মানবজাতির ইতিহাসে মানুষ কাজে ব্যস্ত থেকেছে, অলসতায় সময় কাটিয়েছে, অপ্রয়োজনীয় প্রশ্ন করেছে। আশেপাশে কোনো ঘটনা ঘটলে সেগুলোর কারণ উদঘাটন করে ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। তখন বিজ্ঞান ছিল না, তাই স্বভাবতই সেসব ব্যাখ্যা পরবর্তীতে অযৌক্তিক হিসেবে গণ্য হয়েছে। ব্যাখ্যাগুলো যৌক্তিক দিক থেকে অগ্রহণযোগ্য হলেও শিল্পমানে অনন্য ছিল। একজন লেখক যখন ফ্যান্টাসি গল্প ও কল্পবিজ্ঞান লিখেন, তখন আমরা পাঠকেরা সেগুলো পড়ে বিমোহিত হই, লেখককে বাহবা দেই, কারণ সেগুলো শিল্পমানে উন্নত। হোক না কাল্পনিক, কিন্তু মনের আনন্দের খোরাক তো জোগায়। তেমনই প্রাচীনকালের মানুষদের ব্যাখ্যাগুলো বিজ্ঞানের দিক থেকে অগ্রহণযোগ্য হলেও, সেগুলো এখন পর্যন্ত বেঁচে রয়েছে শিল্প-সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ হিসেবে। সেগুলো টিকে আছে উপকথা ও পৌরাণিক কাহিনী হিসেবে।
জগতে ঘটমান অনেক ক্ষেত্রেই পৌরাণিক গল্প-কাহিনীর দেখা পাওয়া যায়। যেমন- পৃথিবীতে মানুষ কীভাবে আসলো তা নিয়ে গ্রিক, তাসমানীয়, ভাইকিং প্রভৃতি জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব ব্যাখ্যা আছে। প্রাণের বৈচিত্র্য কেন আছে, তা নিয়ে উত্তর আমেরিকার হোপি, নাভাহো, পিউরো প্রভৃতি অঞ্চলে নানা উপকথা প্রচলিত আছে। মানুষ কেন এত এত ভাষায় কথা বলে তা নিয়েও পৌরাণিক ব্যাখ্যা আছে। শীত কেন আছে, গ্রীষ্ম কেন আছে, শীত-গ্রীষ্ম কেন চক্রাকারে চলতে থাকে, রাত কেন আছে, দিন কেন আছে, রাত-দিনের কেন সুনির্দিষ্ট চক্র আছে- এসব নিয়ে অস্ট্রেলীয়, কানাডীয়, গ্রিক প্রভৃতি অঞ্চলে আলাদা আলাদা উপকথা প্রচলিত আছে। সূর্য আসলে কী, সূর্য কেন উঠে, চাঁদ কেন আকৃতিতে সূর্যের সমান হয়েও সূর্যের মতো তীব্র নয় তা নিয়েও অনেক অঞ্চলে অনেক কাহিনী প্রচলিত আছে। রংধনু, মহাবিশ্বের উৎপত্তি, ধূমকেতু, সমুদ্র, নদী, মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি, বন্যা, খরা ইত্যাদি অনেক কিছু নিয়েই পৌরাণিক উপকথা বিদ্যমান আছে।
কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্র আছে যেগুলো সম্পর্কে অনেক খোঁজাখুঁজি করলেও কোনোপ্রকার পৌরাণিক উপকথার দেখা পাওয়া যাবে না। এমন অনেক অনেক বিষয়ের উদাহরণ দেয়া যায়। এর মধ্যে চমৎকার একটি হচ্ছে, ক্ষুদ্র জগৎ তথা মাইক্রোস্কোপিক লেভেল। ক্ষুদ্র জগৎ নিয়ে সংশ্লিষ্ট কোনো পৌরাণিক কাহিনী খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। যে সকল প্রাচীন মানুষ পৌরাণিক কাহিনীগুলোর জন্ম দিয়েছিল, তাদের ধারণাতেই আসেনি ক্ষুদ্র জগৎও চমৎকারিত্বে ভরা এবং এই জগৎ নিয়েও প্রচুর কাহিনী তৈরি করা যায়। এই ব্যাপারটি নিয়ে যদি চিন্তা-ভাবনা করা হয়, তাহলে দেখতে পাবো, এটি খুব একটা অবাক করা বিষয় নয় যে, কেন তাদের মনে ক্ষুদ্র জগৎ নিয়ে কোনো কাহিনীর জন্ম হয়নি।
