সুর যেমন একজন শ্রোতার মনকে করে তোলে আন্দোলিত, ঠিক তেমনি সুরকার তার মনোজগতে প্রতিনিয়ত করে চলেন সেই সুরেরই ব্যবচ্ছেদ। একটি সফল সুরের পরপরই ঠিক সেই সুরের সাফল্যের ব্যাপরেও তিনি থাকেন সদা সচেষ্ট। বিশ্ব ক্লাসিক্যাল সুরের জগতে আমরা এমন অনেক সুরকারকে পেয়েছি যাদের সুর এখনো আমাদেরকে বিহ্বল করে। তবে সুরকারদের জীবনেও যে অভিশাপের কালো ছায়া রয়েছে, তা কি কেউ কখনও ভাবতে পেরেছেন? বিশ্ব সঙ্গীতের ইতিহাসে অনেক সুরকারই ৯ নং সিম্ফনিকে সমীহের চোখে দেখে থাকেন। অবশ্য এই সমীহের পিছনে রয়েছে খানিকটা ভয় আর গা ছমছমে অনুভূতি। ইউরোপীয় ধ্রুপদী সঙ্গীতের জগতেও এমনই এক সংস্কার এখনও বহমান রয়েছে ৯ নম্বরটিকে ঘিরে।
৯ নং সিম্ফনি এমনই এক অভিশপ্ত সিম্ফনি যা প্রতিনিয়ত তাড়া করছে একজন সুরকারকে। আপনার কি বিশ্বাস হয়? বিশ্বাস করুন আর না-ই করুন, এটা সত্যি যে ৯ নং সিম্ফনি রচনা করতে গিয়ে মারা গিয়েছেন পৃথিবীখ্যাত অনেক দিকপাল সুরকার। তাই অনেকেই ৯ নং সিম্ফনিকে ‘সিম্ফনি অফ ডেথ’ বা ‘কার্সড নাম্বার ফর সিম্ফনি’ বলে অভিহিত করে থাকেন।
এমনটা অনেকেই মনে করেন যে, অন্ধবিশ্বাস মানুষের স্নায়ুকে উদ্বিগ্ন করে তোলে। অনেকেই বিষয়টি মনে করলেও পৃথিবীতে এমন অনেক সুরকার আছেন যারা এই অন্ধবিশ্বাসকে হয়তো মনের অজান্তেই লালন করেন। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ইতিহাস থেকে দেখা যায়, দশম সিম্ফনি খুবই বিরল। দেখা গেছে, অনেক বিখ্যাত সুরস্রষ্টা তাদের ৯ নং সিম্ফনি রচনা করতে গিয়ে অথবা ৯ নং সিম্ফনি রচনা শেষ করে অথবা ৯ নং রচনা শুরু করে মারা যান। এ কারণে অনেকেই ৯ নং সিম্ফনিকে ‘সিম্ফনি অফ ডেথ’ বলে মনে করেন। ৯ নং সিম্ফনির অভিশাপ শুরু মহান সুর সম্রাট বিথোভেনকে দিয়ে। তিনি তার মৃত্যুর তিন বছর আগে তার নবম সিম্ফনি সম্পন্ন করেন। কিন্তু এরপর দশম সিম্ফনির শুধুমাত্র খসড়াটা সম্পন্ন করার সুযোগ পেয়েছিলেন।
অস্ট্রিয়ান সুরস্রষ্টা আর্নল্ড শোয়েনবার্গ দেখিয়েছেন, এই ৯ সংক্রান্ত ভাবনা শুরু হয় অস্ট্রিয়ার সুরস্রষ্টা গুস্তাভ মাহ্লারকে ঘিরে। মাহ্লার তার ৯ নং সিম্ফনিটি রচনার পরেই মারা যান। ১০ নং আর তার পক্ষে রচনা করা সম্ভব হয়নি। ৯নং সিম্ফনির অভিশাপের তালিকায় আরও রয়েছেন ফ্রাঞ্জ স্কুবার্ট, আন্তোনিয়ন ডোভারক, অ্যান্টন ব্রেকারনার, গুস্তাভ মাহেলার, কার্ট এটারবার্গ, রালফ ভন উইলিয়ামস, রজার সেশন, ইগন ওয়েলসেজ, আলেকজান্ডার গ্লাজুনভ এবং ম্যালকম আর্নল্ডের মতো অনেকে। এসব সুরকারদের মধ্যে অনেকেই ৯ নং লিখতে গিয়ে, নতুবা তা সমাপ্ত করেই মারা গিয়েছেন। ৯ নং সিম্ফনির অভিশাপের শিকারের সংখ্যা খুব একটা কম নয়। এ পর্যন্ত প্রায় ২৭ জন সুরকার এই অভিশাপের শিকার হয়েছেন। আজ পর্যন্ত এই রহস্যের কোনো সমাধান হয়নি। এখনও এ নিয়ে অনুসন্ধান করে চলেছেন প্যারানর্মাল বিশেষজ্ঞরা।
