“আমার সাথেই সব সময় এমন হয়!”
“আমার কপালই খারাপ!”
“আমার দ্বারা এসব সম্ভব না!”
“আমি কি আর পারবো এসব, আমার এত ক্ষমতা কোথায়?”
উপরের লাইনগুলো খুব চেনা, তাই না? প্রতিনিয়ত আমরা কোনো না কোনো পরিস্থিতে এই আক্ষেপ বা অজুহাতগুলো দিয়েই থাকি। আপনি সাঁতার শেখার জন্য পানিতে নামার আগেই খুব আত্মবিশ্বাসের সাথে বলে দিলেন, সাঁতার শেখা আপনার কর্ম নয়। আপনি যদি পানিতেই না নামেন তাহলে কী করে বুঝলেন আপনি সাঁতার শিখতে পারবেন না? এটি সামান্য একটি উদাহরণ মাত্র। কিন্তু একটু ভেবে দেখুন তো, আপনার এমন নেতিবাচক চিন্তার জন্য প্রতিনিয়ত জীবন থেকে কত সাফল্য আর রোমাঞ্চকর সব অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত হয়ে যাচ্ছেন?
জীবনে চলতে গেলে এমন অনেক সময়ের সম্মুখীন হতে হয় যে, আপনাকে অনেক কিছু ছাপিয়ে গিয়ে নিজেকে প্রমাণ করতে হয় অথবা কখনো কখনো নিজের গণ্ডির বাহিরে গিয়েও অনেক কিছু অর্জন করতে হয়। আপনাকে যা করতে হবে তা হলো শুধু একটু সাহস আর সমস্ত নেতিবাচক চিন্তা ঝেড়ে ফেলে লক্ষ্য পূরণের জন্য ছুটতে হবে। কী হবে যদি আপনি ব্যর্থ হন?
একটু হতাশা আর হয়তো খানিকটা সমালোচনা, কিন্তু আপনি আপনার লক্ষ্য অর্জনের জন্য যেসব প্রতিকূলতা পেরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন তার সমস্ত সময়টা আপনার জীবনের অমূল্য অর্জন হয়ে থাকবে। এটি সত্য যে, হয়তো আপনি আপনার এই অর্জিত অভিজ্ঞতার মূল্যায়ন পাবেন না সবার কাছে, কিন্তু জীবনে চলার প্রতিটি পদে এই অর্জিত অভিজ্ঞতা আপনার পাথেয় হয়ে থাকবে চিরকাল।
এখন হয়তো আপনার মাথায় প্রশ্ন আসতে পারে, নেতিবাচক চিন্তার জাল ভেদ করে আপনি কিভাবে সামনে এগিয়ে যাবেন? আপনার নেতিবাচক চিন্তাকে পেছনে ফেলে জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত কিভাবে উপভোগ করবেন সেই পরামর্শ নিয়েই আজকের এই লেখাটি।
কিভাবে নেতিবাচক চিন্তা নিয়ন্ত্রণ করবেন?
