মেয়ে মানেই গোলাপি রঙয়ের সাথে সখ্যতা। লিঙ্গ আর রঙ- এ দুটোর মধ্যে কোনো সম্পর্ক কি আদৌ আছে? কেন আমরা মেয়েশিশু বলতেই গোলাপি রঙয়ের জামা জুতো আর খেলনার কথা ভাবি? অনেকেই হয়তো ভাবতে পারেন, রঙয়ের এই ব্যাপারটা পুরোটাই বাণিজ্যিক। বাণিজ্যিক সাফল্য পেতে ছেলেদের জন্য নীল আর মেয়েদের জন্য গোলাপি রঙ নির্ধারণ করে দিয়েছে ব্যবসায়ীরা। কিন্তু শুধু কি এটিই কারণ? নারী এবং গোলাপি রঙয়ের মধ্যে কি আর কোনো যোগাযোগ নেই? বহু বছর ধরে এই প্রশ্ন ঘুরপাক খেয়েছে সবার মাথায় আর বেরিয়ে এসেছে নানা রকম মজার তথ্য।
২০১৭ সালের আগস্ট মাসে প্রকাশিত ‘কারেন্ট বায়োলজি’র এক গবেষণানুসারে, নারী বা মেয়েদের গোলাপি রঙ পছন্দের ব্যাপারটা পুরোপুরি সামাজিক কিংবা বাণিজ্যিক নয়। এর পেছনে আছে মানসিক এবং শারীরিক কিছু ব্যাপারও। ছেলেদের চাইতে একটু বেশি লালচে রঙ পছন্দ নারীদের জন্মগতভাবে- এমনটাই বলা হয় সেখানে। নিউক্যাসল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নায়ুবিজ্ঞানী এনিয়া হার্লবার্ট এবং ইয়াজু লিং ২০-২৬ বছরের মোট ২০৮ জন মানুষের উপরে রঙ নির্বাচন পরীক্ষা চালান। অংশগ্রহণকারীদের বলা হয়, খুব দ্রুত কার্সর ঘুরিয়ে কয়েকটি রঙ, কয়েক শেডের রঙ, আলো এবং অন্ধকারের মিশেলে রঙ, বিভিন্ন আকৃতিতে থাকা রঙয়ের মধ্যে থেকে নিজের পছন্দের রঙটি বাছাই করতে। সপ্তাহ দুয়েক পর আবার তাদের নিয়ে একই পরীক্ষা করা হয়।
গবেষণা থেকে জানা যায়, প্রায় সব মানুষই সাধারণত নীল রঙ পছন্দ করে। তবে ছেলেরা যে ক্ষেত্রে নীলের সাথে সবুজের মিশ্রণ পছন্দ করে, সেক্ষেত্রে মেয়েরা একটু লালচে রঙয়ের নীল পছন্দ করে। অনেকটা বেগুনী ধাঁচের রঙ এগিয়ে থাকে তাদের পছন্দের তালিকায়। নিজেদের সংস্কৃতির কারণে রঙয়ের পছন্দ ভিন্ন হতে পারে- সেই কথা মাথায় রেখে এই পরীক্ষায় রাখা হয়েছিল বেশ কয়েকটি সংস্কৃতির মানুষকে। তাদের মধ্যে ছিল চীনের হান চাইনিজদের ৩৭ জন, ব্রিটিশ ককেশিয়ানদের মধ্যে ১৭১ জন- এদের সবাই নারী এবং পুরুষের রঙ নির্বাচনের ক্ষেত্রে এই ভিন্নতা অনুভব করেছেন। অবশ্য চীনাদের মধ্যে লালের দিকে ঝোঁকটা ছিল বেশি।
