ঘড়িতে রাত তিনটা বাজে। আপনি বিছানায় শুয়ে আছেন, চোখে তন্দ্রার লেশমাত্র নেই। আপনার কানে বাজছে একজনের আওড়ানো বুলি, “তোমাকে দিয়ে হবে না”, “তুমি অযোগ্য, নিকৃষ্ট”, “তুমি পারবে না” ইত্যাদি।
আর এই মানুষটি আপনি নিজে!
কখনো কি আয়নার মানুষটি আপনাকে পীড়া দেয়? তাকে দেখলে কি আপনার দম বন্ধ হয়ে যায়? প্রতিদিন যাবতীয় সমস্যা বা ব্যর্থতার জন্য অনবরতভাবে আপনি তাকেই দায়ী করেন? তার সাথে থাকা, তার কাজ, তার সত্ত্বাকে কি আপনি অপছন্দ, এমনকি ঘৃণা করেন?
উত্তরগুলো যদি ‘হ্যাঁ’ হয়ে থাকে, তবে বলতে হবে আপনি একজন Self loather, যার অর্থ আপনি নিজেকে ঘৃণা করেন।
বিভিন্ন সমস্যা বা ভুলের জন্য কম-বেশি আমরা সবাই নিজেকে দায়ী করি। কিন্তু একজন সেলফ লোথার, সে সবকিছুর জন্য নিজেকে দায়ী করে, নিজেকে নিজেই সেসব কাজের জন্য শাস্তি দেয়, যার সাথে তার কোনো সম্পর্কই ছিল না!
অবশ্য অনেক সময়ই আছে যখন মানুষ নিজেকে কাজে উৎসাহী করার জন্য সেলফ লোথিংয়ের আশ্রয় নেয়। অথচ আমরা কেউই কিন্তু জন্মগতভাবে নিজেকে ঘৃণা বা নিজেই নিজেকে দমিয়ে রাখি না। মনোবিজ্ঞানীদের মতে পারিপার্শ্বিকতার দরুন এমনটি হয়ে থাকে।
কীভাবে বুঝবেন যে আপনি সেলফ লোথিংয়ের শিকার হচ্ছেন?
১
কোনো কাজে করার পূর্বেই আপনি নিজের লক্ষ্য যতটা হওয়া উচিত তার চেয়ে অনেক নিচে রাখেন। ভাবেন যে, এতে করে যদিও বা আপনি সফল হন কিংবা ব্যর্থ হন, ফলটি আর আপনাকে আঘাত করতে পারবে না। আপনি হয়ত এটা মনে করছেন, লক্ষ্য নিচে স্থির করলে আপনার সেটাতে পৌঁছাতে অতটা কষ্ট করতে হবে না, কিন্তু এ কাজ করতে গিয়ে যে আপনি নিজের কাছেই নিজেকে হেয় করছেন, তা আপনি বুঝতে পারছেন না। আপনি জানছেনও না যে কীভাবে আপনি প্রতিনিয়ত নিজের যোগ্যতাকে ছোট করে দেখছেন এবং দেখা যাবে ভবিষ্যতে আপনি অনেক সুযোগ হেলায় হারিয়ে ফেলছেন স্রেফ চেষ্টা ও আত্মবিশ্বাসের অভাবে।
২
আপনি অনবরত নিজেকে দোষ দিতে থাকেন, কখনো এমন কোনো ঘটনার জন্য যার সাথে আপনার কোনোকালেই সম্পর্ক ছিল না। সবসময় আপনার মধ্যে একধরনের অপরাধবোধ কাজ করে। ছোটখাটো ভুলের জন্য আপনি সবসময় সঙ্কুচিত থাকেন। সবকিছুর দায় আপনি নিজের কাঁধে তুলে নেন।
ধরা যাক, আপনাদের দলগত কোনো কাজের ফল বিশেষ সুবিধার হয়নি, দোষ আপনার একার না, কিন্তু আপনি নিজের কাঁধেই তা পুরোটুকু তুলে নিচ্ছেন। অকারণে আপনি অন্যের কাছে ক্ষমা চাচ্ছেন। কোনো কারণ ছাড়াই আপনি সবার সামনে নিজেকে ছোট করে তুলে ধরছেন। আপনি মানুষ হিসেবে নিজেকে যত তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করবেন, ততই আপনার দৈনন্দিন জীবনে তা প্রভাব ফেলবে। কারণ যেখানে আপনি নিজেই নিজেকে মর্যাদা দিতে পারছেন না, সেখানে আরেকজন কীভাবে আপনাকে সেই মর্যাদা দেবে?
