নবজাত শিশুকে মায়ের কোল থেকে নিয়ে পুকুরে ফেলে দেয়া হয়েছে। বাসায় ঢুকে বাবাকে খুন করে মা এবং তার তিন মেয়েকে একসাথে ধর্ষণ করা হয়েছে। ৬ এবং ৯ বছর বয়সী দুই শিশুকে গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে। এই বিভীষিকা থেকে পালিয়ে প্রতিবেশী দেশে ঢোকার জন্য যখন বর্ডার পেরোচ্ছে, তখনও পেছন থেকে গুলি করে তাদের হত্যা করা হয়েছে। মুক্তির কাছাকাছি এসেও মুক্তির স্বাদ পাওয়া হয়নি তাদের।
হ্যাঁ, বলছি বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত জাতিগোষ্ঠী, রোহিঙ্গাদের কথা। শত বছর ধরে যারা নিজ দেশে নির্যাতিত হয়ে আসছে। খুন হচ্ছে, ধর্ষিত হচ্ছে, লুণ্ঠিত হচ্ছে, লাঞ্ছিত হচ্ছে। নিজ দেশে যারা পরবাসী, দশ পুরুষ এই ভিটায় থাকার পরও যাদের মেনে নেয়া হয়নি দেশের নাগরিক হিসেবে। বাপ-দাদার শত বছরের ভিটা পুড়িয়ে দিয়ে যাদের তাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে, বহু সংগ্রাম করে প্রতিবেশী দেশে যাদের জীবন নিয়ে ছুটতে হচ্ছে একটু মাথা গোজার ঠাঁইয়ের জন্য। বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে নির্যাতিত নিপীড়িত জনগোষ্ঠীকে নিয়ে আমাদের লেখাটি।
আরাকান থেকে রাখাইন: যুগে যুগে রোহিঙ্গা নিপীড়নের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
মধ্যযুগে আরাকান রাজ্যটি ব্যবসা-বাণিজ্য, জ্ঞান এবং সংস্কৃতি চর্চার এক প্রসিদ্ধ স্থান ছিল। সতের শতকের দিকে আরাকানের রাজধানীকে দ্বিতীয় ভেনিস হিসেবেও অভিহিত করেছে অনেকে। স্থানীয় রাজারাই তখন আরাকান রাজ্য শাসন করতো।
১৭৮৪ সালে বার্মার রাজা আরাকান দখল করে নেয়। তখন থেকেই আরাকানদের দুর্ভোগ শুরু হয়। ১৮২৪ সালে বার্মা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। একশ বছরের বেশি সময় ব্রিটিশদের গোলামির পর ১৯৪৮ সালে বার্মা পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা লাভ করে। সেই সময় মুসলিম অধ্যুষিত আরাকানের অনেক রোহিঙ্গাই চেয়েছিল আরাকান নবজাত মুসলিম রাষ্ট্র পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) অংশ হোক। কিন্তু আরাকানকে বার্মার অংশ হিসেবেই রাখা হয় এবং স্বাধীন বার্মার জন্মলগ্ন থেকেই তাদের উপর চলতে থাকে দমন নিপীড়ন। বিদ্রোহ দমনের নামে ১৯৫০ সালে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে প্রথম সামরিক অভিযান পরিচালনা করা হয়। দু’বছর পর ‘অপারেশন মায়ু’ নামে আরেকটি সামরিক অভিযান চালানো হয়। সরকারের এই নিপীড়নের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গাদের ক্ষোভও ধীরে ধীরে দানা বাঁধতে থাকে। বিদ্রোহীর খাতায় নাম লেখায় অনেকে। ১৯৫৪ সালে ‘অপারেশন মুনসুন’ নামে আরেকটি জোরালো অভিযান চালু করে সেনাবাহিনী। চাপের মুখে ১৯৬১ সালে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে বিদ্রোহীরা।