রোগ শোক তথা ব্যাকটেরিয়া-ভাইরাস, যৌগ, মৌল, অণু, পরমাণু ইত্যাদির ক্ষুদ্র জগৎও যে চমৎকার একটি মহাবিশ্ব, এ সম্বন্ধে জানার কোনো উপায় ছিল না তখনকার মানুষের। পৌরাণিক কাহিনী তৈরি হয়েছে বাস্তব জীবনে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনার ব্যাখ্যা দিতে। যেহেতু তখনকার মানুষ ক্ষুদ্র জগত সম্বন্ধে জানতোই না, সেহেতু এই জগতের ব্যাখ্যারও প্রয়োজন পড়েনি এবং তাই কোনো পৌরাণিক কাহিনীরও জন্ম হয়নি।
ষোড়শ শতাব্দীতে অণুবীক্ষণ যন্ত্র (মাইক্রোস্কোপ) উদ্ভাবনের আগ পর্যন্ত ক্ষুদ্র পরিমণ্ডলে বিস্তার করা এই জগৎ সম্পর্কে কেউই জানতো না। ষোড়শ শতাব্দীর পরে মানুষ আবিষ্কার করেছে যে, পুকুর-ডোবা-খাল, মাটি-ধূলো-বালি এমনকি আমাদের নিজেদের শরীরে অতিক্ষুদ্র প্রাণেরা বসবাস করছে। এগুলো এতটাই ক্ষুদ্র যে, এদের আমরা খালি চোখে দেখতে পাই না। কিন্তু তারপরেও এরা প্রাণ বা জীব, ক্ষুদ্র বলে এদের গঠনও যে সরল হয়ে যাবে এমন না। যথেষ্ট পরিমাণ জটিল এদের গঠন ও কর্মপ্রক্রিয়া। আর এদের সকলেই বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে সৌন্দর্যময় কিংবা ভয়ঙ্কর। সুন্দর দেখাবে নাকি ভয়ঙ্কর দেখাবে, তা নির্ভর করবে আমরা তাদেরকে কোন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছি তার উপর।
নিচের ছবির জীবটি ধূলোবালিতে বাস করা একধরনের অতিক্ষুদ্র প্রাণ (Mites)। শারীরিক গঠনে কিছুটা মাকড়সার মতো কিন্তু ক্ষুদ্র বলে, এদেরকে কণা বা ফুটকীর মতো বলে মনে হয়। এরকম হাজার হাজার ক্ষুদ্র জীব বাস করছে আমাদের ঘরে, কার্পেটে, বিছানায়।
আদিম মানুষেরা যদি তাদের সম্পর্কে জানতো বা ধারণা রাখতো, তাহলে এটা বলা বাহুল্য যে, তারা কী পরিমাণ পৌরাণিক গল্প আর উপকথার জন্ম দিতো এদেরকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে। কিন্তু মাইক্রোস্কোপ আবিষ্কারের আগ পর্যন্ত কেউ কল্পনাও করতে পারেনি, ক্ষুদ্র স্কেলে এমন আশ্চর্য এক জগৎ লুকিয়ে আছে আমাদেরই চারপাশে।
এই জীবগুলো অনেক ক্ষুদ্র হলেও এরা একশত ট্রিলিয়নেরও বেশি পরিমাণ পরমাণু ধারণ করে। এর থেকে অনুমান করা যায় পরমাণু কতটা ক্ষুদ্র। দৃষ্টিগোচর হবার জন্য ধূলোর পোকা যথেষ্ট ক্ষুদ্র হলেও, এর চেয়েও অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রাণের অস্তিত্ব আছে। যেমন- ব্যাকটেরিয়া, এরাও একধরনের জীব এবং এরা ধূলিপোকার দেহের অভ্যন্তরে বসবাস করে। আমাদের দেহেও এরকম ক্ষুদ্র ব্যাকটেরিয়া আছে প্রচুর পরিমাণে। ব্যাকটেরিয়ার চেয়েও আরো ক্ষুদ্র প্রাণের অস্তিত্ব আছে এবং এসব ক্ষুদ্র প্রাণ প্রচুর পরিমাণে বাসও করছে আমাদের শরীরে। শুধু আমাদের শরীর কেন, ক্ষুদ্র ব্যাকটেরিয়ার শরীরেও বাস করছে আরো ক্ষুদ্র ভাইরাস।
