মুখের উপর ভারি বরফ, চুল লেপ্টে আছে সারা মুখে। শ্বাস নেওয়ার উপায় নেই। ঝাপসা হয়ে আসছে পুরো পৃথিবী। শেষ পর্যন্ত মৃত্যুদূত এসেই পড়লো বুঝি! মনে পড়ছে অনেক কিছু। মিহারু, নাসু পাহাড়, বাড়িতে রেখে আসা স্বামী মাসানোবুর কাছে ছোট্ট নরিকো আর শিনয়া।
ছোট্ট কাঠের ঘর। এক হাজার বছরের পুরোনো সাকুরা গাছ। উজ্জ্বল গোলাপি পাঁপড়ি তার ঝরে পড়ছে। ঘরের বাইরে সোনালি রোদ। ঘরের ভেতর ছোট্ট একটা মেয়ে। সবাই তাকে জানে দুর্বল অসুস্থ বাচ্চা। সারাদিন তার কীসের এত বিষণ্নতা, কে জানে? মিহারুর ছোট একটা স্কুলে যায় মেয়েটি। স্কুল থেকে ঠিক করল দল বেঁধে পাহাড় চড়তে যাবে। সেকথা শুনে মেয়ের আত্মীয়-স্বজন হেসেই খুন, যেন ভারি মজার কথা শুনেছে।
মেয়েটি পাহাড় দেখল। কী কঠিন অসবুজ সে পাহাড়। তবু এত সুন্দর। যেন কত ভালোবাসা লুকানো। মেয়েটি পাহাড়ের গায়ে হাত রাখলো। নাক ঠেকিয়ে পাহাড়ের গন্ধ শুঁকলো। তার চোখ আনন্দে চকচক করছে। জাপান দেশের ফুকুশিমা শহরের মিহারুর ছোট্ট মেয়ে ঝুনকো ইসতিবাশি দশ বছর বয়সে মাউন্ট নাসুর চূড়ায় উঠল। পাহাড়ের প্রেমে পড়ল সে। উচ্চতাকে জয় করার দিন কেবল শুরু হল তার, তারপর জীবনে বহু চড়াই উতরাই এসেছে। কখনো থেমে যায়নি তার পা দুটো। ছোট্ট মেয়ে ঝুনকো ইসতিবাশি আর কেউ নন, স্বয়ং ঝুনকো তাবেই। তিনিই এভারেস্টকে প্রথমবার নারীর পায়ের নিচে নিয়ে আসেন।
জন্ম নিয়েছিলেন ফুকুশিমার মিহারু অঞ্চলে, ১৯৩৯ সালের ২২ সেপ্টেম্বর। তিনি ছিলেন সাত ভাইবোনের মধ্যে পঞ্চম। ছেলেবেলা থেকেই দুর্বল আর ভীতু বলে বড্ড দুর্নাম ছিল তার। পরিবারের লোকজন কল্পনাও করতে পারেনি কত প্রাণশক্তি তিনি লুকিয়ে রেখেছিলেন। মাউন্ট নাসু অভিযান তার জীবনে বড় একটি পরিবর্তন নিয়ে এলো। এরপর থেকে পাহাড় চড়ার নেশা যেন তাকে পেয়ে বসে। কিন্তু তার মধ্যবিত্ত পরিবারের পাহাড় চড়ার মতো এমন ব্যয়বহুল শখকে সমর্থন দেওয়ার পরিবারের সামর্থ্য ছিল না। তাই স্কুল জীবনে তিনি গুটিকয়েক পাহাড়ে মাত্র উঠতে পেরেছিলেন।
স্কুল শেষ করে তাবেই ভর্তি হলেন মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়ে, পড়বেন ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে। তাই বলে পাহাড় চড়ার ভূত তার ঘাড় থেকে এক ইঞ্চিও সরে যায়নি। পড়াশোনার পাশাপাশি সদস্য হলেন পর্বত অভিযান ক্লাবের। মাঝে মাঝেই পাহাড় চড়তেন এসময়। কিন্তু একে একে নানা বাধা আসতে শুরু করে। তখনো পর্যন্ত মেয়েদের পাহাড় চড়াটাকে ঠিক ইতিবাচকভাবে নেওয়া হয়নি এশিয়া জুড়ে। প্রধান বাধাটি ছিল মানসিক। অনেক পুরুষ সদস্য নারী হওয়ার অভিযোগে তার সাথে অভিযানে যেতে রাজি হতেন না। কেউ কেউ কানাঘুষো করতেন এসব অভিযানের শখ পুরোটাই ফাঁকি, সবই ভালো বর খুঁজে পাওয়ার আশায়। দমে যাননি তাবেই। স্নাতক শেষ করলেন ১৯৬২-তে। ১৯৬৫-তে গাঁটছড়া বাধলেন মাসানোবু তাবেইয়ের সাথে। তিনিও পেশায় একজন পর্বতারোহী। মূলত তখনই তিনি ঝুনকো ইসতিবাশি থেকে ঝুনকো তাবেই হন। তিনি অবশ্য দুনিয়া জুড়ে তাবেই নামেই পরিচিত। ১৯৬৯ সালে নিজ উদ্যোগে শুরু করলেন জাপানের প্রথম লেডিস ক্লাইম্বিং ক্লাব (এল সি সি)। ১৯৭০ সালের ১৯ মে ঝুনকো তাবেই ও হিরোকো হিরাকাওয়া অন্নপূর্ণা ৩ জয় করেন। সেখানে সম্পূর্ণ নতুন একটি পথ আবিষ্কার করেন তিনি। তার এই সাফল্যে তার ক্লাব প্রথমবারের মতো এভারেস্ট বিজয় নিয়ে ভাবতে শুরু করে।