৩
আবার অনেক সময় নিজেকে তিরস্কার করে অনেকেই নিজেকে কাজে উদ্বুদ্ধ করে। এটা এক ধরনের রিভার্স সাইকোলজি। “এটাই করতে পারছি না? এতদিন তাহলে কী শিখলাম?” বা “এটা না করতে পারলে আমি সমাজে বেঁচে থাকার অযোগ্য”- অনেকটা এ ধরনের কথা বলে নিজেকে একরকম উৎসাহ প্রদান করে। অনেকের ক্ষেত্রেই তা কাজে লাগে। কিন্তু আদতে এহেন ঋণাত্মক আচরণ ব্যক্তির মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য কতটা মঙ্গলজনক তা প্রশ্নসাপেক্ষ। কারণ এ ধরনের আচরণ পরবর্তীতে হতাশা ও দুশ্চিন্তা ডেকে আনে।
৪
আপনি শুধু নিজের ভুলগুলোর উপর নজর দিচ্ছেন। আমরা মানুষ; ভুল-শুদ্ধ সিদ্ধান্ত নিয়েই তো জীবন। কিন্তু একজন সেলফ লোথার শুধু নিজের ভুল করার সময়গুলো মনে রাখে। ফলে তার নিজের কাছে মনে হতে থাকে যে, তার দ্বারা ভুল বৈ সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব না। নিজের বিদ্যা ও গুণাবলী সন্দেহের চোখে দেখা শুরু করে, অনবরত নিজেকে আঘাত করে সে। এতে তার কোনো উন্নতি তো হয়ই না, বরং আত্মবিশ্বাস দিনদিন কমতে থাকে। সর্বক্ষণ তার মনে হতে থাকে, “আমি পারব না”, “আমার দ্বারা ভালো কিছু সম্ভব না”, “হবে না” ইত্যাদি।
৫
আপনি অন্যের সাথে নিজেকে তুলনা করেন সবসময়। কে কী পেলো এবং তাদের তুলনায় আপনি জীবনে কী করতে পেরেছেন- এ নিয়েই আপনি সবসময় দুশ্চিন্তাগ্রস্ত থাকছেন। “অমুক মানুষের সাথে মিশতে পারে ভালো, আমি সেটাও পারি না”, “অমুক সুশ্রী, আমি কুশ্রী” – প্রতিনিয়ত নিজেকে অপরের সাথে তুলনা করতে গিয়ে দেখা যাবে যে হয় আপনি অবাস্তব চিন্তা করছেন অথবা নিজেকে হেয় মনে করছেন।
ভালো খারাপ এ দুয়ে মিলেই তো মানুষ। স্বাভাবিকভাবেই সবারই একেকরকম গুণ থাকবে। অন্যরা যে কাজে পারদর্শী তাতে আপনি পারদর্শী না-ও হতে পারেন, আবার এর উল্টোটাও সত্য। তাই অহেতুক অন্যের সাথে নিজেকে তুলনা করা, ঈর্ষান্বিত হওয়া মোটেও বুদ্ধিমানের কাজ নয়। সেলফ লোথের ব্যাধি আছে যাদের, তারা প্রতিনিয়ত সমাজে টিকে থাকার জন্য স্বীকৃতির সন্ধান করেন অন্যের কাছ থেকে। তাকে নিয়ে কে কী ভাবল, কে তাকে গ্রহণ করল তা নিয়ে সে ব্যতিব্যস্ত থাকে। এ এক ধরনের ব্যাধি, যা মানুষকে কুড়ে কুড়ে খায়। এর কবল থেকে রেহাই পাননি বহু প্রসিদ্ধ ব্যক্তি। লেখক ফ্রান্সিস কাফকা থেকে শুরু করে অভিনয়শিল্পী মেরিল স্ট্রিপ, জনি ডেপ কিংবা সংগীত শিল্পী জন লেনন, কার্ট কোবেইন প্রমুখ ব্যক্তি সেলফ লোথের শিকার। সেলফ লোথ একটা চোরাবালির মতো, ধীরে ধীরে মানুষ তাতে তলিয়ে যেতে থাকে এবং একসময় সে নিজেকে হারাতে বসে। এমনকি নিজের প্রাণও।
নিজেকে ধীরে ধীরে ক্ষয়ে ফেলা এসব মানুষ জীবনের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে নিজের প্রতি তীব্র বিতৃষ্ণার জন্য। দেখা যাবে তারা দৈনন্দিন সব কাজই করছেন, সবার সাথে হাসছেন, আড্ডা দিচ্ছেন, কিন্তু ভেতরে ভেতরে তারা প্রচন্ড দুঃখী, প্রচন্ড একা। আর তারা যা-ই অর্জন করুক না কেন, যতই গুণবান হোক না কেন- নিজেদের কাছে তারা সেই একই- ক্ষুদ্র, নিকৃষ্ট। তারা নিজেদের মস্তিষ্কে নিজের তৈরি কারাগারে বন্দী। একপর্যায়ে তারা সে বন্দীশালা থেকে মুক্তি পাবার জন্য সবচেয়ে ভয়ংকর রাস্তা বেছে নেয়- আত্মহত্যা। এ কথা বলা বাহুল্য যে, আত্মহননের একটা বড় কারণ হল নিজের প্রতি ঘৃণা। শত শত সুইসাইড নোটে উহ্য থেকে যায় আত্মগ্লানির হাহাকার।
তাহলে উপায়?
