ভ্যাম্পায়ার বলতেই আমাদের মানসপটে যে নাম বা চেহারা ভেসে ওঠে, তা হচ্ছে ড্রাকুলা। ড্রাকুলা আর ভ্যাম্পায়ার শব্দ দুটো যেন একে অপরের পরিপূরক। অথচ ব্রাম স্টোকারের ড্রাকুলারও হাজার হাজার বছর আগে থেকে ভ্যাম্পায়ার মিথ প্রচলিত আছে মানবসমাজে। আপনি জানেন কি, কীভাবে সেই মিথগুলোতে ভ্যাম্পায়ারদের জন্ম হয়, কীভাবেই বা তাদের বিস্তার? কীভাবে এলো প্রথম ভ্যাম্পায়ার? ভ্যাম্পায়ার মিথ সমগ্র নিয়েই আমাদের আজকের আয়োজন।
ভ্যাম্পায়ার বলতে আমরা অতি অবশ্যই Stephenie Meyer এর লেখা Twilight সিরিজের বই বা মুভিগুলোতে দেখানো রূপবান বা রূপবতী ভ্যাম্পায়ারদের কথা বলছি না, সত্যিকারের ভয় জাগানো রক্তচোষাদের কথাই বলছি এখানে। ১৮৯৭ সালে ব্রাম স্টোকার যখন ড্রাকুলা উপন্যাস প্রকাশ করেন, তখন সেটি আধুনিক ভ্যাম্পায়ার মিথের অনেকগুলো ব্যাপার প্রতিষ্ঠিত করে ফেলে। স্টোকারের উপন্যাসের আগেও কিন্তু আরেকজন ভ্যাম্পায়ার নিয়ে লিখেছিলেন। ১৮১৯ সালে John Polidori প্রকাশ করেন তার The Vampyre বইটি। সেটি প্রচণ্ড আলোড়ন সৃষ্টি করে। তবে আমরা খুঁজে দেখব আরো পেছনের কাহিনীগুলো।
প্রায় অন্তত চার হাজার বছর আগে মেসোপটেমিয়াতে ভ্যাম্পায়ার নিয়ে বিশ্বাস প্রচলিত ছিল। তাছাড়া ইহুদি বিশ্বাসে লিলিথ নামে একটি পৌরাণিক চরিত্র রয়েছে। লিলিথ স্বর্গ থেকে রেগে কিংবা বহিষ্কৃত হয়ে পৃথিবীতে চলে আসে এবং অশুভ হয়ে দাঁড়ায়। লিলিথকে বলা হয় সকল অশুভ জীবের মাতা, যত Demons রয়েছে সব কিছু এসেছে লিলিথ থেকে- তারই সন্তান এরা। (লিলিথের কাহিনী পড়বার জন্য এ লিংকে ক্লিক করুন।) ঈশ্বর তখন তিন জন ফেরেশতা প্রেরণ করলেন লিলিথকে ফিরিয়ে আনবার জন্য। কিন্তু লিলিথ ফিরে যেতে অস্বীকৃতি জানালো। ফেরেশতারা জানালো, সে ফিরে না এলে প্রতিদিন লিলিথের ১০০ সন্তানকে হত্যা করা হবে। তখন প্রতিশোধ নিতে লিলিথ ঘোষণা করে যে, সে মানব শিশু হত্যা করতে থাকবে। ইহুদি বিশ্বাসে লিলিথকে অপরূপা সুন্দরী হিসেবে দেখানো হয়। এটাও বলা হয় যে, সুন্দরী নারী সেজে পুরুষের গৃহে রাতের বেলা সে প্রবেশ করে কামলীলা সম্পন্ন করত। পুরুষদের বীর্য সংগ্রহ করাই ছিল তার আসল উদ্দেশ্য; উল্লেখ্য, লিলিথের সাথে মিলন শেষে কোনো পুরুষ বেঁচে থাকত না। লিলিথ তখন সেই পুরুষদের রক্ত পান করত এবং সেই বীর্য ব্যবহার করে নিজে গর্ভবতী হতো, যেন সে আরো অশুভ জীবের জন্ম দিতে পারে।
আদমের দুই পুত্র হাবিল (অ্যাবেল) ও কাবিল (কেইন) এর কাহিনী সকলেরই জানা (না জানা থাকলে রোর বাংলার এ পোস্ট থেকে পড়ে নিতে পারেন)। খুন করবার পর, কেইন পালিয়ে যায়। ঠিক এরকম সময়ে, যখন সে নড উপত্যকায় ছিল, কিংবা লোহিত সাগরের কাছে, তখন লিলিথের সাথে দেখা হয় তার। লিলিথ তাকে শীতার্ত ও ক্ষুধার্ত হিসেবে খুঁজে পায়, সে নিজেকে আদমের প্রথম স্ত্রী হিসেবে পরিচয় দেয়। তারা একত্রে বসবাস করতে শুরু করে এবং পরস্পরের ভালোবাসার মানুষ হয়ে দাঁড়ায়। কেইন বুঝতে পারে যে, লিলিথের চমৎকার জাদুকরি ক্ষমতা আছে, তারও সেগুলো চাই। লিলিথ প্রথমে রাজি হয় না, ইতস্তত করবার পর রাজি হয়ে যায়। একটি ছোরা নিয়ে সে নিজের চামড়া বিদীর্ণ করে একটি পাত্রে রক্ত ঢেলে দেয়। সেই পাত্র কেইনের হাতে দেবার পর তাকে সেটা পান করতে বলে লিলিথ। কেইন সেটা পান করে ফেলে।
