১৬০০ পেনিনসুলা এ্যাভিনিউ, নিউ ইয়র্ক, ওয়াশিংটন ডিসি। মার্কিন মুল্লুকের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থানের ঠিকানা এটি। এই ঠিকানা কার? নির্দিষ্ট কারো ঠিকানা নয় এটি, তবে বর্তমানে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এখানে বসবাস করেন। ঠিক ধরেছেন, বলছিলাম ১৭৯২ সালে নির্মিত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতির কর্মস্থল হোয়াইট হাউজের কথা।
বছর যায়, হোয়াইট হাউজের ক্ষমতা হাতবদল হয়। সেইসাথে একেকজন নতুন ক্ষমতাধরের ঠিকানা হয় এই হোয়াইট হাউজ। তবে কেবল রাষ্ট্রপতি নয়, প্রতি বছর আরো অনেকে আসেন এখানে। কেউ কর্মী হয়ে, কেউ নিরাপত্তারক্ষী, কেউ আবার চিকিৎসক! তাদের কথা ক’জন জানে? কেমন হয় হোয়াইট হাউজের একজন চিকিৎসকের জীবন? কাজটা কি আনন্দদায়ক, নাকি নিয়ম-শৃঙ্খলায় মোড়া?
আজ চলুন জেনে আসি হোয়াইট হাউজে চিকিৎসার কাজে নিয়োজিত মানুষগুলোকে নিয়ে মজার কিছু ব্যাপার।
অদৃশ্য ছায়াসঙ্গী
প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের সময় তার চিকিৎসার জন্য নিয়োজিত ছিলেন ডক্টর এলেনর মারিয়ানো। প্রেসিডেন্টের জন্য কাজ করা নিয়ে বিল ক্লিনটন মারিয়ানোকে বলেছিলেন, “তুমি মরে গেলে আমার সেবা করতে পারবে না”। আর তাই সবসময় রাষ্ট্রপতিকে বাঁচিয়ে রাখাটাকেই হোয়াইট হাউজের চিকিৎসকের কাজ হিসেবে ধরে নেওয়া হয়েছে। সেটা কোনো অসুখের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার ক্ষেত্রে হোক কিংবা কোনো আক্রমণকারীর হাত থেকে বন্দুক কেড়ে নেওয়া হোক।
তবে এ ব্যাপারে বেশ দ্বন্ধ কাজ করে হোয়াইট হাউজের প্রত্যেকটি চিকিৎসকের ভেতরে। একদিকে নিজেদের পেশাদার প্রতিজ্ঞা ভেঙ্গে যাওয়ার ভয়, অন্যদিকে রাষ্ট্রপতির সুরক্ষা নিশ্চিত করা। দুটোই কি কম কঠিন কাজ? বিশেষ করে কাজটা যখন করতে হয় অদৃশ্য হয়ে!
হোয়াইট হাউজ থেকে নির্দেশ দেওয়া আছে যে, এখানকার চিকিৎসকেরা রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকার চেষ্টা করবেন। তাদেরকে সাদা পোশাকে থেকে প্রেসিডেন্টের আশেপাশে থাকতে বলা হয়, যাতে প্রেসিডেন্টকে কেউ হত্যার চেষ্টা না করতে পারে।
তারা যেন হোয়াইট হাউজের কেউ নন!
ঠিক ধরেছেন! হয়তো বাইরে অনেকের কাছে হোয়াইট হাউজের চিকিৎসক হওয়াটা অনেক বেশি সম্মানজনক এবং আকর্ষণীয় ব্যাপার। তবে বাস্তবে হোয়াইট হাউজের চিকিৎসক হিসেবে কাজ করাটা কতটা যে বিরক্তিকর, একঘেয়ে এবং প্রশংসাহীন সেটা সম্পর্কে ব্যক্তিগত অভিমত জানান প্রেসিডেন্ট রোনাল রিগানের ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডক্টর ড্যানিয়েল রুজ।
বাধ্য হয়ে ১৯৮৫ সালে নিজের কাজ ছেড়ে দেন তিনি। তার মতে পুরো ব্যাপারটাই ছিল কোনো কিছু না করে বসে থাকা কিংবা করলেও কোনো প্রশংসা না পাওয়া। নিজের কাজ নিয়ে একটা সময় ভয়ানক রকমের হতাশ হয়ে পড়েন ড্যানিয়াল। তার ভাষ্যমতে, প্রতি রাতে বসে বসে মেডিকেল জার্নাল পড়া, ধাঁধা মেলানো আর ভবিষ্যত নিয়ে ভাবতে থাকা- এভাবেই কেটে যায় হোয়াইট হাউজের চিকিৎসকদের প্রতিটি রাত। হোয়াইট হাউজের অংশ হয়েও স্টেট অনুষ্ঠানগুলোতে ডাক খুব কম পড়ে তাদের। মোটকথা, হয়তো তারা হোয়াইট হাউজে কাজ করেন, তবু দিনশেষে তেমন মনে হয় না!