নারীরা পুরুষদের চাইতে রঙয়ের আভা ভালো বুঝতে পারে। এই ক্ষমতা আজকের নয়, বরং বছরের পর বছর ধরে অভ্যাসের ফলে তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন গবেষকেরা। প্রাচীনকালে পুরুষেরা শিকারে যেত। আর নারীরা ফল পেড়ে আনত, বাচ্চা লালন-পালন করতো। এসব কারণে, কোন ফল পেকেছে, কোন ফলের গায়ে লালচে আভাস দেখা যাচ্ছে- এসব পুরুষদের চাইতে ভালোভাবে দেখতে শুরু করে নারীরা। অন্যদিকে, শিশুর যত্ন নিতে গিয়ে তাদের বুঝতে হত যে, শিশুর গালে আভা কতটুকু লালচে হলে বুঝতে হবে তার শরীর খারাপ। আর অভ্যাসের কারণের রঙ এবং রঙয়ের মিশ্রণ পুরুষের চাইতে অধিকতর পরিষ্কারভাবে দেখতে শুরু করে নারীরা, যার প্রভাব যায়নি এখনো। তাই অনেক সময় পুরুষেরা গোলাপী রঙ হালকা বিধায় সেটাকে খুব ভালো করে দেখতে এবং পছন্দ করতে পারে না। তাদের দরকার পড়ে গাঢ় কোনো রঙ। সত্যিই তো, যে রঙয়ের পুরোটা রূপ আপনি উপভোগ করতে পারছেন না, সেটা আপনার ভালো না-ই লাগতে পারে!
তবে এ তো গেল একপক্ষের কথা। শারীরিক ও মানসিক গঠনকে নারী ও গোলাপি রঙয়ের কাছাকাছি আসার কারণ বলে অনেকে মনে করলেও এর বাণিজ্যিক ও সামাজিক দিকের কথাও কিন্তু বাদ দেওয়ার মতো নয়। ১৯১৮ সালে ‘আর্নশ’স ডিপার্টমেন্ট’ এর এক আর্টিকেলে বলা হয়, গোলাপি রঙ দৃঢ়তা আর শক্তির প্রতীক হওয়ায় ছেলেদের জন্য গোলাপি রঙকেই বেছে নেওয়া উচিত। অন্যদিকে নীল বলতেই বোঝায় মায়ার ভাব, নাজুক এক প্রকাশ। তাই সেটা মেয়েদের রঙ হিসেবে মানানসই। ১৯৬০ সালের দিকে ছেলে-মেয়েদের আলাদা আলাদা রঙয়ের পেছনে বড় ভূমিকা পালন করে শিশুদের খেলনা তৈরিকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। ছেলে এবং মেয়েদের জন্য নির্দিষ্ট আলাদা রঙয়ের খেলনা বেশি তৈরি করায় সেটি ছেলে এবং মেয়েদের লিঙ্গ ভিন্নতার একটি নিদর্শন হয়ে যায়। অভিভাবকেরা এই স্রোতে গা ভাসিয়ে দিলে রঙয়ের ভিন্নতা খুব স্বাভাবিক একটি ঘটনা হয়ে যায়।
আপনিই ভাবুন, আপনার নিজের শিশুটির জন্য কোনো জামা কিনতে হলে বা কোনো পণ্য কিনতে হলে কোথায় যাবেন আপনি? নিশ্চয়ই দোকানে! আর দোকানে গিয়ে যদি জানতে পারেন যে, নির্দিষ্ট কোনো রঙয়ের জামাই এখন হালের ফ্যাশন, আর সবাই সেটাই পরছে, তাহলে কেন সেটা নিজের শিশুর জন্যেও কিনেবেন না আপনি? অভ্যাসটির শুরু হয় এখান থেকেই। আর শিশুরা? শিশুরা অনুকরণপ্রিয়। সে তার চারপাশে যা দেখবে সেটাই তো শিখবে।