একটি কথা সবার আগে আপনাকে মনে রাখতে হবে যে, আপনার মনের নিয়ন্ত্রক আপনি নিজেই। এটি সত্য যে, জীবনে এমন কিছু সময়ের সম্মুখীন আমাদের হতে হয় যখন ভাগ্যকে দোষ দেওয়া ছাড়া আর কিছু করার থাকে না, আর এটি খুব স্বাভাবিক একটি সহজাত মানসিক প্রবৃত্তি। কিন্তু প্রতিনিয়ত যদি আপনি ভাগ্যকে দোষ দিয়ে যান এবং নিজের যোগ্যতার উপর সন্দেহ বা অবজ্ঞা প্রকাশ করতে থাকেন তাহলে সেটা অভ্যাসে পরিণত হতে সময় লাগবে না।
আপনার মনের সমস্ত নেতিবাচক চিন্তা লিখতে শুরু করুন
নেতিবাচক চিন্তাকে ছাপিয়ে ইতিবাচক মানসিকতা সম্পন্ন মানুষ হয়ে ওঠার চেষ্টায় সবার আগে আপনাকে যা করতে হবে তা হলো, বুঝতে চেষ্টা করুন দিনের ঠিক কোন সময়ে এবং কেন নেতিবাচক চিন্তা করা শুরু করছেন? আপনি যখনই খুঁজে বের করতে পারবেন ঠিক কখন এবং কেন আপনি নেতিবাচক চিন্তা করা শুরু করেছেন তাহলে সেই নেতিবাচক চিন্তার উপর প্রতিফলনও পরিবর্তন করতে সক্ষম হবেন।
নেতিবাচক চিন্তায় আপনি কখন এবং কেন পতিত হচ্ছেন এটা যদি নজরদারীতে রাখতে পারেন তাহলে এই চিন্তা সম্পর্কে আরও বিস্তারিত নিয়েও জানতে পারবেন। একটি নোটবুকে আপনার নেতিবাচক চিন্তা কেন ও কখন শুরু হয়েছিল তা লিখে রাখুন এবং আপনি এই চিন্তার পর কেমন অনুভব করেছিলেন এবং আপনার পরবর্তী পদক্ষেপ কী ছিল তা-ও লিখুন।
একটি বিকল্প চিন্তা বা পথ খুঁজুন
যখন আপনি আপনার নেতিবাচক চিন্তার কারণ এবং এর প্রভাব সম্পর্কে বিস্তারিত লিখে রাখবেন, পরবর্তীতে তা আপনাকে বাস্তবসম্মত ও ইতিবাচক চিন্তা শুরু করতে সাহায্য করবে। তাই যখন আপনি আপনার নেতিবাচক চিন্তাধারা নিয়ে সামনে বসবেন, তখন আপনি সহজেই সেই নেতিবাচক চিন্তার পরিবর্তে ইতিবাচক চিন্তা করার সুযোগ পাবেন এবং নিজের ইতিবাচক চিন্তাবোধ প্রসারিত করতে পারেন।
ধরুন, আপনি চিন্তা করেছেন চাকরির জন্য ইন্টারভিউ দিতে যাওয়াটা আপনার জন্য বিপর্যয় হতে চলেছে, কারণ সেখানে আপনার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি যোগ্যতাসম্পন্ন চাকরি প্রত্যাশী প্রার্থীরা থাকবে। এবার আপনি কিন্তু আপনার এই নেতিবাচক চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। চিন্তা করুন, আপনি হয়তো সবার চেয়ে সেরা নন, কিন্তু আপনি আপনার সর্বোচ্চটুকু দিয়ে চেষ্টা করবেন। দেখুন, আপনি আপনার নেতিবাচক চিন্তাকে ইতিবাচক চিন্তায় রূপান্তর করে ফেলেছেন। তাই যখনই আপনার মধ্যে কোনো ব্যাপার নিয়ে নেতিবাচক চিন্তা আসবে, চেষ্টা করুন সেটাকে ইতিবাচক চিন্তায় রূপান্তর করতে।
মন পড়ার চেষ্টা করবেন না
অনেক সময় মানুষের মন পড়তে গিয়ে আপনার মধ্যে নেতিবাচক চিন্তা আসতে পারে। আপনার মনে হয় আপনি মানুষের মন পড়তে পারেন। এখন বলুন তো কী করে আপনি এতটা নিশ্চিত হন যে, আপনি অন্যের মনের খবর পড়তে পারেন? উদাহরণস্বরূপ, আপনি পথ চলতে গিয়ে কাউকে দেখলেন যে আপনাকে চেনে কিন্তু সে আপনাকে দেখে থেমে কথা না বলে চলে গেল আর আপনি ধরে নিলেন তিনি আপনাকে পছন্দ করেন না। সত্য হলো, আমাদের কারও ক্ষমতা নেই যে, অন্যের মনে কী চলছে তা পড়ে ফেলার। তাই কারো মনের খবর না জেনেই নেতিবাচক চিন্তা করা বন্ধ করুন।
যেহেতু আমরা কারো মনের খবর শতভাগ নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারি না, তাই উল্টাপাল্টা চিন্তা না করে ভাবুন। হয়তো সেই ব্যক্তি একটি খারাপ দিনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছেন অথবা তিনি অন্য কোনো চিন্তায় বিভোর, তাই আপনার উপস্থিতি তার নজরেই পড়েনি। আমরা সবাই কখনো না কখনো এমন সময়ের ভেতর দিয়ে যাই, তাই না?