অন্ধকারের হাতছানি
এ্যান্ড্রু জ্যাকসন, ১৮১২ সালের বিশ্বযুদ্ধে সাহসী সৈনিকের মতো লড়াই করেছেন তিনি। কিন্তু পরবর্তীতে বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং মৃত্যুবরণ করেন। ব্যাপারটা হয়তো এখানেই শেষ হয়ে যেতে পারতো। কিন্তু তা হয়নি। কালির প্রলেপ পড়ে যায় হোয়াইট হাউজের চিকিৎসকদের মুখে এই একজন মানুষের মৃত্যুতে। পরীক্ষা করে জানা যায়, এ্যান্ড্রু জ্যাকসনের মৃত্যুর পেছনে ছিল ধীরে ধীরে তার শরীরে ছড়িয়ে দেওয়া পারদ।
পারদের কারণেই অল্প অল্প করে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন এই সাহসী সৈনিক। আর এই পুরো দোষটা পড়ে হোয়াইট হাউজের চিকিৎসকদের উপরে। ইতিহাসে কেবল হোয়াইট হাউজের বাসিন্দাদের শারীরিক সুস্থতাই নয়, অসুস্থতার পেছনেও এমন ভূমিকা রাখার অভিযোগ আছে এখানকার চিকিৎসকদের নিয়ে।
রহস্যের খাসমহল
উড্রো উইলসনের নাম তো প্রায় সবাই শুনেছেন। কিন্তু তার যে প্যারালাইজিং স্ট্রোক নামক ভয়ানক এক সমস্যা ছিল সেটা কি জানেন? আর প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট? হৃদপিণ্ডজনিত সমস্যার কারণে প্রায় মৃত্যুর দ্বারগোড়ায় দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। তবে এগুলোর কোনোটাই তখন কেউ জানতে পারেনি।
বর্তমানে প্রেসিডেন্টদের শারীরিক যেকোনো সমস্যা সম্পর্কে সবাইকে জানানো খুব স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে পড়েছে। আগে এমনটা ছিল না। তখন কেবল হোয়াইট হাউজের চিকিৎসকেরা জানতেন প্রেসিডেন্টদের শারীরিক সমস্যা সম্পর্কে আর সেটা সবসময় গোপন করে রাখতেন তারা। লুকিয়ে রাখতেন বাকি পৃথিবীর কাছ থেকে। সেদিক দিয়ে অতীতের হোয়াইট হাউজে কর্মরত চিকিৎসকদের রহস্যের একটা বড় ডিপো বলা যায়।
প্রথম নারী চিকিৎসক
হোয়াইট হাউজে চিকিৎসক তো অনেকে এসেছেন, অনেকে আসবেন। তবে তাদের মধ্যে অন্যরকম একটি অবস্থান দখল করে আছেন ডক্টর জ্যানেট ট্রাভেল। ১৯৬১ সালে জন এফ কেনেডির চিকিৎসক হয়ে হোয়াইট হাউজে আসেন তিনি। তবে শুরু থেকে সামরিক রোষের স্বীকার হন এই নারী। তাদের জন্য বেশ হুমকির হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন জ্যানেট।
সবকিছু মিলিয়ে অবশেষে কেনেডির সাথে কথা বলেন এই নারী চিকিৎসক। কেনেডি তাকে শান্ত কন্ঠে জানিয়ে দেন, “তোমাকে কোথাও যেতে হবে না। তোমার যাওয়ার সময় হলে আমি জানাবো“। কেনেডির মৃত্যুর পরেও জ্যানেট হোয়াইট হাউজে ছিলেন। তাকে আর কেউ কোনদিন চলে যেতে বলেনি। ৯৫ বছর বয়সে মারা যান এই নারী।