১৯৬২ সালে সামরিক শাসকের বুটের নিচে চলে যায় বার্মার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা। রোহিঙ্গাদের উপর নিপীড়ন আরও বেড়ে যায়। শুরু হয় রোহিঙ্গা নিধন। ১৯৭৪ সালে আরাকান রাজ্যের নাম পরিবর্তন করে ‘রাখাইন’ রাখা হয়। বহিরাগত তাড়ানোর নামে ১৯৭৮ সালে সেনাবাহিনী ‘অপারেশন কিং ড্রাগন’ নামে আরেকটি নতুন অভিযান চালায়। নির্বিচারে গ্রেফতার, খুন, ধর্ষণ, লুটতরাজ চলতে থাকে। কয়েক লাখ রোহিঙ্গা তখন প্রাণের ভয়ে পাড়ি জমায় বাংলাদেশে।
১৯৯১ সালে ‘অপারেশন ক্লিন এন্ড বিউটিফুল’ নামে আরেক দফা রোহিঙ্গা ছাটাই অভিযান চালায় জান্তা সরকার। এই নিপীড়নের মুখেও প্রায় দু’লাখ রোহিঙ্গা পাড়ি জমায় বাংলাদেশে।
তবে ২০১২ সাল থেকে শুরু হওয়া বর্বরতা পূর্বের সব হিসাবনিকাশ ছাড়িয়ে যায়। এক বৌদ্ধ তরুণীর ধর্ষণের জের ধরে রোহিঙ্গাদের প্রতি সহিংসতা শুরু হয়। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া হয়, শত শত তরুণকে একসাথে গণ-গ্রেফতার করা হয়। মসজিদের পর মসজিদ গুঁড়িয়ে দেয়া হয়। খুন, ধর্ষণ, গুমের সংখ্যা পূর্বের সব রেকর্ড ছাপিয়ে যায়। ২০১৩ সালে হিউম্যান রাইট ওয়াচের রিপোর্টে মায়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গাদের ‘জাতিগতভাবে নির্মূল অভিযান’ চালানোর অভিযোগ আনা হয়। ১৯৭০ সাল থেকে শুরু করে ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা রাখাইন ত্যাগ করে ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায়।
রোহিঙ্গা পরিস্থিতি: বর্তমান ও ভবিষ্যত
পুরো মায়ানমার জুড়ে মোট ১৩৫টির মতো জাতিগোষ্ঠী রয়েছে। কিন্তু সরকার এবং চরমপন্থীদের রোষানলে পড়তে হচ্ছে শুধুমাত্র একটি সম্প্রদায়কেই। কারণ দুটি। প্রথমত, তারা মুসলমান এবং দ্বিতীয়ত, তাদের গাত্রবর্ণ বার্মিজদের মতো নয়, তারা কৃষ্ণবর্ণ। এই ধর্মবিশ্বাস এবং গাত্রবর্ণের জন্যই বার্মিজরা রোহিঙ্গাদের মায়ানমারের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। তারা বিশ্বাস করে, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ থেকে আগত। ১৯৮৪ সালে সামরিক জান্তা আইন করে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব বাতিল করে। এমনি সু চি সরকারের আমলে হওয়া সাম্প্রতিক আদমশুমারিতেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি রোহিঙ্গাদের। কিন্তু ইতিহাস বলছে, তিন-চারশো বছর পূর্বেও এই আরাকানে রোহিঙ্গাদের শক্ত সাংস্কৃতিক শেকড় প্রোথিত ছিল। একসময় আরাকানের রাজা ছিল রোহিঙ্গারাই। কিন্তু সেই রাজারাই আজ শরণার্থী, মাথা গোঁজার জন্য এতোটুকু ঠাঁইও নেই।
শত শত বছর ধরে নিপীড়নের স্বীকার হয়ে আসলেও, সাম্প্রতিক সময়ে রোহিঙ্গাদের উপর চালানো সরকারি বাহিনীর নৃশংসতা পুরো বিশ্বকেই হতবাক করে দিয়েছে। সাম্প্রতিক সহিংসতার সূত্রপাত ঘটে ২০১৬ সালের ২৫ আগস্ট। সরকারী তথ্যমতে, রাখাইনে একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী রোহিঙ্গা সংঘ পুলিশের উপর আক্রমণ চালায়। এর জের ধরেই সরকার রাখাইনে রোহিঙ্গা নির্মূল অভিযানে নামে। এই অভিযানের অংশ হিসেবেই সরকারি বাহিনী উগ্রপন্থী বৌদ্ধদের সহায়তা নিয়ে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিতে