখে চলতে হয়। চিন্তাধারা, আচার ব্যবহার, কথাবার্তা এসবে ভিন্নতা রয়েছে প্রতিটি মানুষের। আর এতসব ভিন্নতার কারণে প্রায়শ একে অন্যের সাথে গোলযোগ বেঁধেই যায়। হয়ত বা সমস্যাগুলো কখনো ছোট হয়ে থাকে, কখনো বা বিশাল, আবার কখনো বা সাময়িক, কখনো বা দীর্ঘমেয়াদী।
সমস্যা যেমনই হোক না কেন বা তার স্থায়িত্বকাল যতক্ষণই হোক না কেন, কাজের শত ব্যস্ততার মাঝে মানব মনে তার প্রভাব রয়ে যায়। অফিসে নানা রকম সমস্যার সম্মুখীন আপনি হতে পারেন। যেমন ধরুন, আপনার সহকর্মীর ব্যবহার দ্বারা আপনি বিব্রত হতে পারেন বা আপনি আশানুরূপ পদোন্নতি পাচ্ছেন না, অথবা আপনি আপনার অফিসের পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারছেন না। এই ধরনের সমস্যাগুলো ধীরে ধীরে জটিল আকার ধারণ করে এবং মনে একধরনের দুশ্চিন্তার জন্ম দেয়। দুশ্চিন্তা থেকে উদ্বেগ এবং একসময় তা আপনার স্বাভাবিক মানসিক স্বাস্থ্যকেও প্রভাবিত করতে থাকবে। চলুন জেনে নেয়া যাক সমস্যাগুলো সম্পর্কে –
প্রায়শ আমরা অফিসে যে সমস্যাগুলোর সম্মুখীন হয়ে থাকি, সেগুলোকে শ্রেণীবিভক্ত করলে মূলত ৪ ধরনের হয়ে থাকে।
- সহকর্মীদের সাথে সমস্যা
- অফিসের বসের সাথে বোঝাপড়া নিয়ে সমস্যা
- অফিসের নিয়ম-কানুন লঙ্ঘন
- আশানুরুপ পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত হওয়া
সহকর্মীদের সাথে সমস্যা
অফিসে একই ছাদের তলায় বিভিন্ন মন-মানসিকতার মানুষ একসাথে কাজ করে থাকেন। তাদের চিন্তা ভাবনা বা কাজের ধরনও আলাদা হবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যখন একজন সহকর্মী বা তার আচার ব্যবহার অন্যের জন্য অপ্রীতিকর হয়ে উঠে, সমস্যার সূত্রপাত হয় এখান থেকেই। সমস্যা সৃষ্টিকারী মানুষগুলোকে তাদের কার্যভেদে কয়েক ভাগে ভাগ করা যায়।
১. কুঁড়ে বা অলস ব্যক্তি
এই ধরনের মানুষগুলো প্রতিষ্ঠানের জন্য খুব একটা কাম্য নয়, তবুও এমন কিছু না কিছু মানুষ প্রত্যেকটা প্রতিষ্ঠানেই রয়ে যায়। এরা নিজেরা তো খুব একটা কাজ করেই না বরং অন্যের কাজে বিঘ্ন ঘটায়। সব থেকে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়, যখন এরা নিজেদের করণীয় কাজগুলো অন্য কোনো সহকর্মীকে দিয়ে করিয়ে নিতে চায়। মাঝে মধ্যে সহকর্মী হিসেবে আমরা একে অন্যকে সাহায্য করতেই পারি, কিন্তু যখন তা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে যায় সেটা সেই সহকর্মীর জন্য অনাকাঙ্ক্ষিত সমস্যায় পরিণত হয়। তাকে “না” বলতে চেষ্টা করুন এবং অবস্থার উন্নতি না হলে এসব ক্ষেত্রে সমস্যা সমাধানের জন্য অবশ্যই আপনার সুপারভাইজর বা বসের শরণাপন্ন হতে হবে। কখনোই তার কাজগুলোকে আপনার রুটিন ওয়ার্কের অন্তর্ভুক্ত করে ফেলবেন না।
২. নেতিবাচক মানুষ
সবকিছুতেই নেতিবাচক কিছু খুঁজে বের করা এবং অভিযোগ করা এ ধরনের মানুষের স্বভাব। নীতিগতভাবে এই অভ্যাসটি খুবই খারাপ। এ ধরনের মানুষের কথপোকথনের মূল বিষয় হয়ে থাকে অফিসের বা সহকর্মীদের নেতিবাচক কোনো বিষয় বা সমস্যা। আপনার সাথে সে হয়ত কোনো নেতিবাচক ব্যাপার বা সমস্যা নিয়ে আলোচনা করছে, আপনি সহমর্মিতার কারণে হয়ত কিছুটা দুঃখ প্রকাশ করতে পারেন। কিন্তু কখনোই তার সাথে হাতে হাত মিলিয়ে সেই সমস্যার সুরাহা করতে যাবেন না, বরং তাকেই চিন্তাভাবনা করে সেই সমস্যার কিনারা বের করতে বলুন। আপনার সাথে শেয়ার করা এই সমস্যাগুলো নিয়ে কখনো অন্যদের সাথে গল্প করতে যাবেন না।