নেতিবাচক চিন্তাকে ছুঁড়ে ফেলুন
ওহাইও বিশ্ববিদ্যালয় এবং মাদ্রিদ বিশ্ববিদ্যালয়ের অটোম্যান থেকে একটি গবেষণায় বলা হয়েছে যে, নেতিবাচক চিন্তাকে লিখে সেগুলো পুড়িয়ে ফেলে বা ময়লার ঝুড়িতে ছুঁড়ে ফেলার মধ্য দিয়ে আপনি নেতিবাচক চিন্তা থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে আনতে পারেন। এটি করার মাধ্যমে আপনি আপনার সমস্ত অবাস্তব ধারণা ও নেতিবাচক চিন্তা থেকে নিজেকে মুক্ত করে ইতিবাচক মনোভাব এবং বাস্তব বিষয়ের উপর ফোকাস করতে পারেন।
এই লেখার প্রথম ধাপে বলা হয়েছিল যে, সমস্ত নেতিবাচক চিন্তা নোটবুকে টুকে রাখতে। এবার সেই সমস্ত লিখা আপনি পুড়িয়ে বা ময়লার ঝুড়িতে ফেলে দিয়ে নিজেই নিজেকে বলুন, আপনি এসব আত্ম-ধ্বংসাত্মক চিন্তা থেকে আজ মুক্ত হয়ে গেলেন।
ইতিবাচক চিন্তাশক্তিকে সংকীর্ণ করে ফেলবেন না
নেতিবাচক চিন্তাধারা মানুষের ইতিবাচক চিন্তা করার শক্তিকে সংকীর্ণ করে ফেলে, এমনকি যখন চোখের সামনে ভালো কিছু ঘটে তখনও। অতিরিক্ত নেতিবাচক চিন্তাকারী মানুষের ক্ষেত্রে যা হয়, তাদের সমস্ত ইন্দ্রিয়ে এমন এক ফিল্টার স্থায়ীভাবে বসে যায় যে, ইতিবাচক বস্তুর মধ্যেও তারা কেবল নেতিবাচক দৃশ্য দেখতে পায়, যার ফলাফল শুধু হতাশা আর দুর্ভোগ।
তাই চেষ্টা করুন সব কিছুর ভালো দিক নিয়ে ভাবতে। এমন না যে, খারাপ জিনিসেও আপনাকে ভালো কিছু খুঁজে বের করতে হবে। শুধু মাথায় রাখুন, আপনি যদি নিজে নেতিবাচক চিন্তাধারায় বাধা সৃষ্টি না করেন, তাহলে একটা সময় আপনি চাইলেও আর ভালো কিছু নিয়ে ভাবতে পারবেন না।
ইতিবাচক মানসিকতা সম্পন্ন মানুষের সাথে মিশুন
নেতিবাচকতা সংক্রামক, নেতিবাচক মনোভাবসম্পন্ন মানুষদের থেকে দূরে থাকুন। আপনি যদি ঠিক করেন, আজ থেকে সমস্ত নেতিবাচক চিন্তা-চেতনা থেকে নিজেকে সরিয়ে আনতে চেষ্টা করবেন। তাহলে আপনার প্রধান এবং অন্যতম কাজ হবে নিজেকে যতটা পারা যায় ইতিবাচক মানসিকতার অধিকারী ও প্রাণোচ্ছ্বল মানুষদের সাথে মেশা।
অনেক সময় চাইলেই হুট করে আপনি একটি বৃত্ত ভেঙে আরেক বৃত্তে ঢুকতে পারেন না। কারণ সব কিছুতেই সময় লাগে। তাই মনস্থির করার পর একটু একটু করে নেতিবাচক মনোভাব সম্পন্ন মানুষদের থেকে দূরে সরিয়ে ইতিবাচক মানসিকতার লোকজনের সাথে মিশতে শুরু করুন। নেতিবাচকতা যেমন সংক্রামক, ইতিবাচকতাও তেমনই সংক্রামক।