১৯৭৫ সালে তাবেইয়ের পর্বতারোহণ ক্লাব এলসিসির ১৫ জন সদস্য পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ এভারেস্ট বিজয়ের জন্য প্রস্তুত হয়। যদিও তাবেই একের পর এক পর্বত অভিযান করে জাপানে তখন পরিচিত মুখ, অভিযানে আসতে থাকল একের পর এক বাধা। এভারেস্ট শৃঙ্গ অভিযান? সে তো অনেক টাকার ব্যাপার। স্পনসর কে করবে? দলকে তাবেই চিন্তা করতে নিষেধ করলেন। কিছু একটা ব্যবস্থা তিনি করেই ফেলবেন। যেতে হল ধনীদের দ্বারে দ্বারে। সবার মুখে একটাই কথা, “মেয়ে হয়েছো, পাহাড় চড়ার শখ কেন বাপু? ঘরে গিয়ে বাচ্চা সামলাও না!” শেষ পর্যন্ত ইয়োমিউরি শিমবান নামে একটি জাপানি পত্রিকা ও নিপ্পন টেলিভিশন তাদের দলটিকে অর্থ দিয়ে সাহায্য করল। তারপরও প্রত্যেক সদস্যকে একটা বিরাট অংকের অর্থ সরবরাহ করতে হলো। ১৫ জন নারীর অধিকাংশই শিক্ষক, একজন আছেন কম্পিউটার প্রোগ্রামার, আরেকজন কিশোরীদের কাউন্সেলিং করেন। তাবেই ও অপর একজন ইতোমধ্যে মা হয়ে গেছেন। টাকা বাঁচাতে কত কী-ই না করতে হয়েছে তখন। তাবেই নিজের ভাগের টাকাটা যোগাড় করলেন পিয়ানো শিখিয়ে। পুরনো বাতিল গাড়ির সিটকভার দিয়ে তৈরি হলো জলনিরোধক ব্যাগ আর দস্তানা। স্কুলের বাচ্চারা তাদের বেঁচে যাওয়া জ্যামের প্যাকেট উপহার করল শিক্ষকদের। চীন থেকে হাঁসের পালক কিনে নিজেরাই সেলাই করে নিলেন স্লিপিং ব্যাগ। পুরোনো পর্দার কাপড় কেটে তৈরি হলো পরনের কাপড়। সাথে সাথে চলছিল হিমালয়ের বরফ শীতল আবহাওয়ায় আর অকল্পনীয় উচ্চতায় নিজেদের টিকিয়ে রাখার শারীরিক ও মানসিক প্রস্তুতি।
১৯৫৩ সালে স্যার এডমুন্ড হিলারি ও তেনজিং নোরগে যে রুট ধরে এভারেস্ট বিজয় করেছিলেন, সে রাস্তাতেই ১৯৭৫ সালের প্রথম ভাগে যাত্রা শুরু করলেন তাবেই ও তার সঙ্গীরা। দিনটি ছিল ৪ মে, ঘড়ির কাঁটায় ১২.৩০, একদম মধ্যরাত। সারাদিনের ক্লান্তিকর পদভ্রমণ শেষে অভিযাত্রীরা ঘুমিয়ে আছেন ২১,৩২৬ ফুটের বরফশীতল উচ্চতায়, ক্যাম্প ২-এ। আচমকা দানবের মতো পাহাড় বেয়ে নেমে এলো তুষারধ্বস। ঝুনকো আর তার সঙ্গীরা ডুবে গেলেন বরফের নিচে। বোধহয় জ্ঞান হারাচ্ছেন। এতো স্মৃতি মনে পড়ে গেল এক ঝাপটায়! ঘরে রেখে এসেছেন দুটো শিশুকে। পেছনে ফেলে এসেছেন হাজার মানুষের বিদ্রূপের তীর। তাকে হেরে গেলে চলবে না। বেঁচে থাকতে হবে। কোনোমতে গলার কাছে বেঁধে রাখা পকেট ছুরিটা হ্যাঁচকা টানে বের করলেন। হাত বাড়িয়ে দিলেন বরফের ভেদ করে। জ্ঞান হারালেন তিনি।