লুডউইগ ভ্যান বিথোভেন
জার্মান সুরকার এবং পিয়ানো বাদক বিথোভেনকে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ সুরকারদের একজন ভাবা হয়। তিনি পাশ্চাত্য সঙ্গীতের ক্লাসিকাল ও রোমান্টিক যুগের একজন প্রভাবশালী সুরকার। তার উদ্ভাবনী অর্কেস্ট্রেশন বিশ্ব সুরশ্রোতাদের দিনের পর দিন মোহিত করে রেখেছে। সুরজগতে তার অবদান ও খ্যাতি পরবর্তী প্রজন্মের সুরকার, সঙ্গীতজ্ঞ ও শ্রোতাদের অনুপ্রাণিত করেছে। ব্যক্তিগত বিপর্যয়ের মাঝেও তিনি বিশ্বকে বহুদিন ধরে অসাধারণ সব মাস্টারপিস উপহার দিয়ে যান।
৯ম সিম্ফনির প্রথম শিকার হিসেবে বিথোভেনের নাম আসবে সর্বাগ্রে। তার তৈরি ৯ নং সিম্ফনি ছিল তার জীবনের শেষ সুর। ৮ম সিম্ফনি পর্যন্ত যে সুর অবলীলায় করে বিশ্ব জগতকে মোহিত করেছেন তারপরেই ৯ নং সিম্ফনি তার জীবনকে করে দিল সংক্ষিপ্ত। তবে তিনিই ৯ নং সিম্ফনিটি সমাপ্ত করতে পেরেছিলেন। যদিও ১০ নং সিম্ফনির কাজে তিনি হাত দিয়েছিলেন, কিন্তু তা অসমাপ্তই থেকে যায়।
অ্যান্টন ব্র্যাকনার
অস্ট্রিয়ান সুরকার অ্যান্টন ব্র্যাকনার ছিলেন তার সময়ের সবচেয়ে সমালোচনায় বিদ্ধ সুরকার। অ্যান্টন ব্র্যাকনারের একটি অভ্যাস ছিল। তিনি একটি সুর সমাপ্ত করার পর সেই সুর নিয়ে পুনরায় কাজ করতেন এবং সেই সুরের পরিবর্তন ঘটাতেন। সমালোচকেরা তার এই কাজের খুবই সমালোচনা করতেন। তিনি তার নবম সিম্ফনির কাজ শুরু করার পর তা অসমাপ্ত রেখেই আবার পূর্বের সমাপ্ত হওয়া ৮ম সিম্ফনি নিয়ে পুনরায় কাজ শুরু করেন। কিন্তু ৯ নং সিম্ফনি সমাপ্ত করার পূর্বেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ভাগ্য তাকে ৯ম সিম্ফনি সমাপ্তের জন্য পর্যাপ্ত সময় দেয়নি।
রালফ ভন উইলিয়ামস
রালফ ভন উইলিয়ামস তার সময়ের একজন ব্যস্ত সুরকার ছিলেন। তিনি তার কনসার্ট, ব্যালেট, চলচ্চিত্রের সঙ্গীতের জন্য ৯ নং সিম্ফনি তৈরি করেন। তিন সপ্তাহ পর ৯ নং সিম্ফনির প্রিমিয়ারের দিনটিতে তিনি হঠাৎই মৃত্যুবরণ করেন, যদিও সে সময় তার বয়স হয়েছিল ৮৬ বছর। কিন্তু তিনি ছিলেন যথেষ্ট স্বাস্থ্য সচেতন। তার এক পারিবারিক বন্ধু জানান যে, প্রিমিয়ারের আগের দিনও উইলিয়ামস বেশ সুস্থ ও একেবারে স্বাভাবিক ছিলেন। পরের দিন সকালে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং খুব দ্রুতই মারা যান।
আন্তোনিয়ন ডোভারক