পুরো পৃথিবীটাই অবিশ্বাস্য রকমের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রাণ দিয়ে পরিপূর্ণ। এদের কাউকেই খালি চোখে দেখা যায় না এবং পৃথিবীর কোনো পৌরাণিক গল্পেই এদের কোনো ব্যাখ্যা নেই। প্রাচীন মানুষেরা বিশ্বাস করতো, পৃথিবীর সমস্ত প্রাণবৈচিত্র্যই তৈরি করেছেন মর্ত্য ও নক্ষত্রলোকে বসবাসকারী এবং সর্ববিষয়ে জ্ঞানী দেব-দেবীরা। তাদের পুঁথিতে ক্ষুদ্র জগৎ সম্পর্কে কোনো কিছুরই কোনো দেখা নেই।খেয়াল করলে দেখা যাবে, আধুনিক বিজ্ঞানের আবিস্কার-উদ্ভাবনগুলোর কোনো উল্লেখই নেই দেবতাদের গল্প-কাহিনীতে। দেব-দেবীদের গল্প বা গ্রন্থগুলো বলে না বা বলতে পারে না যে, এই মহাবিশ্ব কত বড় কিংবা এই মহাবিশ্ব কত বছর বয়সী; তারা বলে না কীভাবে ক্যান্সারের প্রতিরোধ করতে হয়; তারা মহাকর্ষের কোনো ব্যাখ্যা দেয় না; অন্তর্দহন ইঞ্জিনের কার্যপ্রণালীর ধারণা দেয় না; তারা আমাদেরকে রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু বা নিউক্লিয়ার ফিশন বা বিদ্যুৎ বা এনেস্থেটিক সম্পর্কে কোনোকিছুই বলে না।
সত্যি কথা বলতে কী, এসব গল্পকাহিনী বা গ্রন্থগুলো যখন কারো দ্বারা রচিত হয়েছিল, এগুলো তখনকার সময়ের পরের কোনো তথ্যই ধারণ করে না। রচয়িতাদের পক্ষে ভবিষ্যৎ জ্ঞানের কোনোকিছু লিপিবদ্ধ করা সম্ভব নয়। ঐ গ্রন্থগুলোতে যা আছে তা তখন পর্যন্ত প্রাপ্ত জ্ঞানের বাইরে নয়। আর ঐ সময়গুলোতে বিজ্ঞানের কোনো অগ্রগতিই ছিল না, তাই এটি খুবই স্বাভাবিক যে, এসব গ্রন্থ বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে খুব একটা গ্রহণযোগ্য বা নির্ভুল হবে না। বাস্তবেও দেখা যায় সেটি, পৌরাণিক গল্পকাহিনীগুলোতে প্রচুর বৈজ্ঞানিক অসামঞ্জস্যতা পাওয়া যায়।
আবার অন্যদিকে বিজ্ঞানও কোনো আরাধ্য বিষয় নয়। বিজ্ঞানের সাথে কোনো কিছু না মিললে সেটা অচ্ছুৎ হয়ে যাবে ব্যাপারটা এমন নয়। পৌরাণিক কাহিনীগুলো বেঁচে থাকবে তাদের কল্পনা-শিল্প-সাহিত্যের আবেদনের মাধ্যমেই। আর আধুনিক যে যে বিষয়ের উপকথা নেই, সেগুলো নিয়ে যে উপকথা তৈরি হবে না তা কিন্তু নয়। প্রশ্ন আসতে পারে, এই আধুনিক কালেও কীভাবে পুরাণ আর উপকথার জন্ম হতে পারে? আসলে উপকথা তো কোনো না কোনো কালের মানুষেরাই বানায়। প্রাচীনকালে জন্ম নেয়া উপকথাগুলোও তো তাদের সময় ‘আধুনিক’ ছিল। তাদের সময়ের প্রেক্ষিতে সেগুলো ছিল ‘বর্তমান’। এখন আমরা সেগুলোর বাস্তবতা-অবাস্তবতা নিয়ে হাসাহাসি করি। ঠিক একইভাবে আমাদের আজকের যুগের কোনো অন্ধবিশ্বাসও তো হতে পারে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে হাস্যকর উপকথা।
এই কালেও অন্ধবিশ্বাস, সে কী করে হয়? হয় হয়, আজকের যুগেও হয়। এর উৎকৃষ্ট একটি উদাহরণ হচ্ছে এলিয়েনের উপকথা। এলিয়েনের উপকথা এতটাই আগ্রহোদ্দীপক যে, তাদেরকে নিয়ে বলতে গেলে স্বতন্ত্র একটি লেখা তৈরি করতে হবে। সৌভাগ্যক্রমে, এলিয়েনের আধুনিক উপকথা নিয়ে আগে থেকেই Roar বাংলায় একটি লেখা আছে, আগ্রহীরা দেখতে পারেন।