সবার ভেতরে এই ধারণা অনেক আগে থেকেই বদ্ধমূল হয়ে আছে যে, মেয়ে শিশুর জন্য গোলাপি রঙটাই একদম ঠিকঠাক। তাই তার জন্য ছোটবেলা থেকে কিনে আনা হয় গোলাপি জামা, জুতো, খেলনা। আশেপাশে নারীদের মুখেও থাকে গোলাপি রঙয়ের প্রতি আকর্ষণের গল্প। এতকিছু শুনতে শুনতে নিজের পছন্দের রঙয়ের জায়গায় গোলাপিকে বসিয়ে দেওয়াটা খুব একটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। গোলাপির বদলে রঙটা যদি হতো খয়েরী, তবে নারী শৈশব থেকেই যদি পরিচিত হতো খয়েরীর সাথে, তাহলে হয়তো সেটাকেই বেশি পছন্দ হতো তার।
গবেষকদের মতে, দুই বছর বয়স থেকেই মেয়েরা গোলাপি রঙয়ের দিকে ঝুঁকতে থাকে। আর ঠিক তার কাছাকাছি কোনো একটি বয়স থেকেই গোলাপী রঙকে সতর্কতার সাথে দূরে সরিয়ে রাখতে শুরু করে ছেলেরা। সেদিক দিয়ে বলতে গেলে, এই আচরণ থেকে বোঝাটা খুব স্বাভাবিক যে, জন্মগতভাবে নয়, বরং জন্মাবার বেশ কিছুদিন পর চারপাশের মানুষের এবং সমাজের মন মানসিকতা দ্বারা প্রভাবিত হয়েই এমন রঙ বেছে নেয় মেয়েরা। তাই পছন্দের রং এখানে কোনো বড় ব্যাপার নয়। আসল ব্যাপার হলো চারপাশের পরিবেশ। পরিবেশ যে ধারণা একটি শিশুকে ছোটবেলা থেকে দিয়ে আসবে, সে সেটাই তো করবে। ইচ্ছা করে গোলাপি রঙয়ের পোশাক পরে কোনো ছেলেশিশু নিশ্চয়ই নিজেকে মেয়েলী বলে প্রমাণ করতে চাইবে না। সেই সাথে, কোনো মেয়ে নিশ্চয়ই চারপাশের সবার চাইতে আলাদা হয়ে উঠতে চাইবে না। গোলাপীতে তাকে মানায়, সুন্দর দেখায়, গোলাপিই তার পছন্দনীয় রং সেটা ভাবতে অনেকটাই বাধ্য সে।
তাহলে প্রশ্ন ওঠে, নারী এবং গোলাপি রঙ- এ দুটোর সম্পর্কটা ঠিক কী? প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে নিরপেক্ষভাবে ভাবতে হবে আপনাকে। গোলাপি রঙ আর দশটা রঙয়ের মতোই একটি রঙ। একজন মানুষ, নারী ও পুরুষভেদে, গোলাপি রংটিকে পছন্দ করতেই পারেন। তার মানে এই নয় যে, তাকে নারী হতে হবে। তবে সামাজিক প্রভাবে ইতিহাসে বারকয়েক হাতবদল হয়ে গোলাপি এখন হয়ে উঠেছে নারীদের রঙ। তবে একটি ব্যাপার সঠিক যে, গোলাপি মানুষকে আকর্ষণ করে বেশি। নীল যদি সবার পছন্দের হয়, তবে গোলাপিও কম যায় না। ২০০২ সালে সুইজারল্যান্ডে একটি গবেষণায় পাওয়া যায় যে, কাগজে গোলাপি রঙ দিলে মানুষ লিফলেট কিংবা ফর্মের প্রতি বেশি আগ্রহী হয়ে ওঠে। যেটা কিনা অন্য কোনো রঙয়ের ক্ষেত্রে হয় না!
নারীমাত্রই গোলাপি রঙ পছন্দ করবে? প্রশ্নটা না হয় আপনার জন্যেই তোলা থাক। তবে সবশেষে কথা একটাই। গোলাপি চমৎকার রঙ। একে যেকোনো নারী পছন্দ করতেই পারেন। তবে সেটা একজন নারী, নাকি একজন মানুষ হিসেবে? ভেবে দেখুন।
ফিচার ইমেজ: Kingsmills Hotel