Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বিশ্বের যত ভয়ঙ্কর ও অবিশ্বাস্য বিদ্যালয় যাত্রাপথ

এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের শিশুদের শিক্ষা গ্রহণের জন্য বিদ্যালয়ে পৌঁছানো কঠিন এক চ্যালেঞ্জ। এখানকার অনেক গ্রামই প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থিত যেখান থেকে বিদ্যালয়ের দূরত্ব এত বেশি যে, শিশুরা বিদ্যালয়ে বা স্কুলে যাওয়ার আগ্রহই হারিয়ে ফেলে। শিশুদের মা-বাবারাও খুব একটা উৎসাহ পান না তাদের সন্তানকে এত দূরের বিদ্যালয়ে পাঠানোর ব্যাপারে। আবার এমনও হয় যে, সন্তানকে কিছুদিন আনা-নেওয়া করার পর বিদ্যালয়ে পাঠানোর ব্যাপারে উৎসাহই হারিয়ে ফেলেন।

ইউনেস্কোর এক সমীক্ষা থেকে জানা যায়, গ্রাম থেকে স্কুলের দূরত্ব দীর্ঘ হওয়ায় এবং প্রতিকূল পরিবেশের কারণে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ২৬.৩ মিলিয়ন এবং বিশ্বের ২৬০ মিলিয়ন শিশু শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। প্রতি বছর সারা বিশ্ব জুড়ে ৮ সেপ্টেম্বর বিশ্ব স্বাক্ষরতা দিবস পালন করলেও ‘সবার জন্য শিক্ষা’- বিষয়টি এখনো শুধুমাত্র স্লোগানেই সীমাবদ্ধ। তারপরও এশিয়া ও পৃথিবীর বিভিন্ন দুর্গম অঞ্চলের শিশুরা শিক্ষার আলোতে আলোকিত হওয়ার জন্য নানা বিপদসঙ্কুল পথ পাড়ি দিয়ে নিয়মিত বিদ্যালয়ে যায়। আর এভাবেই সমস্ত প্রতিকূলতা কাটিয়ে তাদের পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে।

ইন্দোনেশিয়ার রোয়া নদীর তীরবর্তী গ্রামের স্কুলগামী ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা এভাবে প্রতিদিন নৌকায় চেপে জঙ্গলের পথ অতিক্রম করে বিদ্যালয়ে পৌঁছায়; Source: earthporm.com

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এমন কিছু দুর্গম অঞ্চল রয়েছে যেখানে আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। বর্তমানে বিজ্ঞানের উৎকর্ষতার যুগে এসেও পৃথিবীর অনেক দেশে আজও বিদ্যালয়ে যাওয়া একেবারেই সহজসাধ্য বা আনন্দের কিছু নয়। সে এক ভয়ংকর অভিজ্ঞতা। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের শিশুরা বিদ্যালয়ে যাওয়ার জন্য ব্যবহার করে নৌকার ভেলা কিংবা নিস্তব্ধতায় মোড়া ভয়ঙ্কর জঙ্গল  বা পাহাড়ি কোনো সংকীর্ণ পথ। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের শিশুদের বিপদসঙ্কুল বিদ্যালয়ে যাত্রাপথের গল্প দিয়ে সাজানো আজকের এই আয়োজন।

দক্ষিণ চিনের ঝাং ঝিওয়ান গ্রাম

দক্ষিণ চীনের হুনান প্রদেশের পাহাড়ের কোলে ঝাং ঝিওয়ান গ্রামটি অবস্থিত। গ্রামটির আশেপাশের এলাকার শিশুদের জন্য নেই কোনো বিদ্যালয়। পাহাড় পেরিয়ে দূরবর্তী এক বিদ্যালয়ে যেতে হয় তাদের। সেই পাহাড় পেরোনোর জন্য শিশুদেরকে বিশেষ কাঠের তৈরি মই ব্যবহার করতে হয়। ৬০ মিটার লম্বা কাঠের তৈরি মইটিতে শিশুদের নেই কোনো সুরক্ষা ব্যবস্থা। যেকোনো সময় পিচ্ছিল এই কাঠের সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা থেকেই যায়।