থাকে, নির্বিচারে গণহত্যা চালায়, তাদের পাশবিক নির্যাতন থেকে রেহাই পাচ্ছে না নারী ও শিশুরাও। সম্প্রতি জাতিসংঘ রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে চালানো ঘৃণ্য এই অভিযানকে ‘জাতিগত নির্মূলের একটি আদর্শ উদাহরণ’ হিসেবে উল্লেখ করেছে। খুন, লুণ্ঠন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগের হাত থেকে বাঁচতে হাজারে হাজারে রোহিঙ্গা সীমানা পেরিয়ে বাংলাদেশে আসছে। বাংলাদেশ সরকারের তথ্য অনুযায়ী এখন পর্যন্ত ৪ লাখেরও বেশি শরণার্থী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এ সংখ্যা যে আরও বাড়বে, তা বলাই বাহুল্য। কেননা, রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ চলছেই। পূর্বের প্রত্যেকবার এড়িয়ে গেলেও এবার বাংলাদেশ সরকারও আনুষ্ঠানিকভাবে রোহিঙ্গাদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছে। সরকার রোহিঙ্গাদের জন্য কক্সবাজারের কুতুপালং-এ নতুন করে ২০ হাজার একর জমি এবং আরও ১৪ হাজার নতুন আশ্রম নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সরকার জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক নেতৃবৃন্দকে এই সঙ্কটে মায়ানমারের উপর চাপ প্রয়োগেরও আহবান জানিয়েছে। কিন্তু মায়ানমার সরকার এই বিষয়ে আগের মতোই নীরব রয়েছে। রোহিঙ্গাদের পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করার আগ পর্যন্ত তাদের পাশবিকতা থামবে বলে মনে হচ্ছে না।
এই মুহূর্তে বাংলাদেশ এবং মায়ানমারে থাকা প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গার ভবিষ্যৎ পুরোপুরি অনিশ্চিত। এইভাবে রোহিঙ্গা নিধন চলতে থাকলে আগামী এক বছরের মধ্যে হয়তো মায়ানমারে কোনো রোহিঙ্গা খুঁজে পাওয়া যাবে না। আর যারা বাংলাদেশে পাড়ি জমিয়েছে তাদেরও কোনো নিশ্চিত ভবিষ্যৎ নেই। কেননা, তারা কখনো নাগরিকত্ব পাবে না, তাদের সন্তানরা স্কুলে ভর্তি হতে পারবে না এবং তারা কোনো চাকরিতেও যোগ দিতে পারবে না। সুতরাং বলতে গেলে, রোহিঙ্গা সম্প্রদায় তাদের অস্তিত্বের সর্বশেষ ধাপে অবস্থান করছে।
রোহিঙ্গা সঙ্কটে সু চি এবং বিশ্ব নেতৃবৃন্দের অবস্থান
পুরো বিশ্বের জন্যই এটা অনেক লজ্জাজনক যে, একটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর এভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়ে আসছে মানবাধিকার আন্দোলনের আরেক চ্যাম্পিয়নের চোখের সামনে। শান্তিতে নোবেলজয়ী একজন মানবাধিকারকর্মীর সামনেই তার নিজ দেশের একটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে চিরতরে বিনাশ করে দেয়ার ষড়যন্ত্র চলছে। রোহিঙ্গা সঙ্কটে সু চির নীরবতা এবং তার রাষ্ট্রক্ষমতায় অবস্থানকালে চলমান এই সহিংসতায় সু চির নীরব সমর্থনের বিরুদ্ধে নিন্দার ঝড় বইছে পুরো বিশ্বজুড়ে। সু চির নোবেল পুরস্কার ফিরিয়ে নেয়ারও আহবান জানানো হয়েছে নোবেল কমিটির কাছে। তার চোখের সামনে এই গণহত্যা চললেও বিশ্ব-গণমাধ্যমের কাছে সু চি বরাবরই তা অস্বীকার করে