Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

অবসর গ্রহণ: সত্যিই কি মেলে পরম আরাধ্য স্বস্তির ঠিকানা?

সুচিত্রা ভদ্র (ছদ্মনাম) প্রায় ২৫ বছর শিক্ষকতা করেছেন একটি স্বনামধন্য সরকারি কলেজে। অবসর গ্রহণ করেছেন প্রায় মাস ছয়েক হতে চলল। সম্প্রতি তার ব্যবহারে বেশ কিছু অস্বাভাবিকতা ধরা পড়ছে। যে মানুষটা কিছুদিন আগেও ছিলেন ধৈর্য, নম্রতা, স্থিরতার মূর্ত প্রতীক, আজ তিনিই কেমন যেন একটু একটু করে বদলে যাচ্ছেন। পরিবর্তনটা পরিবারের সবার চোখেই প্রকটভাবে ধরা পড়ছে। তিনি নিজেও বুঝতে পারছেন যে এই সুচিত্রা তার সেই চেনা-জানা সুচিত্রা নয়। প্রায়ই স্বামীর সাথে তুচ্ছ বিষয়ে কথা কাটাকাটিতে জড়িয়ে পড়েন, মেয়ে দেখতে এলে তাকে অদ্ভুতভাবে বকাঝকা করেন, নাতি-নাতনিদের সাথেও কেমন যেন শীতল দৃষ্টিভঙ্গি তার। 

মোসাদ্দেক আহমেদ (ছদ্মনাম) দুই দশক ধরে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নিজের মেধা, কর্মদক্ষতা, সৃজনশীলতার সুনিপুণ পরিচয় দিয়ে সম্প্রতি অবসর গ্রহণ করেছেন। কর্মজীবনের পুরোটাই কর্পোরেট দুনিয়া দাপিয়ে শাসন করেছেন। সুদীর্ঘ সময় শেষে অবসর তার জীবনে আশীর্বাদ হয়ে আসবে বলেই তার ধারণা ছিল। সেই ধারণা ইতিমধ্যেই ভুল প্রমাণিত হয়েছে। অদ্ভুত এক বিষণ্ণতায় ভুগছেন মোসাদ্দেক। বিশ বছরের চাকরির দিনগুলোতে কখনোই নিজেকে অসুখী মনে করেননি, হতাশা কখনই তাকে পেয়ে বসেনি। বর্তমান জীবনে তিনি যেন নিজেকেই হারিয়ে খুঁজে চলেছেন প্রতি মুহূর্তে। জীবনে এখন কর্মব্যস্ততা নেই, মানুষের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগের বালাই নেই, কাজের কোনোরকম চাপ নেই, বসের ভয়ের নেই, অধস্তনদের নিয়ন্ত্রণ বা পথ দেখানোর ভাবনা নেই। তবুও জীবন এক অদ্ভুত রকমের অস্বস্তিকর অনুভূতি দিয়ে তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। 

অবসর গ্রহণের জন্য চাই সঠিক সময় ও যথাযথ মানসিক প্রস্তুতি; Image Source: ideas.ted.com © 

প্রিয় পাঠক, এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে, আমাদের আজকের আয়োজনের বিষয়বস্তু হলো অবসর গ্রহণ। যাদের নিজেদের ব্যবসা রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে হয়তো বা অবসর গ্রহণের ধারণাটি কিছুটা বেমানান। আমরা মূলত কথা বলব যারা চাকরিজীবী মানুষজন তাদের কর্ম জীবন, অবসর গ্রহণের বয়স নিয়ে। নিউরোসায়েন্টিস্ট ডেনিয়েল লেভিটিনের মতে,

ব্যস্ত থাকাটা জীবনের সুখের অন্যতম মন্ত্র! যদি তা-ই হয় তবে অবসর গ্রহণের সঠিক সময় কোনটি? কখনোই নয়। 

এখানে ব্যস্ত থাকা বলতে কী বোঝানো হচ্ছে সুস্পষ্টভাবে জেনে নেওয়া দরকার। চাকরিক্ষেত্রে আপনার কাজের একটি লক্ষ্য থাকে। সেটি হতে পারে ব্যবস্থাপনা, লেখালেখি, গবেষণা, বিপণন ইত্যাদি। আপনি সেই একটি কাজ সম্পর্কে বিশদ জ্ঞান রাখেন এবং ঐ সুনির্দিষ্ট কাজটিতে আপনার দক্ষতা আছে। কাজটি করার মাধ্যমে আপনি যে প্রতিষ্ঠানে কর্মরত তার মূল উদ্দেশ্যের একটি অংশ সম্পন্ন হয় এবং আপনি মাস শেষে অর্থ উপার্জন করেন। এই চক্রটি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে সক্রিয় থাকে। অবসর গ্রহণের পর মোটামুটিভাবে এই অভ্যাসটির আচমকা পরিবর্তন হয়।

