স্ট্যালিনের শাসনামলে ভুল জায়গায় একটি ভুল কথাও দরজায় ডেকে নিয়ে আসতে পারতো রাশিয়ার বিশেষ পুলিশ দলকে, যারা সোভিয়েত গুলাগে আপনাকে টেনে নিয়ে যেতে সর্বদা প্রস্তুত, যেখানে মৃত্যুর ডাক না আসা পর্যন্ত আপনাকে কাজ করে যেতে হবে!
Главное управление лагерей বা সংক্ষেপে (ГУЛАГ-গুলাগ), এর সহজ অর্থটা হচ্ছে শ্রমিক শিবির, যাদেরকে জোর করে ধরে আনা হয়েছে। ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লব হওয়ার পরপর এই গুলাগ ক্যাম্পগুলো বানানো হলেও ১৯৩০-এর দশকে গুলাগের বন্দী সংখ্যা হুহু করে বাড়তে থাকে, যখন সোভিয়েত কর্ণধার জোসেফ স্ট্যালিন বিশাল ইউএসএসআর-এ শিল্প বিপ্লব ঘটানোর পরিকল্পনা করলেন।
স্ট্যালিনের সময়ে প্রায় ১৪ মিলিয়ন লোককে গুলাগে বন্দী করা হয়। এদের মধ্যে অনেকেই রাজনৈতিক বন্দী, কেউবা সাধারণ জনগণ যারা সোভিয়েত শাসন সম্পর্কে বিরুপ মন্তব্য করেছে, আবার অনেকেই ছিঁচকে চোর কিংবা সাধারণ অপরাধী যাদেরকে গুলাগে নিয়ে আসা হয়েছে তাদের প্রাপ্য শাস্তি কড়ায় গন্ডায় বুঝিয়ে দিতে।
বন্দী শ্রমিকরা যে কারণেই আসুক না কেন, তাদের জন্য থাকা খাবারের যোগানটা ছিলো নিতান্তই অপ্রতুল। এমনও গুজব শোনা গিয়েছে যে, বন্দীরা খাওয়ার জন্য ইঁদুর কিংবা বন্য কুকুর খেতেও পিছপা হতো না – তাদের পেটের ক্ষুধা মিটাতে কোনো বাছবিচার চলতো না।
খাবারের পরিমাণ যা-ই হোক না কেন, কাজের পরিমাণটা আক্ষরিকভাবেই ছিলো একেবারে হাড়ভাঙা খাটুনি। সোভিয়েত গুলাগের ব্যবস্থাটাই এমন, যেখানে দামী প্রযুক্তি ব্যবহারের বদলে বন্দীদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হতো হাতুড়ি-কোদালের মতো সাধারণ যন্ত্র এবং তা নিয়েই কোনোমতে কাজ করতে হতো কোনোরকম অভিযোগ ছাড়াই। বন্দীরা কাজ চালিয়ে যেত তাদের সহ্যের শেষ সীমা পর্যন্ত, তারপরই ঢলে পড়তো মৃত্যুর কোলে। এত মৃত্যুর হার গুলাগ কর্তৃপক্ষের কাছে তেমন কোনো সমস্যা ছিল না; পূর্ব ইউরোপ কিংবা মধ্য এশিয়া থেকে প্রতিনিয়ত আসা বন্দীদের চালান চাহিদা তারা পূরণ করতে পারতো খুব ভালোমতোই।
গুলাগ বন্দীদের কাজও করানো হতো বড় বড় সব প্রকল্পে। মস্কো-ভলগা খাল, শ্বেত সাগর-বাল্টিক খালের পানির সাথে মিশে রয়েছে বন্দীদের রক্তাক্ত ইতিহাস। কোলিমা রাজপথের নামই তো হয়ে গিয়েছে ‘দ্য রোড অফ বোনস’ অর্থাৎ হাড়ের রাস্তা! কারণ? এই রাস্তা বানাতে এত মানুষের মৃত্যু হয়েছে যে আসফাল্ট মোড়ানো রাজপথের নিচে হাড় খুঁজে পাওয়া মোটেই অসম্ভব কিছু নয়।
স্ট্যালিনের মৃত্যুর পর গুলাগের দরজাগুলো বন্ধ হওয়া শুরু করলেও ততদিনে এই বন্দী ক্যাম্প কেড়ে নিয়েছে কয়েক লক্ষ মানুষের প্রাণ। এদের বেশিরভাগই মারা গিয়েছে অনাহারে, কারও কারও মৃত্যু হয়েছে কাজ করতে করতেই, আবার কারও শেষ আশ্রয় হয়েছে সাইবেরিয়ার বন যেখানে গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে চলৎশক্তিরহিত বন্দীদেরকে।
স্ট্যালিনের উত্তরাধিকারদের নিপীড়নের মাত্রা বেশ কম হলেও ততদিনে যা হওয়ার তা হয়ে গিয়েছে। রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে সাংস্কৃতিক নেতাদের গল্প অতীতে পরিণত হয়েছে, সাধারণ মানুষও পেয়ে গিয়েছে ভয়ে ভয়ে বেঁচে থাকার শিক্ষা।
তো সেই গুলাগের ভেতরের জীবনই দেখে নেওয়া যাক চিত্রের মাধ্যমে।
১