আসছেন। সাম্প্রতিক নির্যাতিত নারীদের মধ্যে একজন গণমাধ্যমের সামনে সাহসীভাবে বর্ণনা করে, কীভাবে সামরিক বাহিনী তার স্বামীকে হত্যা করে এবং তার তিন মেয়ের সাথে তাকে একসাথে গণধর্ষণ করে। কিন্তু এরপরের ঘটনা সবাইকে আরো হতবাক করে দেয়। সু চির ফেসবুক পেজে এই মহিলাকে উপহাস করে বলা হয় এটা ‘জাল ধর্ষণ’। এই গণহত্যার পেছনের মূল হোতা কিন্তু সু চি নন। সামরিক বাহিনীর উপর কোনো কর্তৃত্বই নেই মায়ানমার সরকারের। পর্দার আড়ালে থেকে তাই সামরিক বাহিনী দিয়ে গণহত্যা চালাচ্ছে সেনাপ্রধান মিন অং লাইং। রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব বরাবরই অস্বীকার করা মিং রোহিঙ্গা নির্মূল সম্বন্ধে বলেছেন, “এটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অসমাপ্ত অধ্যায়”। রোহিঙ্গা মুসলিমদের উপর ‘KJ vids’ এর বানানো একটি ভিডিও ক্লিপস তুলে দেয়া হলো-
রোহিঙ্গারা তাদের অস্তিত্বের সর্বশেষ পর্যায়ে থাকলেও তা নিয়ে এতোটা ভ্রুক্ষেপ নেই বিশ্ব-নেতৃবৃন্দের। এমনকি তুরস্ক এবং ইরান বাদে অন্য কোনো মুসলিম রাস্ট্রও এ হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে নিন্দা জানায়নি। অন্যদিকে মায়ানমারকে এককভাবে সমর্থন দিচ্ছে তাদের দীর্ঘদিনের বন্ধুরাষ্ট্র, চীন। মানবাধিকার সংঘও প্রবেশ করতে পারছে না রাখাইন প্রদেশে। রাশিয়াও এটাকে মায়ানমারের ‘অভ্যন্তরীণ সংকট’ উল্লেখ করে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছে। বিশ্ব-রাজনীতিতে দুই বিপরীত শক্তি একদিকে থাকার ফলেই হয়তো উল্টো অবস্থান নিতে হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রকে। কিন্তু তাদের কার্যক্রম শুধু ‘গভীরভাবে নিন্দা জানানো’ পর্যন্তই সীমিত। ওদিকে গোপনে মায়ানমারে এই গণহত্যার মদত জুটিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় বন্ধুরাষ্ট্র, ইসরাইল। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, মায়ানমারের সামরিক বাহিনীকে অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করে আসছে ইসরাইল। ভারতও এই মর্মে মায়ানমারেরই পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছে। সুতরাং বিশ্বের সব বড় বড় শক্তিরা যখন মায়ানমারের পাশেই রয়েছে কিংবা নীরব রয়েছে, তখন বলতেই হয়, রোহিঙ্গারা আসলেই হতভাগা।
মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে রোহিঙ্গারা এখন অস্তিত্বের শেষ ধাপে আছে, অর্থাৎ জাতি হিসেবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার কাছাকাছি এসে পড়েছে তারা। যুগে যুগে অনেক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কেই নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার ষড়যন্ত্র হয়েছে। অনেক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কেই নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার জন্যই চলেছে গণহত্যা। ইতিহাসের নীল পাতায় রোহিঙ্গারাও হয়তো সেই সারিতে গিয়েই দাঁড়াবে জার্মানির ইহুদি ও রোয়ান্ডার তুতসিদের পাশে।