কর্মক্ষেত্রে সব প্রজন্মের মধ্যে থাকা চাই পারস্পরিক সহমর্মিতাবোধ; Image Source: virily.com

এই বিষয়টিকেই মানুষ সহজভাবে নিতে পারে না। অবসর গ্রহণের পর নিয়মিত সকালে চা পান, সংবাদপত্র পাঠ, বাগানে পানি দেওয়া, বাজার করা, নাতি-নাতনিদের আদর করা, বই পড়া, হাঁটতে বের হওয়া এগুলোকে কোনোভাবেই কাজের আওতায় ফেলা যায় না। লক্ষ্যহীনভাবে নিজেকে অর্থহীন কোনো কাজে ব্যস্ত রাখলেই সে কাজ আপনার জীবনে সুখের ছোঁয়া এনে দেবে না। চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পরেও আপনাকে কোনো অর্থবহ ও উদ্দেশ্যপূর্ণ কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখতে হবে। তাহলে সেই কাজটিই আপনাকে সুখী করবে। গবেষণা বলছে, উদ্দেশ্যহীনভাবে অর্থাৎ শুধু করব বলেই করছি এরকম কাজে ব্যস্ত থাকার মাধ্যমে অবসাদগ্রস্ততা বাড়ে, সুখের ঠিকানা মেলে না। এই বিষয়টির সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে ব্যর্থ হয় বলেই অবসর গ্রহণের পর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ পুনরায় কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করে। 

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিবিদ নিকোল মেস্টাসের মতে,

মস্তিষ্ককে ব্যবহার করতে পারাটা জরুরি। যেকোনো কাজের সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য থাকা আবশ্যক। সুখী থাকতে চাইলে গুরুত্ববহ সামাজিক সম্পর্ক থাকাটাও বাধ্যতামূলক।

সিগমুন্ড ফ্রয়েডের বিভিন্ন তত্ত্ব যদিও পরবর্তীতে এসে ভুল প্রমাণিত হয়েছে, একটি ক্ষেত্রে তার বক্তব্য পুরোপুরি সমর্থনযোগ্য। জীবন সম্পর্কে তার দর্শন ছিল,

মানুষের জীবনে দুটি জিনিস অতীব প্রয়োজনীয়। প্রথমটি ভালোবাসা আর দ্বিতীয়টি কর্মব্যস্ততা।

প্রবীণ নাগরিকদের প্রতি আমরা সবাই কমবেশি উষ্মা প্রকাশ করে থাকি। কর্মক্ষেত্রে তাদের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশের ধরন আরও বেশি তীব্র। এই বিষয়টিতে সকল বয়সের নাগরিকের একসাথে কাজ করা উচিত।

নিউরোসায়েন্টিস্ট ড্যানিয়েল লেভিটিন; Image Source: penguinrandomhouse.com © Larry Moran

যুক্তরাষ্ট্রের কর্পোরেট সংস্কৃতির পুরোটাই মূলত অ্যাজিসমকে সমর্থন করে। অর্থাৎ কর্মরত ব্যক্তির বয়সের উপর নির্ভর করে তার প্রতি স্টেরিওটাইপমূলক ধারণা পোষণ করা ও বৈষম্যের সৃষ্টি করা। বৃদ্ধ হওয়ার সাথে সাথে একজন ব্যক্তির চাকরি পাওয়ার অথবা নিয়োজিত চাকরিতে পদোন্নতির সম্ভাবনা উল্লেখযোগ্য হারে কমে আসে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ চাকরিজীবী স্বীকার করেছেন যে তারা কর্মক্ষেত্রে বয়সের দরুন বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার হয়েছেন। কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্তৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের এই বোধটুকু আসা ভীষণ জরুরি যে তুলনামূলকভাবে বেশি বয়সের কর্মকর্তাদের সম-অধিকার দেওয়া, তাদের জন্য বন্ধুত্বপূর্ণ কর্মক্ষেত্রে তৈরী করা, কাজের সময় তাদের জন্য ভিন্নভাবে নবায়ন করা ইত্যাদি স্রেফ ভালো অনুভব করা বা কোনো ধরনের স্বেচ্ছাসেবীমূলক কাজ নয়। ব্যবসার স্মার্টনেস ধরে রাখার জন্য এটি একটি অত্যাবশ্যকীয় পদক্ষেপ। 