১
প্রথমত আপনার উচিত আপনি মন থেকে যে কাজটা করতে চাচ্ছেন সে অনুযায়ী লক্ষ্য স্থির করা। এতে আপনার ব্যর্থ হবার সম্ভাবনা থাকলেও আপনার উচিত নিজেকে সেই কাজে উদ্যমী হওয়া কারণ ব্যর্থতা থেকেই সফলতা আসে। ভয় পেলে চলবে না, প্রথম কদমটা ফেললেই না আপনি সামনে এগোতে পারবেন।
২
অহেতুক নিজেকে দোষারোপ করা এবং অন্যের কাছে নতজানু হয়ে থাকার অভ্যাস পরিত্যাগ করুন। অকারণে ক্ষমা চাইতে চাইতে আপনি আপনার অবস্থানকে যেমন দুর্বল করছেন, তেমনি দুর্বল করছেন নিজের কথার ওজনকে। এরপর হয়ত দেখা যাবে আপনি যখন কোনো ভুলের জন্য ক্ষমা চাচ্ছেন, তখন আপনার আন্তরিকতাকে আর গুরুত্ব দেয়া হবে না। কেননা আপনি যে পান থেকে চুন খসলেই মানুষের কাছে মাফ চেয়ে বসেন! আপনার কথার ভার, আপনার অবস্থান এতটাই দুর্বল হয়ে দাঁড়িয়েছে যে আপনার আন্তরিক অনুতাপকে আর দাম দেয়া হবে না। সুতরাং অহেতুক ক্ষমাপ্রার্থনা আর না।
৩
নিজেকে ইতিবাচকভাবে উৎসাহ দিন। “আমি পরিশ্রম করেছি তাই আমি পারব” কিংবা “এতদিন নাহয় হেলাফেলা করেছি, কিন্তু এখন থেকেই সর্বোচ্চ চেষ্টা করলে আমি সফল হবো”- এ ধরনের কথা বলে নিজেকে উদ্বুদ্ধ করুন। সফল হলে নিজেকে বাহবা দিন আর ব্যর্থ হলে নিজেকে সান্ত্বনা দিন। “এবার হয়নি তো কী হয়েছে, এর পরেরবার হবে”- এভাবে উৎসাহ দিন নিজেকে। নিজের পিঠ চাপড়াতে শিখুন।
৪
নিজের ভুলের সাথে সাথে সঠিক সিদ্ধান্তের বা কাজের কথা মনে করবেন। নিজের ইতিবাচক গুণাগুলো মনে করবেন এবং নিজের ভুল হতে শিক্ষা নেবেন। মনে রাখবেন, ব্যর্থতা থেকে শেখার আছে অনেক কিছু।
৫
অন্যের সাথে নিজেকে তুলনা করার চেয়ে নিজেকে নিজের সাথে তুলনা করুন। নিজেকে উন্নত করুন কাজে-কর্মে-অভ্যাসে। সবসময় সামনের দিকে চোখ রাখবেন। আজকের ‘আপনি’ যেন গতদিনের ‘আপনি’র চেয়ে হন আরো জ্ঞানী, আরো কর্মঠ। এমন একজন হয়ে উঠুন যাকে নিয়ে আপনি গর্ব করতে বাধ্য।
সেলফ লোথ নিজের সাথে একপ্রকার যুদ্ধ। আপনাকে যুদ্ধ করতে হচ্ছে আরেক ‘আমি’র সাথে, যে কিনা সর্বক্ষণ আপনাকে দমিয়ে রাখতে চায়, ধ্বংস করতে চায়।
“আমরা যখন ঘৃণা করার জন্য আর কাউকে পাই না, তখন আমরা নিজেদেরকে ঘৃণা করি।”
আত্মসমালোচনা অবশ্যই একটি বড় গুণ, কিন্তু নিজের প্রতি অবিচার করা নয়। মানুষ তার স্বভাবগত বৈশিষ্ট্যের জন্য চায় যেন অন্যরা তাকে বোঝে, সকলের কাছে গ্রহণযোগ্যতা চায়। কিন্তু যে মানুষ নিজেকেই গ্রহণ করতে পারে না, আরেকজনের কাছে সে গ্রহণযোগ্যতা আশা করবে কীভাবে?
“আপনি যদি নিজের আচরণকে ঘৃণা করতে পারেন তাহলে হয়ত আপনি নিজেকে ভালোবাসতেও পারবেন।”
দিনশেষে আমাদের সবচেয়ে কাছের জন কিন্তু আমাদের ছায়া। আপনিই আপনার সবচেয়ে বড় সমর্থক, সবচেয়ে আপনজন। কেবল আপনিই পারবেন নিজেকে সম্পূর্ণ করতে, অন্য কেউ না। তাই নিজেকে ভালোবাসুন, মাথা উঁচু করে বাঁচুন।