মই ব্যবহার করে পাহাড়ি পথ পাড়ি দেয় দক্ষিণ চিনের ঝাং ঝিওয়ান গ্রামের বিদ্যালয়গামী ছাত্র-ছাত্রীরা; Source: boredpanda.com

সম্পূর্ণ অসুরক্ষিত অবস্থায় শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা যেকোনো ঋতুতে এভাবেই নিয়মিত মই বেয়ে পাহাড় ডিঙিয়েই বিদ্যালয়ে পৌঁছতে হয় এসব শিশুদের এবং এলাকার অধিবাসীদের। স্থানীয়দের দ্বারা তৈরি সিঁড়িটি ৩-৫ বছর অন্তর অন্তর পরিবর্তন করা হয়। বিদ্যালয়ে যাওয়ার বিকল্প একটি পথ রয়েছে বটে, কিন্তু সেই পথ দিয়ে যেতে সময় লাগে ৪-৫ ঘন্টা।

ইন্দোনেশিয়ার লিবাক

ইন্দোনেশিয়ার লিবাক অঞ্চলের সাংঘিয়ান তানজুয়াং গ্রামের অধিবাসীদের নদী পারাপারের জন্য ব্যবহার করতে হয় একটি ভাঙা ঝুলন্ত সেতু। সেতুর নিচ দিয়ে বয়ে চলেছে খরস্রোতা চিরাঙ নদী।

ভাঙা ঝুলন্ত সেতু এভাবেই পাড়ি দিয়ে স্কুলে পৌঁছায় ইন্দোনেশিয়ার সাংঘিয়ান তানজুয়াং গ্রামের শিশুরা; Source: boredpanda.com

শুধু গ্রামের অধিবাসীদেরকেই নয়, গ্রামের শিশুরাও এই সেতু ব্যবহার করে থাকে। গ্রামের বিদ্যালয়গামী শিশুরা প্রতিদিন ঠিক সময়ে স্কুলে পৌঁছানোর জন্য এই ভাঙা সেতুই ব্যবহার করে থাকে।

ঝাঙ্কার গ্রাম, ভারত

ভারতের জম্মু ও কাশ্মির রাজ্যের কার্গিল জেলায় অবস্থিত ঝাঙ্কার গ্রামটি। হিমালয়ের পাদদেশে এক মনোরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যেঘেরা গ্রামটিতে যোগাযোগ ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। গ্রাম থেকে বিদ্যালয়ে যাতায়াত করা দুরূহ বলে গ্রামের শিশুদেরকে স্কুলের হোস্টেল থেকে পড়াশোনা করতে হয়। কিন্তু গ্রাম থেকে শিশুদেরকে এই আবাসিক বিদ্যালয়ে যেতে পাড়ি দিতে হয় এক দুর্গম পথ। হিমালয়ের কাছাকাছি হওয়ায় পথটি প্রায় সময় থাকে বরফে ঢাকা। এই বরফে ঢাকা পিচ্ছিল পথ পাড়ি দিয়ে তাদের সেই আবাসিক বিদ্যালয়ে যেতে হয়।

পিচ্ছিল বরফে ঢাকা পথ পাড়ি দিয়ে আবাসিক বিদ্যালয়ে পৌঁছায় ঝাঙ্কার গ্রামের ছেলেমেয়েল দল; Source: boredpanda.com