৩. তর্জন–গর্জনকারী
কিছু মানুষ অকারণেই চড়া গলায় কথা বলে আর এই কারণে বাকি সহকর্মীরা একটা বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়ে যান যা তাদের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মূলত কাজের ক্ষেত্রে যাদেরকে তারা নিকট প্রতিদ্বন্দ্বী বলে মনে করে থাকেন, তাদের সাথে অপেক্ষাকৃত এমন ব্যবহার বেশি করে থাকেন। স্থান, কাল, পাত্র না বুঝেই তারা প্রাসঙ্গিক বা অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ে কথা বলে থাকেন। এমন ব্যক্তির কথায় কখনো নিজেকে হারিয়ে ফেলবেন না, বরং আপনার সুপারভাইজারকে বিষয়টি সম্পর্কে অবগত করুন।
৪. অসন্তুষ্ট সহকর্মী
এই ধরনের ব্যক্তিরা কোনো কাজেই ঠিক সন্তুষ্ট হতে পারেন না এবং অফিসে একটা গুমোট পরিবেশ তৈরি করে রাখেন। তাদের ব্যবহার অনেক রুঢ় হয়, যা অন্যের জন্য মনঃকষ্ট ও অশান্তির কারণ হয়ে থাকে। যদি কখনো এমন ব্যক্তির সাথে আপনার কাজ করার প্রয়োজন পড়ে সেক্ষেত্রে যথেষ্ট বিনয় বজায় রেখে ঠান্ডা মাথায় কাজ করার চেষ্টা করুন। তার আচরণে যে আপনি মনঃক্ষুণ্ণ হচ্ছেন, সময় সুযোগ বুঝে তার সাথে এই ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করুন এবং খুব আবশ্যক না হলে এসব ব্যপারে আপনার বসকে না জড়ানোই ভালো।
৫. খোশগল্পকারী
কাজের চেয়ে খোশগল্পে অধিক মেতে থাকা মানুষগুলো কাজের পরিবেশকে বিরক্তিকর করে তোলে। এরা সবার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে চলার চেষ্টা করে এবং একজনের কাছ থেকে শোনা কথা অন্যের সাথে শেয়ার করে অনেক সময় ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি করে। এদের থেকে সর্বদা নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে চলা উচিত। অবশ্যই আপনি তাদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখবেন, কিন্তু কখনোই তাদের সুরে সুর মেলাতে বা কারো সম্পর্কে তীর্যক মন্তব্য করে বসবেন না। নইলে এহেন মানুষের নিচু মনমানসিকতার দরুন সৃষ্ট অপ্রীতিকর অবস্থার শিকার হতে হবে আপনাকে।
অফিসের বসের সাথে বোঝাপড়া নিয়ে সমস্যা
অফিসের উচ্চপদে অধিষ্ঠিত বস ও কর্মকর্তার মাঝে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বোঝাপড়া নিয়ে একটা সমস্যা থেকে যায়। বস কিভাবে কাজটা করতে বলেছেন এবং কর্মকর্তা সেই নির্দেশাবলী কতটুকু বুঝতে পেরে কাজটা সম্পন্ন করেছে, প্রায়শ একটা পার্থক্য থেকে যায় এ দুয়ের মাঝে। এছাড়াও দুজন আলাদা ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব ভিন্নতার কারণেও অনেক সময় সমস্যা দেখা দেয়। এই ধরনের সমস্যার কারণে একধরনের বিষণ্ণতা পেয়ে বসে। সমস্যা নিরসনে প্রথমে নিজেকে প্রশ্ন করুন “কেন বসের সাথে আমার কাজের সমস্যা হচ্ছে?” দু’পক্ষ থেকেই বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করুন– নিজের জায়গা থেকে তো ভেবে দেখবেনই, একবার তার জায়গা থেকেও ভেবে দেখুন। অতঃপর বিনা অনুযোগ বা অভিযোগে বসের সাথে কথা বলুন এভাবে, “আমরা কাজের আসন্ন কোনো ভালো ফলাফল পাচ্ছি না, আমরা কি এই ব্যাপারটা নিয়ে একটু আলোচনা করতে পারি যে কীভাবে ভালো করা যায়”। এ ধরনের পরিস্থিতিতে আমি বা আপনি এর চেয়ে আমরা অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য। এরপরেও যদি সমস্যা সমাধান না হয়, সেক্ষেত্রে অফিসের প্রশাসন বিভাগকে জানানো আবশ্যক।
