রমজান মাস আসুক কিংবা না আসুক, খেজুর আমাদের জীবনে বেশ বড় একটি ভূমিকা রাখে। বিশেষ করে বাংলাদেশী মুসলিমদের কাছে খেজুর অনেকটা ধর্মের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে মিশে থাকা এক ফলের নাম। রমজান মাস হলে রোজা ভাঙ্গার শুরুতে দুটো খেজুর মুখে দিতেই হবে। পেট খালি খালি লাগছে? একটি খেজুর খেয়ে এক গ্লাস পানি পান করলেই পেট ভরে যাবে। মরুভূমির দেশের ফল হিসেবে সবার খাছেই একটু অন্যরকম প্রাধান্য পায় খেজুর। তবে খেজুর সম্পর্কে এটুকু জ্ঞান নিয়ে কি আপনি সন্তুষ্ট? জানতে ইচ্ছে করে না খেজুর সম্পর্কে আরো অনেক কিছু? কোথা থেকে মানুষের হাতে এলো এই ফল? পুষ্টি কতখানি আছে ফলটির? চলুন না জেনে আসি।
খেজুর কতটা পুরনো?
একদম ঠিক উত্তরটি জানা সম্ভব নয়। একটি ব্যাপার খুব সহজেই বোঝা যায় যে, খেজুর গাছ এবং খেজুর সম্পর্কিত হওয়ার কারণে গাছের খোঁজ পাওয়া গেলেই সেই সময়ে খেজুর ছিল তা নিশ্চিতভাবে বলা যায়। খেজুরের গাছ কবে প্রথম বেড়ে উঠেছিল সেটা জানাও মানুষের পক্ষে এখন সম্ভব হয়নি। তবে খেজুর গাছের সবচাইতে প্রাচীন ফসিলটির বয়স প্রায় ৫০ মিলিয়ন বছর। তাই, খেজুরকে খুব একটা নতুন কিছু বলা যাবে না। খেজুর অনেক আগে থেকেই পৃথিবীর মাটিতে ছিল। সময় লেগেছে কেবল সেটা খুঁজে বের করতে। সময় লেগেছে মানুষের। গাছ, সেটা অনেক আগে থেকেই ছিল।
মধ্যপ্রাচ্য এবং সিন্ধু উপত্যকায় খেজুর ছিল হাজার বছর পুরনো কোনো ফল। নৃতাত্ত্বিকদের মতে, পশ্চিম আরবে অনেক আগে থেকেই খেজুর গাছ মজুদ ছিল। সেখানে খেজুর গাছ খুঁজে পাওয়া যায় ৫৩২০ ক্যালবিসিতে। তবে এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্যানুসারে, সর্বপ্রথম খেজুর গাছ ইরাকের আশেপাশে কোথাও জন্ম হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। তবে এটা নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহ আছে। কেবল ইরাকের আশেপাশে নয়, খেজুর গাছ পাওয়া যায় ভারত, পাকিস্তান, উত্তর আফ্রিকা ইত্যাদি স্থানেও। ফলে কোথায় এটি প্রথম জন্ম নিয়েছে, আর কোথায় একে প্রথম মানুষ আবিষ্কার করেছে সেটা জানাটা খুব বেশি সহজসাধ্য ব্যাপার নয়।
খেজুর গাছ (Phoenix dactylifera) সাধারণত ২৫ মিটারের মতো উচ্চতাসম্পন্ন হয়ে থাকে। একটি খেজুর গাছের একটি শাখায় প্রায় হাজারটির বেশি খেজুর ধরতে পারে একই সময়ে। খেজুর নিয়ে খুব বেশি বলার কিছুই নেই। এটি অনেক আগে থেকেই উত্তর আফ্রিকার মতো স্থানগুলোতে মানুষের দৈনন্দিন খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্য তো ছিলোই। ১৮-১৯ শতকের দিকে খেজুর পরিচিত হয় বাইরের দুনিয়ার সাথে। স্প্যানিশ মিশনারিরা প্রথম একে বাইরের পৃথিবীর সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। এরপরেই প্রাচীন ফল খেজুর হয়ে ওঠে বর্তমান সময়ের খেজুর। খেজুর কিনে নিয়ে আসলে সেটা কতদিন মজুদ করে রাখা সম্ভব সেটা নাহয় না-ই বললাম, তবে একটি খেজুর গাছ প্রায় ১৫০ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকার ক্ষমতা রাখে।
খেজুর কেন খাবেন?