ধায়িং গ্রাম, নেপাল

নেপালের পাহাড়ী অঞ্চলে ভালো রাস্তা নেই বললেই চলে পাহাড়ের নিবিড় ছায়ায় গড়ে উঠেছে ছোট ছোট গ্রাম। তেমনি একটি গ্রাম ধায়িং। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে পাহাড়ি নদী ত্রিশুল। গ্রামের মানুষদের এই নদী পারাপারের জন্য নেই কোনো সেতু। আর এই গ্রামের শিশুদের স্কুলযাত্রা তাই বেশ দুর্গমই বলা চলে। শিশুদের জন্য এটি বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক স্কুলযাত্রা হিসেবে পরিচিত।

দড়িটানা সেতু ব্যবহার করে নদী পার হয়ে স্কুলে যেতে হয় ধায়িং গ্রামের বিদ্যালয়গামী শিশুরা; Source: New York Post

প্রতিদিন স্কুলে যাওয়ার জন্য এই গ্রামের শিশুদেরকে নদী পারপারের জন্য দড়িটানা সেতু ব্যবহার করতে হয়। এই সেতু পার হওয়ার জন্য তারা ব্যবহার করে দড়ি, কাঠের বা লোহার পাল্লা। শুধু শিশুরাই নয়, গ্রামবাসীরাও এই পথ ব্যবহার করেই তাদের দৈনন্দিন কাজ করে থাকে। এভাবে সেতু অতিক্রম খুব ‍বিপদজনক এবং রয়েছে মারাত্মক মৃত্যুর ঝুঁকিও। ২০১০ সালে এভাবে সেতু পারাপার করতে গিয়ে ৫ জনের মৃত্যু ঘটে। তারপরও শিক্ষার আলোয় নিজেদেরকে উদ্ভাসিত করার জন্য ধায়িং গ্রামের মতো আশেপাশের গ্রামের শিশুরা এভাবে সেতু পারাপার করে তাদের বিদ্যালয়ে পৌঁছায়।

রিজাল প্রদেশ, ফিলিপাইন

ফিলিপিনের দুর্গম অঞ্চলে ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থ না থাকার কারণে এসব অঞ্চলের শিশুদের বিদ্যালয়ে যাওয়ার প্রবণতা খুবই কম। তার মধ্যে ব্যতিক্রম রিজাল প্রদেশের একটি প্রত্যন্ত গ্রাম। এই  গ্রামের শিশুদেরকে বিদ্যালয়ে যাওয়ার জন্য পাড়ি দিতে হয় সোলেন নদী। নদীর ওপর কোনো সেতু না থাকায় বাড়ি থেকে প্রায় আধ ঘন্টা দুরত্ব অতিক্রম করে তারা বিদ্যালয়ে পৌঁছায়।

গাড়ির চাকার বায়ু ভর্তি টিউব দিয়ে নদী পার হয়ে বিদ্যালয়ে যাতায়াত করে রিজাল প্রদেশের গ্রাম্য শিশুরা; Source: awesomeinventions.com

নদী অতিক্রম করার জন্য তারা কোনো পাল তোলা নৌকা বা ভেলা ব্যবহার করে না। এই নদী পারাপারের জন্য তাদের একমাত্র ভরসা গাড়ির চাকার বায়ু ভর্তি টিউব। শুধু গ্রীষ্মকালেই নদী যখন শান্ত থাকে তখনই নয়, সারা বছরই বিদ্যালয়ে পৌঁছানোর জন্য এভাবে তারা নদী পাড়ি দিয়ে থাকে। আবহাওয়া খারাপ থাকলে সেসব দিন এসব শিশুদের বিদ্যালয়ে যাওয়া বন্ধ থাকে নয়তো বা বিদ্যালয়ে কাছাকাছি কোনো আত্মীয়ের বাড়িতে তাদেরকে রাখা হয়।