জন এফ কেনেডির বেশ কিছু শারীরিক সমস্যায় সাহায্য করেন জ্যানেট। তিনিই প্রথম খেয়াল করেন, কেনেডির এক পা ছোট। ফলে প্রেসিডেন্টের জুতো পরার ব্যাপারে কিছু পরিবর্তন আনেন। এছাড়াও নানারকম পরিবর্তন আনেন তিনি হোয়াইট হাউজে তার কাজ করার সময়গুলোতে।
অজ্ঞতার পরাকাষ্ঠা
অনেকের কাছে হোয়াইট হাউজের চিকিৎসক বলতেই অত্যন্ত ভালো, দক্ষ কোনো চিকিৎসকের ছবি ভেসে ওঠে। কিন্তু ব্যাপারটা কি আসলে তা-ই ছিল? না। হোয়াইট হাউজের অনেক ভুলের পেছনে হাত আছে চিকিৎসকদেরও। প্রেসিডেন্ট জেমস এ গারফিল্ডের কথাই ধরা যাক। এক ট্রেন স্টেশনে তাকে গুলি করে আততায়ী। আততায়ীকে ধরা হয়, কিন্তু গারফিল্ডকে আর বাঁচানো সম্ভব হয়নি। কেন?
কারণ চিকিৎসকদের মনে হয়েছিল গুলি এখনো গারফিল্ডের শরীরের ভেতরেই আছে। আর সেজন্যেই দিন দিন অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন প্রেসিডেন্ট গারফিল্ড। এই দায়িত্বের শিরোমণি হয়ে ছিলেন ডক্টর ডি উইলার্ড ব্লিস। গারফিল্ডের তখন অত্যন্ত খারাপ অবস্থা। কিছু খেতে পারছেন না তিনি। ওজন ৯৫ কেজি থেকে কমে নেমে এসেছে ৫৯ কেজিতে। কিন্তু তখনো শরীরের ভেতরে গুলিটাকেই খুঁজে বেড়াচ্ছেন সবাই। প্রচন্ড কষ্ট পেয়ে ১৯৮৮ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করেন গারফিল্ড। তা-ও প্রেসিডেন্ট হিসেবে যোগদানের ঠিক ৪ মাসের মাথায়!
এরপর অবশ্য গারফিল্ডের খুনী চার্লস গ্যুটেও এর ফাঁসি হয়। মৃত্যুর আগে হাসতে হাসতে চার্লস বলেছিলো, “আমি তো কেবল গুলি করেছি। আর তোমরা তাকে মেরে ফেলেছ“।
চিকিৎসক যখন রাষ্ট্রীয় দূত
ঘটনাটি খুব গোপনে সম্পাদিত হয়েছিলো। সৌদি আরবের সাথে আমেরিকার সম্পর্ক তখন বেশ খারাপ। ১৯৫০ সাল, এমন সময় হঠাৎ খুব অদ্ভুত আর অপ্রত্যাশিত অনুরোধ পেলেন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান। অনুরোধ এসেছিলো রাজা ইবন সউদের কাছ থেকে। অস্টিওআর্থ্রাইটিসের যন্ত্রণায় তখন হুইল চেয়ারে পড়েছিলেন সৌদি আরবের এই রাজা। ট্রুম্যানের কাছে তার অনুরোধ ছিল একজন ভালো চিকিৎসক পাঠানোর।
ট্রুম্যান অবাক হলেও নিজের ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডক্টর গ্রাহামকে পাঠিয়ে দেন। কাউকে কিছু না জানিয়েই কাজটি করা হয়। সুস্থ হয়ে ওঠেন রাজা। ফলাফল? দুই দেশের মধ্যে সুসম্পর্ক আর না চাইতেও হোয়াইট হাউজের একজন চিকিৎসকের রাষ্ট্রদূত হিসেবে কাজ করা।