খেজুর ও খেজুর গাছ অনেকভাবেই ব্যবহার করা হয়। মানুষ একে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছে ততখানি পর্যন্ত যতখানি করা সম্ভব। খেজুর যেমন খাবার হিসেবে গ্রহণ করি আমরা, ঠিক তেমনি এর দ্বারা নানা রকম খাবার তৈরি করা হয়। খেজুর গাছ কেবল খেজুর আর খেজুরের রস দেওয়ার কাজেই ব্যবহৃত হয় না, সেইসাথে আসবাব তৈরি করার কাজেও এটি ব্যবহার করা হয়। তবে এবার আর খেজুর গাছ নয়, বরং খেজুরের কিছু ইতিবাচক দিক সম্পর্কে জানাব আপনাকে। সত্যিই তো, জানতে ইচ্ছে করে না কখনো যে খেজুর কেন খাবেন? হাজারটা কারণ আছে। আমরা সাধারণত খেজুর খাই এর অসাধারণ স্বাদের কারণে। তবে, চলুন জেনে আসি সবচাইতে দরকারি কিছু কারণ সম্পর্কে, যেগুলোর জন্য আপনার অবশ্যই খেজুর খাওয়া দরকার।
১) দরকারি সব উপাদান
খেজুর কেবল খেতেই খুব ভালো নয়, এর ভেতরে আছে অনেক অনেক পুষ্টিগুণ। খনিজ, চিনি, আঁশ আর নানা রকম ভিটামিনে ভর্তি থাকে প্রতিটি খেজুর। আর এছাড়াও এতে থাকে ক্যালসিয়াম, আয়রন, পটাসিয়াম, ফসফরাস, জিঙ্ক এবং আরো অনেক উপাদান, যেগুলো আপনাকে কেবল শারীরিকভাবেই ভালো রাখবে না, সেইসাথে আপনি হয়ে উঠবেন মানসিকভাবেও সুস্থ।
২) কোলেস্টেরল নেই
কী? অবাক হচ্ছেন কথাটা শুনে? কিন্তু সত্যিই খেজুরে কোনোরকম কোলেস্টেরল নেই। শুধু তা-ই নয়, খেজুরে ফ্যাটের পরিমাণও অনেক কম। এটি খেলে আপনার ওজন মোটেই বাড়বে না। তাই আপনি ইচ্ছেমতো খেজুর খেতে পারেন। হ্যাঁ, আপনার ডায়েটের ক্ষেত্রেও এই একটি ফল বেশ ভালো উপকার এনে দিতে পারে।
৩) প্রোটিনের উৎস
খেজুর প্রটিনের বেশ ভালো উৎস। নিজের শরীরের পেশীগুলোকে আরো বেশি শক্তিশালী করে তুলতে চান? তাহলে দিনে কয়েকটি খেজুর আপনার খাবারের তালিকায় জায়গা করে নিতেই পারে।
৪) হাড়ের স্বাস্থ্য ঠিক রাখে
খেজুরে আছে ম্যাগনেসিয়াম, কপার, সেলেনিয়াম, ক্যালসিয়াম ইত্যাদি। আর এই উপাদানগুলো শরীরের হাড়কে ঠিক রাখার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
৫) প্রচুর ভিটামিন
আগেই বলেছি, খেজুরে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন থাকে। আর এই ভিটামিনগুলোর মধ্যে আছে বি১, বি২, বি৩, বি৫, এ১ এবং সি। এছাড়াও এতে আছে গ্লুকোজ, সুক্রোজ ইত্যাদি। ফলে আপনার শরীর সবসময়েই থাকবে সুস্থ।
৬) দাঁত এবং ত্বকের সুরক্ষা
খেজুরে থাকে আয়রন, যেটি কিনা দাঁতের জন্য অসম্ভব ভালো। সেই সাথে ভিটামিন ডি আর ভিটামিন সি তো আছেই। এই ভিটামিনগুলো ত্বকের সুরক্ষায় বেশ ভালো কাজ করে।
৭) হজম হতে সাহায্য করে
হজমে সমস্যাবোধ করছেন? তাহলে সারাদিনে একটু খেজুর খেয়ে নিন। এতে করে আপনার হজম প্রক্রিয়া হবে আরো সহজ এবং স্বাভাবিক। আপনি যদি আপনার কম ওজন নিয়ে চিন্তিত হন তাহলে খেজুর খাওয়ার মাধ্যমে ওজনকেও বাড়িয়ে নিতে পারবেন।
খেজুরের অনেক ভালো দিক আমাদের সবার জানা আছে। আটি আমাদের শরীরে নানারকম দরকারি উপাদানের যোগান দেয়। তবে খেজুরের কিন্তু কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও রয়েছে। এর মধ্যে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ এবং বাজে ব্যাপারটি হচ্ছে ফাঙ্গাসজনিত সমস্যা। এমনকি, এই খেজুরের সাথে জড়িত ফাঙ্গাসের কারণে মানুষের মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। এটি বাদেও খেজুরের কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কথা বলতে গেলে উল্লেখ করার মতো ব্যাপারগুলো হচ্ছে-
১) অতিরিক্ত ক্যালোরি
খেজুরে বেশ ভালো পরিমাণ ক্যালোরি থাকে। একটি কাপের এক-চতুর্থাংশ জুড়ে থাকা খেজুরে মোট ১১ ক্যালোরি পাওয়া যায়। খেজুরের আকৃতির তুলনায় যেটা অনেকটা বেশি। তাই খেজুর খাওয়া ভালো হলেও খুব বেশি খেজুর খাওয়াটা মোটেও ভালো কোনো ব্যাপার নয়।
২) আঁশ
আঁশযুক্ত খাবার গ্রহণ করা খুব ভালো ব্যাপার। এটি আমাদের শরীরকে ভালো রাখে। কিন্তু খেজুরে আঁশ অনেক পরিমাণে থাকে। একটি কাপের এক-চতুর্থাংশ খেজুরে ২.৭ গ্রাম খেজুর থাকে। প্রতিটি মানুষের দিনে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ আঁশ গ্রহণ করা উচিত। পুরুষের ক্ষেত্রে সেটি ২০-৩০ গ্রাম এবং নারীদের ক্ষেত্রে সেটা আর একটু কম। তবে এর বেশি আঁশ গ্রহণ করলে সেটি আমাদের শরীরের জন্য বেশ নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত মোট ৩০ রকমের খেজুর খুঁজে পাওয়া গিয়েছে। এদের সবগুলো হয়তো আপনার পক্ষে উপভোগ করা সম্ভব হবে না। তবে আপনি ইচ্ছে করলেই কিন্তু আপনার হাতের কাছের খেজুরটিকে নিজের খাবারের টেবিলে এবং খাদ্যাভ্যাসে প্রবেশ করাতে পারেন সহজেই। কী ভাবছেন? তাহলে কাল থেকে শুরু হয়ে যাক খেজুর খাওয়া নতুন করে!
ফিচার ইমেজ: tips-and-tricks.co