গ্রাম গুলু, সিচুয়ান প্রদেশ, চীন

চীনের সিচুয়ান প্রদেশের এক দুর্গম গ্রাম গুলু। গ্রামের শিশুদের জন্য যে বিদ্যালয়টি রয়েছে তা অতিক্রম করার জন্য এক পাহাড়ি রাস্তা পাড়ি দিতে হয়। এক ফুট চওড়া পাহাড়ি পথ বেয়ে ৫ ঘন্টার এক দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে গ্রামের শিশুদেরকে বিদ্যালয়ে যেতে হয়। অনেকে এই পথ দিয়ে না গিয়ে অন্য আরেকটি পথও ব্যবহার করে থাকে।

পাহাড়ী সঙ্কীর্ণ পথ পাড়ি দিয়ে স্কুলে যেতে হয় গুলু গ্রামের ছেলেমেয়েদের; Source: earthporm.com

অবশ্য সেই পথটিও বেশ বন্ধুর। এই পথ দিয়ে যাওয়ার জন্য গ্রামের অবস্থাপন্ন পরিবারের শিশুদেরকে তাদের অভিভাবকরা ঘোড়া ওপর বসিয়ে এই পথ পাড়ি দিয়ে বিদ্যালয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে। যাত্রাপথটি যেমনি দুর্গম, তেমনি বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। বিদ্যালয়ের এই যাত্রাপথ বিশ্বের সবচেয়ে প্রত্যন্ত ও দূরবর্তী বিদ্যালয় যাত্রাপথ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

কেউ কেউ ঘোড়ায় চড়ে এই পাহাড়ি পথ পাড়ি দেয়; Source: theirworld.org

বারমার, রাজস্থান

বারমার স্কুলটি ভারতের রাজস্থানের থর মরুভূমিতে অবস্থিত। বিদ্যালয়টিতে যাওয়ার জন্য শিশুদের মরুভূমির ওপর দিয়ে বেশ কিছুটা পথ পাড়ি দিতে হয়। গ্রীষ্মকালে অঞ্চলটির তাপমাত্র ৫০ডিগ্রি পর্যন্ত হয়ে থাকে।

তপ্ত মরুভূমি পাড়ি দিয়ে বিদ্যালয়ে পৌঁছে বারমার গ্রামে শিশুকিশোরের দল; Source: wvi.org

এই সময়টাতে বিদ্যালয়ে যাওয়ার জন্য শিশুদেরকে স্কুল শুরু হওয়ার বেশ আগেই রওনা দিতে হয়। তারপরও বিদ্যালয় থেকে ফেরার পথটা তাদের জন্য বেশ দুর্বিষহ হয়ে ওঠে।

রিয়ো নেগ্রো নদী, কলম্বিয়া

কলম্বিয়ার রিও নদীর তীরে অবস্থিত গ্রামগুলোর মানুষদের যোগযোগের জন্য রিয়ো নেগ্রো নদী থেকে ৪০০ মিটার ওপরে অবস্থিত ৮০০ মিটারের স্টিল ক্যাবলে ঝুলে যাতায়াত করতে হয়। শুধু গ্রামবাসীদেরকেই নয় গ্রামের শিশুদেরকেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এই পথ অতিক্রম করেই বিদ্যালয়ের ক্লাসে নিয়মিত অংশগ্রহণ করতে হয়।

স্টিল ক্যাবলে ঝুলে রিয়ো নেগ্রো নদী পাড়ি দেয় স্কুল যাত্রী ছেলেমেয়েরা; Source: awesomeinventions.com

এই কেবল সিস্টেমের গতিবেগ ঘন্টায় ৮০ কিলোমিটার। এই কেবল সিস্টেম নদীর দুইপাশেই আছে। তবে এভাবে নদী পার হতে সময় লাগে এক মিনিট। এর গতিবেগ এত বেশি যে, তা শিশুদের জন্য তা বেশ বিপদজনক বটে। তারপরও রিওগ্রামের শিশুরা শিক্ষাগ্রহণের জন্য এভাবেই বিদ্যালয়ে নিয়মিত যাতায়াত করে।

ফিচার ইমেজ- youtube.com

Related Articles