নিজের সাফল্য উপভোগ করুন
যখন বুঝতে পারবেন, ‘আমি পারবো না’-এর পরিবর্তে ‘পারি আর না পারি পরের হিসাব। আগে তো চেষ্টা করে দেখি’- এ ধরনের চিন্তা আপনার মাথায় আসছে বা মনে উঁকি দিচ্ছে, তখন নিজেকে নিজেই বাহবা দিন। নিজের ছোটখাট অর্জনগুলো উপভোগ করতে চেষ্টা করুন। কালকের দিন আপনি কিভাবে শুরু করতে চান আর দিন শেষে আপনার নেতিবাচকতার স্থান কতটুকু ইতিবাচকতা দিয়ে পরিপূর্ণ করতে পেরেছেন সে সম্পর্কে ঘুমাতে যাওয়ার আগে অবশ্যই একবার ভাবুন। সামান্য পরিমাণ ইতিবাচকতাও যদি আপনার সারাদিনে কোনো কাজ অথবা কথার ভেতর দিয়ে প্রকাশ পেয়ে থাকে বলে আপনি অনুভব করেন, তাহলে নিজের মনকে একটি ধন্যবাদ দিয়ে ঘুমাতে যান। আপনি আপনার সাফল্য উপভোগ করতে পারলেই নতুন নতুন সাফল্য অর্জনের প্রেরণা পাবেন নিজের ভেতর থেকে।
নিজেকে বিভ্রান্ত করুন
অবাক হচ্ছেন নিশ্চয়ই? ভাবছেন, নিজেকে বিভ্রান্ত করার মানে কী? আসুন জানা যাক, কেন নিজেকে বিভ্রান্ত করবেন।
কখনো কখনো এমন অবস্থার সম্মুখীন হয়তো আপনাকে হতে হবে যে, কোনোভাবেই নিজেকে স্থির করতে পারছেন না, নেতিবাচক চিন্তা আপনার পিছু ছাড়ছে না। অস্থির হবেন না, এখনই সময় নিজেই নিজেকে বিভ্রান্ত করার। যখন আপনি এ ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হবেন, তখন নিজেকে কোনো কাজের মধ্যে ব্যস্ত রাখতে চেষ্টা করুন অথবা কোথাও থেকে ঘুরে আসুন। কিংবা এমন কিছু করুন যা আপনার অনেক পছন্দ, হতে পারে সেটা গান শোনা, ছবি আঁকা বা অন্য কিছু।
মনকে শান্ত করার আরও একটি কার্যকরী উপায় হচ্ছে মেডিটেশন করা। আপনি নেতিবাচক-ইতিবাচক এসব চিন্তা নিয়ে দুশ্চিন্তা কিছু সময়ের জন্য বন্ধ করে নিজেকে স্থির করুন। কারণ স্থির মন আমাদের সবসময় সঠিক কাজটি করার ক্ষমতা দেয়, যেটা অস্থির মনে অসম্ভব।
নেতিবাচক মানসিকতা বা চিন্তা থেকে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা সহজ কাজ নয়; সময় লাগবে এবং লাগবে আপনার একাগ্রতা। হাল ছেড়ে দেবেন না। মনে রাখবেন ভালো কিছুতে সময় বেশি লাগলেও আপনি যে পরিতৃপ্তি পাবেন, সেটার তুলনা পৃথিবীর আর কিছুর সাথে হয় না।
ফিচার ইমেজ: time.com