হিথ্রো বিমানবন্দরে ডিমেনশিয়া সেশনের সাথে জড়িত কলাকুশলীরা; Image Source: futuretravelexperience.com

অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ব্রাইট ফোকাস ফাউন্ডেশন আলঝেইমার রোগে আক্রান্ত চাকরিজীবীদের বিষয়ে কিছু অসাধারণ ও এক অর্থে অত্যন্ত মানবিক প্রস্তাবনা তৈরি করেছে:

  • লিখিত অথবা মৌখিক যেকোনো উপায়ে তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে সুন্দরভাবে মনে করিয়ে দেওয়া
  • বৃহৎ পরিসরের কোনো কাজকে একেবারে ক্ষুদ্র আকারে নিয়ে এসে ধীরে ধীরে সম্পন্ন করতে সাহায্য করা
  • কর্মক্ষেত্রে যেকোনো ধরনের পরিবর্তন সাধিত হলে সেই বিষয়ে তাদেরকে যথাযথ প্রশিক্ষণ প্রদান করা
  • কর্মক্ষেত্রে সম্পূর্ণরূপে বিশৃঙ্খলা ও গোলমাল তৈরি থেকে বিরত থাকা
  • প্রতিদিন ও সপ্তাহে কাজের সময়সীমা কমিয়ে আনা
  • প্রতিদিন ব্যক্তির সুবিধাজনক সময়ে তার কাজ করার সুযোগ প্রদান 

এই বিষয়গুলোকে মাথায় রেখেই প্রথম ডিমেনশিয়াবান্ধব বিমানবন্দর হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ত লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দর। ১,০০০ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মচারীদের নিয়ে তারা তাদের এই অসাধারণ উদ্যোগকে নৈপুণ্যের সাথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। যেকোনো প্রকারের কগনিটিভ ইম্পেয়ারমেন্টে আক্রান্ত ব্যক্তিকে সব রকমের সহযোগিতা প্রদানের লক্ষ্যে তারা কাজ করে যাচ্ছেন নিরন্তর।

কর্পোরেট দুনিয়া হয়ে উঠছে অ্যাজিসম চাষের উর্বরক্ষেত্র; Image Source: news.yale.edu

এরপরও কথা থেকেই যায়। যদি একজন ব্যক্তি কোনোভাবেই প্রচলিত অর্থে চাকরি না পান? কিংবা শারীরিক বা মানসিক সীমাবদ্ধতার কারণে যদি তিনি চাকরি করতে ব্যর্থ হন? সে ক্ষেত্রে কি কিছুই করার থাকবে না? যেকোনো সুবিধাবঞ্চিত শিশু-কিশোরদের স্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করাটা হতে পারে একটি চমৎকার উদ্যোগ। কেউ চাইলে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনেও যোগ দিয়ে সমাজের আর্থিকভাবে অনগ্রসর জনগণের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করতে পারে। এএআরপি ফাউন্ডেশনের একটি প্রোগ্রাম আছে যার নাম এক্সপেরিয়েন্স কর্পস। এর আওতায় বিভিন্ন অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবীদের বিভিন্ন পাবলিক  স্কুলে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। সমাজের চোখে যারা অধিক বয়সের কারণে ব্রাত্য জনগণের কাতারে পড়ে আছেন সেসব অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের সেবায় এসব স্কুলপড়ুয়া শিশুদের সাক্ষরতার হার, পরীক্ষার ফলাফল ও সামাজিক দক্ষতা সবকিছুই ইতিবাচকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। 

অবসর গ্রহণের পর জীবনসঙ্গীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা সহজ করতে পারে পরিস্থিতিকে; Image Source: yellowpages.ca

বয়সের সাথে সাথে মানুষের কিছু সীমাবদ্ধতা চলে আসে- এ কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। তবে বয়সের ভারে যারা নিজেকে সমাজের মূল স্রোতধারার বাইরের মানুষ বলে ভাবতে বাধ্য হচ্ছে তাদের পাশে থাকার দায়িত্ব আমার, আপনার- সকলের।

This article is written about the perfect age for having retirement and is written in the Bengali language. All the necessary references are hyperlinked within the article.

Feature Image: fool.com

Related Articles