অফিসের নিয়ম-কানুন লঙ্ঘন
যেকোনো জায়গায় নিয়ম-কানুন মেনে সততা এবং নিষ্ঠার সাথে কাজ না করলে একদিকে যেমন চাকরি হারানোর ভয় থাকে ঠিক তেমনি আপনার সহকর্মীরাও আপনাকে যথাযোগ্য সম্মানের চোখে কখনো দেখতে পারবে না। অসৎ লোক সমাজের সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। যদি কেউ কখনো আপনাকে নিয়ম-নীতি লঙ্ঘন বা কোনো অসদুপায় অবলম্বনের প্রলোভন দেখায় তবে তাকে তৎক্ষণাৎ “না” বলুন এবং প্রয়োজনে তার ব্যাপারে উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অবগত করুন। প্রতিটি অফিসের নিজস্ব কিছু নীতিমালা থাকে, ভালোভাবে তা জেনে নিন এবং সবসময় তা মেনে চলার চেষ্টা করুন।
আশানুরূপ পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত হওয়া
নিরলস পরিশ্রম ও অবদানের পাশাপাশি সকলেই পদোন্নতির আশা করে থাকে। যদি কখনো এমন হয় যে, আপনি আপনার কাজ অনুযায়ী পদোন্নতি পান নি বা আপনার চেয়ে কম কাজ ও সফলতা পেয়েও অন্য একজন পদোন্নতি পেয়ে গেছে, তাহলে প্রথমেই মাথা ঠাণ্ডা রাখুন। কারো কাছে কোনো অভিযোগ না করে বরং আপনার বসের কাছে সময় চেয়ে একটি মিটিং সেট করুন। নিজের বিগত বছরের কাজের সফলতাগুলো নিয়ে একবার নিজে পুনরায় চিন্তা করুন। তারপর আপনার বসের সাথে আলোচনা করুন আপনার পদোন্নতি না পাওয়ার কারণগুলো নিয়ে এবং নিজেকে পরবর্তীতে কিভাবে আরো এগিয়ে নিয়ে যাবেন সেই সম্পর্কে।
পদোন্নতির জন্য কিছু কাজ করা আবশ্যক, যেমন- যে কাজগুলো আপনি করছেন তা সম্পর্কে আপনার সহকর্মী ও বসকে অবগত রাখা, উদ্যোগী হয়ে নেতৃত্ব প্রদান করা, নতুন দায়িত্ব নেয়া এবং তা সঠিকভাবে সম্পন্ন করা, বসের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা ও কথার মাধ্যমে বোঝানোর চেষ্টা করা যে আপনি পরবর্তী ধাপে যেতে চান এবং সর্বোপরি নিজেকে সকলের কাছে অনুকরণীয় করে তোলা।
অফিসে নানা সমস্যার কারণে আপনি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন যে এই চাকরিটি আপনি ছেড়ে দিয়ে অন্যত্র চলে যাবেন। নিজেকে শান্ত করুন, কিছুটা সময় নিন। কর্তৃপক্ষের সাথে আপনার সমস্যাগুলো নিয়ে আলোচনা করুন প্রথমে, যদি সমস্যাগুলোর একটা হাল বের করা সম্ভব হয়, তাহলে যেখানে রয়েছেন সেখানেই নতুন উদ্যমে আবার কাজ শুরু করুন। কারণ বর্তমান সময়ে চাকরির বাজারে চাকরি অনেকটা সোনার হরিণের মতো, তাই হুট করে কোনো সিদ্ধান্ত না নেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। আলোচনার পরও যদি সমস্যা থেকেই যায় তবে চাকরির অনুসন্ধান করতে থাকুন, অফিস টাইমের আগে বা পরে ইন্টারভিউয়ের সময়গুলো সেট করুন। অন্য একটি চাকরি সুনিশ্চিত হয়ে যাওয়ার পর বর্তমানে কর্মরত প্রতিষ্ঠানকে বিনয়ের সাথে আপনার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দিন। ব্যক্তিজীবনের সমস্যা সমাধানের ন্যায় কর্মজীবনের সমস্যাগুলোকেও দক্ষতার সাথে মোকাবিলা করতে শিখুন, কখনোই সমস্যার কাছে জিম্মি হয়ে পড়বেন না। প্রতিটি সমস্যারই একটি সমাধান থাকে, প্রয়োজন শুধু চোখ-কান খোলা রেখে তা খুঁজে বের করা।
ফিচার ইমেজ: rudolphmiles.com