পৃথিবীতে এমন অনেক ছোট দেশ (মাইক্রোনেশন) আছে যেগুলো অন্য কোনো দেশ বা সেই দেশেরই সরকারের কাছ থেকে কোনো স্বীকৃতি পায়নি। তবুও পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত, পাসপোর্ট, স্ট্যাম্প ইত্যাদি নিয়ে দিব্যি চলছে দেশগুলো। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, অদ্ভুত সব নিয়ম ও কাহিনীতে গড়া এই দেশগুলো নিয়েই আজকের আয়োজন।
পালাউ
আয়তন: ৪৫৯ বর্গ কি.মি.
জনসংখ্যা: ২১, ৩৪৭ জন
পৃথিবীর অদ্ভুত সুন্দর কিছু জায়গার মধ্যে একটি হলো স্বচ্ছ নীল পানিতে ঘেরা ছোট্ট এই দ্বীপরাষ্ট্রটি! প্রায় তিনশরও বেশি নানান আকৃতির দ্বীপ নিয়ে গঠিত দ্য রিপাবলিক অব পালাউ। এই দেশটির রেইনফরেস্টগুলো একেবারে ভিন্ন সব গাছপালা ও পাখি দিয়ে ভরপুর। এছাড়াও এখানকার আঞ্চলিক জলসীমায় বিলুপ্ত প্রায় ১৩০ প্রজাতির হাঙর রয়েছে। ওশেনিয়া মহাদেশের নান্দনিক এই দ্বীপরাষ্ট্রের অসাধারণ বিষয়টি হলো এখানে দুই লক্ষ জেলীফিশের একটি হ্রদ আছে, যেগুলো সময়ের পরিক্রমায় বিষদাঁত হারিয়ে ফেলেছে।
দ্য প্রিন্সিপালিটি অব সিল্যান্ড
আয়তন: ০.০০৪ বর্গ কি.মি.
জনসংখ্যা: ২৭ জন (দাবি অনুযায়ী), ৩ জন (অনুমোদিত নাগরিক)
ইংল্যান্ডের উত্তর সাগরে অবস্থিত পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম এই দেশটির রয়েছে নিজস্ব পতাকা, পাসপোর্ট ও মুদ্রা! এছাড়া দেশটির একটি রাজধানীও রয়েছে। অদ্ভুত এই দেশটি রয়েছে সাগরের উপর ভাসমান অবস্থায়। বড় বড় দুটি স্টিলের পাইপের উপর দাঁড়িয়ে আছে দেশটি! মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্যবহৃত একটি সমুদ্র-দুর্গ এই দেশটি! জার্মান সেনাদের আকস্মিক আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পেতে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী ইংল্যান্ডের উপকূলভাগে একটি সমুদ্র-দুর্গ বানানোর পরিকল্পনা করে। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ীই উপকূল থেকে ১০ কি.মি. গভীরে বানানো হয় এটি। এখান থেকে শত্রুর যুদ্ধ জাহাজগুলোর উপর নজরদারি করা হতো এবং প্রয়োজনে শত্রুর জাহাজে আক্রমণ পরিচালনার কাজও করতো। যুদ্ধ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী এটিকেও পরিত্যক্ত ঘোষণা করে। ১৯৬৭ সালে এক ব্রিটিশ পরিবার এর স্বত্বাধিকারী হয় এবং একটি স্বাধীন মাইক্রো রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা দেয়। পৃথিবীর কোনো দেশই সিল্যান্ডকে স্বীকৃতি না দিলেও কেউ এখনও পর্যন্ত তাদের বিরোধিতা করেনি। একই পরিবারের ৩ জন সদস্য এই দেশটির নাগরিক এবং তারা দেশটির রাজা, রানী ও রাজপুত্র!
নাউরু
আয়তন: ২১ বর্গ কি.মি.