আন্তোনিয়ন ডোভারক তার জনপ্রিয় নবম সিম্ফনি, ‘ফ্রম দ্য নিউ ওয়ার্ল্ড’ এর জন্য বিখ্যাত ছিলেন, যদিও এর প্রিমিয়ারের সময় তা পঞ্চম সিম্ফনি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। মৃত্যুর পর তার তৈরি চারটি সিম্ফনি আবিষ্কৃত না হওয়া পর্যন্ত ‘নিউ ওয়ার্ল্ড’-এর ডিস্কটি ৯ নং সিম্ফনি হিসেবেই লেবেলিং করা হয়। শ্রোতারা তার পূর্বের কাজগুলো সম্পর্কে পরিচিত না হলেও ভাগ্য ঠিকই তার হিসেব রেখেছে। ‘নিউ ওয়ার্ল্ড’ ছিল ডোভারকের জীবনের শেষ সিম্ফনি।
গুস্তাভ মাহেলার
মান্টিক যুগের অস্ট্রিয়ান রোমান্টিক সুরকার গুস্তাভ মাহেলারই প্রথম নবম সিম্ফনির অভিশপ্ততার বিষয়ে এক ধরনের অন্ধ বিশ্বাস ছিল। তিনি প্রায় বলতেন ৯ নং সিম্ফনির কাজ করা মানে হচ্ছে মৃত্যু ঘরে ডেকে আনা। নবম সিম্ফনি নিয়ে সবসময় তার মনের মধ্যে এক ধরনের ভয় কাজ করতো। তিনি এ থেকে পরিত্রাণের নানা উপায় খুঁজতে শুরু করলেন। অনেক ভেবেচিন্তে একটি উপায়ও বের করে ফেলেছিলেন।
অষ্টম সিম্ফনির কাজ সমাপ্ত করার পর তিনি ভিন্ন কিছু করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি একটি সঙ্গীতের সুরের খসড়া করেন যার নাম দেন ‘Das Lied von der Erd ’ এবং এতে যে সুর বসান তাকে তিনি সিম্ফনি বলতে চাননি। আর এর মধ্যে দিয়ে তিনি ভাবতে থাকেন ৯নং অভিশাপ থেকে মুক্তি পাওয়া গেল। কিন্তু ১০ নং সিম্ফনির কিছু অংশের কাজ করার পরেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
আমেরিকান সুরকার ফিলিপ গ্লাস ৯ম সিম্ফনির আগে দশম সিম্ফনি সমাপ্ত করেন। তিনি কখনই ৯ম সিম্ফনি শেষ এমনতর ইচ্ছে পোষণ করেননি। এ প্রসঙ্গে তাকে বারবার জিজ্ঞেস করা হলেও তিনি প্রশ্নটি এড়িয়ে যেতেন। হয়তো তিনি মনে মনে তার ভাগ্যকে অভিশপ্ত ৯ নং সিম্ফনির হাতে তুলে দিতে চাননি।
কিন্তু মজার ব্যাপার এই যে, বিথোভেনের আগের কম্পোজাররা কেউই এই ৯ এর অভিশাপের শিকার হননি। মোৎজার্টই তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। তবে বর্তমানের অনেক নামকরা সুরকারই এই অভিশাপকে খুব একটা গুরুত্ব দিতে চান না। ব্রিটিশ সুরকার পিটার ম্যাক্সওয়েল ডেভিস ২০১২ সালে ৯ম সিম্ফনি তৈরির এক বছর পর ১০ম স্মিফনি তৈরিতে হাত দেন। এই সময় তিনি লিউকোমিয়া রোগে আক্রান্ত হন। কিন্তু তারপরও তিনি হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে তার দশম সিম্ফনির কাজ সমাপ্ত করেন। এর মধ্য দিয়ে পিটার তার অভিশাপকে হার মানিয়েছেন।
এতো কিছুর পরেও ৯ নং সিম্ফনির অভিশাপের ভীতিকর ব্যাপারটি কিন্তু সুরকারদের মনের মাঝে কোথাও না কোথাও যেন সবসময়ই থেকে যায়!