ঝুনকোর শেরপা তাকে বরফের নিচ থেকে উদ্ধার করেন। বরফের নিচে অজ্ঞান অবস্থায় তিনি ছিলেন প্রায় ছয় মিনিট। পায়ের গোড়ালি তাকে একদমই সঙ্গ দিচ্ছে না। কিন্তু দমে যাবার পাত্রী তিনি নন। তাকে যে এভারেস্টের দর্পচূর্ণ করতেই হবে। আবার যাত্রা শুরু করলেন। ১২ দিন পর এলো আরো একটি বাধা। সামনে ছুরির ফলার মতো শৈলশিরা, পিছু হঠবার উপায় বা ইচ্ছা কোনোটাই নেই। হামাগুড়ি দিয়ে্ লোহার সাঁড়াশি বরফে আটকে চলতে শুরু করলেন সন্তর্পণে। তিনি জানেন, তার এক চিলতে ভুল তাকে চীনের দিকে ৫,০০০ মিটার ও নেপালের দিকে ৬,৪০০ মিটার নিচে পৌঁছে দেবে, মৃত! ঝুনকো বলেছিলেন, সেই মুহূর্তে তার আগের সব অভিযাত্রীদের উপর ভয়ানক রাগ হয়েছিল। তারা কেউ যাত্রায় এই শৈলশিরার কথা উল্লেখ করেনি। সেদিনই বিশ্বের ইতিহাসে নতুন একটি নাম যোগ করলেন তিনি, ‘ঝুনকো তাবেই, প্রথম নারী ও ৩৬ তম এভারেস্ট জয়ী।’
এভারেস্ট বিজয়ের পর থেমে থাকতে হয়নি ঝুনকোকে। সম্মানের সাথে এলো অর্থ। নেপালের রাজা তাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে চিঠি পাঠালেন, জাপানে তাকে বরণ করা হল সাদরে। এমনকি তার এভারেস্ট অভিযান নিয়ে মিনি-সিরিজ বের হলো টিভিতে। এসব খ্যাতিতে ঝুনকো নাকি অস্বস্তি বোধ করতেন। তিনি একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “পর্বত অভিযান নিজেই অনেক বড় প্রাপ্তি।”
১৯৮০ সালে তানজানিয়ার কিলিমানজারো (১৯,৩৪০ ফুট), ১৯৮৭ সালে আর্জেন্টিনার একোঙ্কাগুয়া (২২,৪৩১ ফুট), ১৯৮৮ সালে আলাস্কার ডেনালি (২০,৩১০ ফুট), ১৯৮৯ সালে রাশিয়ার এলব্রুস (১৮,৫১০ফুট), ১৯৯১ সালে এন্টার্কটিকার ভিনসন ম্যাসিফ (১৬,০৫০ ফুট) ও ইন্দোনেশিয়ার পুঞ্চক জয়া (১৬,০২৪ ফুট) জয়ের মাধ্যমে সপ্তশৃঙ্গ অভিযান (সেভেন সামিট) সফলভাবে সমাপ্ত করেন ঝুনকো তাবেই। অভিযানের পাশাপাশি যোগ দিয়েছিলেন পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনে। ২০০০ সালে তিনি স্নাতকোত্তর পাশ করলেন। পড়াশোনার বিষয় ছিল ‘অভিযাত্রী দলগুলোর বর্জ্য থেকে পরিবেশের ক্ষতি’। প্রতি বছর অসংখ্য পর্বতারোহী দলের বর্জ্য দিয়ে এভারেস্ট পূর্ণ হচ্ছে, অথচ পাদদেশের মানুষেরা এর বরফ গলা পানি পান করেই জীবনধারণ করে। তাবেইয়ের মতে এভারেস্টের এবার একটু বিশ্রাম প্রয়োজন। তিনি কাজ করছিলেন জাপানের হিমালয় অভিযাত্রা ট্রাস্টের পরিচালক হিসেবে। এই সংস্থার উদ্দেশ্য ছিল অভিযাত্রীদের বর্জ্য পোড়ানোর চুল্লি নির্মাণ। জাপান আর হিমালয়ের পরিচ্ছন্নতা রক্ষার জন্য অভিযান করেন।
ব্যক্তিজীবনে ঝুনকো একেবারেই আটপৌরে একজন মানুষ ছিলেন। এত বড় মাপের অভিযাত্রী নিজেকে গৃহিণী বলে পরিচয় দিতেন। এভারেস্ট, সপ্তশৃঙ্গ, পৃথিবীর প্রায় ৭০টি দেশের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ জয়- এত ব্যস্ততা এক মুহূর্তের জন্যও তাকে অহংকারী করে দেয়নি। ২০১২ সালে তাবেই-এর শরীরে ক্যান্সার ধরা পড়ে। আজীবন এই অভিযাত্রী থেমে থাকেননি। ২০১৬ সালের ২০ অক্টোবর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত যুক্ত ছিলেন সমাজসেবায়। নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় আর পর্বতপ্রেমীদের জন্য উজ্জ্বল উদাহরণ হয়ে থাকবেন ঝুনকো তাবেই।