জনসংখ্যা: ১০,৩০৩ জন
দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের ডিম্বাকৃতির ছোট এই দ্বীপরাষ্ট্র চারিদিকে প্রবাল প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। পাহাড়ি ধাঁচের এই দেশটির একদিকে চীন ও অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের কিছু দ্বীপ রয়েছে। ১৯৬৮ সালে স্বাধীন হওয়া এই দেশটির শিক্ষার হার ৯৯%। অস্ট্রেলিয়া প্রভাবিত এই দেশে নেই কোনো রাজধানী ও রাজনীতি। তবে স্থানীয়ভাবে ডেমোক্র্যাটিক পার্টি, নাউরু ফার্স্ট ও সেন্টার পার্টি নামে তিনটি রাজনৈতিক দল এবং ১৮ জন সংসদ সদস্যের একটি শাসনব্যবস্থা রয়েছে। ফসফেট খনির এই দেশটির সদস্য পদ রয়েছে জাতিসংঘে। এখানে প্রচলিত রয়েছে অস্ট্রেলিয়ান মুদ্রা এবং এর বাজেটও নির্ধারণ করা হয় সেখান থেকে। দেশটির অধিকাংশ মানুষের ওজন কিছুটা বাড়তি। মূলত সেখানকার আবহাওয়া তাদের এমন শারীরিক গঠনের কারণ।
সেন্ট কিটস্ এন্ড নেভিস
আয়তন: ২৬১ বর্গ কি.মি.
জনসংখ্যা: ৫২,৩২৯ জন
সেন্ট কিটস্ ও নেভিস নামের দুটি দ্বীপ নিয়ে গঠিত এই দেশটি। এ দেশের আয়ের অন্যতম উৎসগুলোর মধ্যে একটি হলো ইকোনমিক সিটিজেনশিপ প্রোগ্রাম। এই প্রোগ্রামের আওতায় যে কেউ সেখানকার স্থানীয় চিনিকলে ন্যূনতম দুই লক্ষ পঞ্চাশ হাজার ডলার বিনিয়োগ করে সেই দেশের নাগরিক হতে পারে। এছাড়াও দুটি দ্বীপের যেকোনো একটিতে ৪ লক্ষ ডলারের কম মূল্যের জমি কিনলেও নাগরিকত্ব পাওয়া সম্ভব।
দ্য প্রিন্সিপালিটি অব হাট রিভার
আয়তন: ৭৫ বর্গ কি.মি.
জনসংখ্যা: ২০ জন (স্থায়ী বাসিন্দা), ১৩,০০০ জন (পাসপোর্টধারী বাসিন্দা)
১৯৭০ সালে স্থাপিত এই দেশটি অস্ট্রেলিয়ার সবচাইতে পুরাতন ও ক্ষমতাশালী ক্ষুদ্র জাতি। অস্ট্রেলিয়ার পার্থ থেকে ছয় হাজার কি.মি. উত্তরে অবস্থিত এই দেশটি। এর প্রতিষ্ঠাতা লিওনার্দো জর্জ ক্যাসলি, যিনি তার খামারকে স্বাধীন একটি রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করেন এবং তিনি হলেন সেখানকার রাজা। এমনকি বিভিন্ন জায়গায় রয়েছে তার আবক্ষ মূর্তি। দেশটির রয়েছে নিজস্ব মুদ্রা, ষ্ট্যাম্প ও পাসপোর্ট! যদিও অস্ট্রেলিয়ার সরকার এখন পর্যন্ত এই দেশটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো স্বীকৃতি দেয়নি।
দ্য রিপাবলিক অব মোলোসিয়া
আয়তন: ০.০০৫ বর্গ কি.মি.