মলোটোভ, ইউএসএসআর – বিছানায় শুয়ে থাকা অবস্থাতেই ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে আছে বন্দী বালকেরা।
২
ভায়গাশ দ্বীপ, ১৯৩১ – এক খনি শ্রমিক মারা যাওয়ার পর তাকে কবর দেওয়ার সময় তোলা ছবি।
৩
পোল্যান্ড, ১৯৪১ – পোলিশ পরিবারগুলোকে সাইবেরিয়ার গুলাগে পাঠানোর সময়ে।
৪
ক্যাতিন, পোল্যান্ড; এপ্রিল ৩০, ১৯৪৩ – সব বন্দীদেরই গুলাগে যাওয়ার সৌভাগ্য হতো না। পোলিশ বন্দীদের উপর গণহত্যা চালানোর পর লাশের স্তূপ।
৫
তারনোপিল, ইউক্রেন; ১০ জুলাই, ১৯৪১ – বন্দী শিবিরের মধ্যে সোভিয়েত বিশেষ পুলিশের আক্রমণে নিহত রাজনৈতিক বন্দীদের লাশ।
৬
সাইবেরিয়া – সড গাছের কাঠ দিয়ে বানানো কুটিরে ঘুমিয়ে থাকা বন্দীদের একাংশ।
৭
ইউএসএসআর – মার্ক্স এবং জোসেফ স্ট্যালিনের পোস্টারে ভরে থাকা বন্দীদের ঘুমানোর ঘর।
৮
বেলোমোর খাল, ইউএসএসআর, ১৯৩২ – শ্বেত সাগর – বাল্টিক খাল খননের সময় কাজ করতে থাকা অবস্থায় বন্দীরা। এই খাল খনন করতে গিয়ে কম করে হলেও ১২ হাজার বন্দী মারা যায়।
৯
ইউএসএসআর; জুলাই, ১৯৩২ – গুলাগের বন্দীদের দায়িত্বে থাকা অফিসাররা, যারা প্রায় লক্ষাধিক মানুষকে কাজ করতে বাধ্য করেছিল।
১০
ইউএসএসআর, ১৯৩৬-১৯৩৭ – পুকুর খনন করার সময় বন্দীদের কাজ প্রত্যক্ষ করছে গুলাগ পাহারাদাররা।
১১
মস্কো, ইউএসএসআর; ২২ এপ্রিল, ১৯৩৭ – মস্কো খাল খননের অবস্থা পরিদর্শনে এসেছেন জোসেফ স্ট্যালিন, যা খননের জন্য নিয়োজিত করা হয়েছিল কয়েক হাজার বন্দীকে।
১২
ম্যাগাডান, ইউএসএসআর; ২০ আগস্ট, ১৯৭৮ – স্ট্যালিনের শাসনামলে চালু থাকা সোনার খনি
১৩
ইউএসএসআর; ২৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩৩ – সোভিয়েত শাসনব্যাবস্থাকে সমালোচনা করার জন্য দার্শনিক পাভেল ফ্লোরেন্সকিকে গ্রেফতার করার পর তোলা ছবি। এই অপরাধে তাকে গুলাগে ১০ বছরের সশ্রম দন্ড দেওয়া হয়। যদিও তিন বছরের মাথায় তাকে বনে নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়।
১৪
ইউএসএসআর; ১ মে, ১৯৩৪ – গুলাগ ক্যাম্পগুলোর পরিচালকেরা অনুষ্ঠান উদযাপন করার সময়।
১৫
ইনতা, ইউএসএসআর; ১৯৫৫ – দুই লিথুয়ানিয়ান রাজনৈতিক বন্দী কয়লা খনিতে কাজ করতে যাওয়ার আগ মুহূর্তে।
১৬
ইউএসএসআর, ১৯৩৬-৩৭ – গুলাগে মেশিন চালিয়ে কাজ করার সময় বন্দীরা
১৭
ইউএসএসআর, ১৯৩০-৩৩ – শ্বেত সাগর-বাল্টিক খাল খননের সময় কাজ করছে বন্দীরা
১৮
১৯২৯ – ইউরি তুতুনিক, সোভিয়েত-ইউক্রেন যুদ্ধে ইউক্রেনের এক জেনারেল। যুদ্ধের পর প্রথমে তাকে সোভিয়েতে থাকতে দেওয়া হলেও পরবর্তীতে তাকে গ্রেফতার করে বন্দী করা হয় এবং মেরে ফেলা হয়।
১৯
ভায়গাশ দ্বীপ, ১৯৩১-৩২ – সীসা এবং জিংকের আকরিক তুলে নিয়ে আসার সময় বন্দীরা
২০
সোলভকি দ্বীপ, ১৯২৪-২৫ – ইটের ভাটার জন্য কাঁদা তুলে আনছে বন্দী শ্রমিকরা।
২১
মস্কো, ১৯৩৫ – মস্কো খাল খননের সময় শ্রমিকদের কাজ পর্যবেক্ষণ করতে এসেছে রাশিয়ান গোপন পুলিশ NKVD প্রধান হেনরিখ ইয়াগোদা।
২২
ভায়গাশ দ্বীপ, ১৯৩৬-৩৭ – কাজের বিরতির সময় বন্দীদের তোলা ছবি
২৩
কোলিমা, ১৯৩২ – ‘দ্য রোড অফ বোন্স’ নামে পরিচিত কোলিমা রাজপথ তৈরি করছে বন্দীরা
২৪
ইউএসএসআর, ১৯৩৭-৩৮ – কোলিমা শ্রমিক শিবিরের তৎকালীন প্রধান কর্নেল স্টেপান গারানিন অপরাধ করে বন্দী হওয়ার পর।
ফিচার ইমেজ: Muppet Wiki