জনসংখ্যা: ২৮ জন
যুক্তরাষ্ট্রের বিস্তীর্ণ মরুভূমি নেভাডায় অবস্থিত এই ছোট দেশটির প্রতিষ্ঠাতা কেভিন বাগ। তিনি নিজেই এই দেশটির প্রেসিডেন্ট। নিজ ঘরের পেছনে দশ হাজার ডলার বিনিয়োগে তিনি প্রতিষ্ঠিত করেন দেশ। দেশটির রয়েছে নিজস্ব জাতীয় সঙ্গীত, প্রতীক ও পতাকা। এছাড়াও রয়েছে একটি ব্যাংক, ট্রেডিং কোম্পানি, আলাদা টাইম জোন, রেলপথ (খেলনা সদৃশ) ও মহাকাশ বিষয়ক প্রোগ্রাম। ২৮ জনের জনসংখ্যার মধ্যে ৫ জন হলো কেভিনের পরিবারের সদস্য এবং তাদের ৩টি কুকুর, ১টি বিড়াল ও ১টি খরগোশ। বাকিরা এখন মোলোসিয়া ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রেই কোথাও না কোথাও থাকেন। গুরুতর কোনো অপরাধের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডও ধার্য করা হয় দেশটিতে। মোলোসিয়া থেকে বের হওয়ার সময় একেবারে শেষপ্রান্তে রয়েছে ‘পাইনঅ্যাপেল ফাউন্টেন’ নামে একটি ছোট্ট ফোয়ারা। পেছন ফিরে কাঁধের উপর থেকে একটি পয়সা ছুঁড়ে যদি আপনি ফোয়ারাটিতে ফেলতে পারেন, তার মানে হলো আপনি মোলোসিয়াতে আবার আসবেন! ২০১৭ সালের মে মাসে দেশটির ৪০ বছর পূর্তি হলো।
সোভার্ন মিলিটারি অর্ডার অব মাল্টা
আয়তন: ৩১৬ বর্গ কি.মি.
জনসংখ্যা: ৪,১৯, ০০০ জন
ভ্যাটিকান সিটি ছাড়াও রোমে আরেকটি ছোট দেশ রয়েছে যার নাম মাল্টা! দেশটি দখল করে রেখেছে ৩টি দালান যার ভেতর দুটোর অবস্থান রোমে এবং তৃতীয়টি রয়েছে মাল্টার দ্বীপে। ১৯৯৪ সাল থেকে দেশটির জাতিসংঘের সদস্য পদ রয়েছে। কূটনৈতিক বাণিজ্যের জন্য এখানকার কূটনৈতিকদের কাছে পাসপোর্ট ইস্যু করা হয়ে থাকে। কিন্তু স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার কোনো বৈশিষ্ট্য নেই দেশটির। সেখানে নেই কোনো স্থানীয় বাসিন্দা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও অর্থনীতি।
দ্য প্রিন্সিপালিটি অব সাবোর্গা
আয়তন: ১৪ বর্গ কি.মি.
জনসংখ্যা: ৩৬০ জন
দ্য প্রিন্সিপালিটি অব সাবোর্গা ইতালির একটি ছোট দেশ যা ফ্রান্সের সীমান্তে অবস্থিত। এই দেশের রাজতন্ত্রের দায়িত্বে আছেন প্রথম প্রিন্স মারচেলো। দেশটিকে ইতালির অধীনস্থ হিসেবে বিবেচনা করা হয় না বিধায় এখনও পর্যন্ত তারা স্বাধীনতা ও অধিকারের জন্য লড়ে যাচ্ছে। তবে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত দেশটি স্বাধীন ছিলো। অস্বীকৃত এই দেশটিতে ৩ সদস্যের একটি সেনাবাহিনী রয়েছে। এদের একজন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী এবং অন্য দুজন বর্ডার গার্ড হিসেবে কাজ করেন।
নিউ
আয়তন: ২৬১ বর্গ কি.মি.
জনসংখ্যা: ১,৬১৩ জন
ওশেনিয়ার ছোট্ট এই দ্বীপটির নান্দনিক সৌন্দর্য থাকা সত্ত্বেও পর্যটকের সংখ্যা অনেক কম। তাই এই দেশটি বেশিরভাগ বাইরের দেশগুলোর সহযোগিতাতেই চলে। বিশেষ করে তারা নিউজিল্যান্ড থেকেই সহযোগিতা পেয়ে থাকে। মাত্র ৬০০ লোকের ছোট একটি শহর আছে সেখানে। কিন্তু শহরটিকে গ্রামই বলা চলে। দেশটিতে একটি বিমানবন্দর ও একটি সুপার মার্কেট রয়েছে। এটিই পুরো দেশের একমাত্র সুপার মার্কেট!
এই সুন্দর ও অদ্ভুত দেশগুলোর মধ্যে কোনটি ঘুরে দেখে আসতে চান আপনি?