ঠিক এই ঘটনার পরই ফেরেশতা তিনজন এসে হাজির হন সেখানে। তারা কেইনকে ভাই হত্যার অপরাধের জন্য প্রায়শ্চিত্ত করে ক্ষমা পাবার সুযোগ দেয়, কিন্তু কেইন মানা করে দেয়। তখন ফেরেশতারা তাকে অভিশাপ দেন, সে আগুন সহ্য করতে পারবে না। এরপর আবারও অনুতপ্ত হবার আহ্বান করেন তারা, এবারও কেইন না বলে; ফেরেশতারা এবার অভিশাপ দিলেন, সূর্যের আলো সহ্য করতে পারবে না সে। এরপরের বারও একই প্রস্তাব দিলে কেইন অস্বীকার করে। এবারের অভিশাপটা ছিল, কেইন কেবল রক্তের স্বাদের দ্বারাই পরিতৃপ্ত হবে এবং এই রক্ততৃষ্ণা তাকে তাড়া করে বেড়াবে।
সময় যেতে যেতে কেইনের ক্ষমতা বাড়তে লাগলো। এক সময় সে লিলিথকে ত্যাগ করে আবার ঘুরতে বেরুলো, সে বেশি দিন থাকতে পারত না এক জায়গায়। দীর্ঘজীবী কেইন পরে উবার নামের যে জনপদে পৌঁছায়, সেখানে বাস করত তারই ভাই সেথ বা শীষ (আ) এর বংশধরেরা। আর সে জনপদের শাসক ছিলেন ইনখ। এখানে কেইনের নাম হয়ে যায় ‘ডার্ক ফাদার’।
ভাইকে হত্যার পর ঈশ্বর কেইনকে অভিশাপ দিয়েছিলেন যে, সে আজীবন পৃথিবীতে ঘুরতে থাকবে, মৃত্যু তাকে রক্ষা করবে না। মৃত্যু থেকে দূরে রাখার জন্য কেইনের শরীরে একটি চিহ্ন দিয়ে দেওয়া হয়, যার নাম মার্ক অফ কেইন। এই চিহ্ন দেখলে লোকে বুঝবে, একে হত্যা করা নিষিদ্ধ। এই চিহ্ন দেখেই লোকে চিনে গিয়েছিল যে, এটাই কেইন। দিনকে দিন তার ক্ষমতা দেখতে দেখতে এক সময় কেইনকে পুজো করা শুরু করল জনপদবাসী। ইনখকে তার সিংহাসন ছেড়ে দিতে হয় কেইনের জন্য।
কথিত আছে, এক সন্ধ্যায় এক তরুণ প্রেমিক-প্রেমিকাকে ভালবাসা করতে দেখে কেইনের মাঝেও ভালোবাসা জেগে ওঠে। সে তাদের ডেকে পাঠায় নিজের কাছে এবং তাদেরকে অমরত্বের ক্ষমতা দেয়, এক কথায় তাদেরকেও ভ্যাম্পায়ার বানিয়ে দেয়। কিন্তু যখন সেই যুগল আবিষ্কার করল যে, ভ্যাম্পায়ার হবার কারণে তাদের আর কোনোদিন বাচ্চা হবে না, তখন তারা এই জীবন আর না রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা প্রখর সূর্যালোকে হেঁটে যায় এবং আত্মহত্যা করে। দুঃখে কেইন সেই যুগলের নাম উচ্চারণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
আগের রাজা ইনখ কেইনের কাছে এই অতিপ্রাকৃত ক্ষমতা চায়, কেইন প্রথমে দিতে অস্বীকার করলেও পরে দিয়ে বসে। ইনখ নতুন ভ্যাম্পায়ার হিসেবে আবির্ভূত হয়। ইনখের নামানুসারে কেইন এই শহরের নাম ঘোষণা করে ‘সিটি অফ ইনখ’। ইনখ তার মতো আরো ভাই চাইলো, যাদের এই ক্ষমতা আছে। কেইন তখন আরো অনেক ভ্যাম্পায়ার তৈরি করে দিল। সিটি অফ ইনখ অনেক উন্নত ছিল বলে উপকথায় বর্ণিত আছে। কিন্তু নুহের মহাপ্লাবন সেই শহর ধ্বংস করে দেয়। কিন্তু গল্পে এটাও বলা হয়েছে কেন ভ্যাম্পায়ার ধ্বংস হয়নি। কারণ, ইনখের কোনো এক বংশধর ছিল নুহের নৌকায়! উল্লেখ্য, ইহুদি ও খ্রিস্টান ধর্মতত্ত্ব অনুযায়ী, এ সকল অশুভ জীবের হাত থেকে পৃথিবী রক্ষার্থেই ঈশ্বর মহাপ্লাবন প্রেরণ করেন। তাছাড়া মানুষ ও ফলেন এঞ্জেলদের মিলনে সৃষ্ট নেফিলিম জাতি ধ্বংস করাও ছিল অন্যতম কারণ।
অ্যালবেনিয়াতে স্ত্রীগা, গ্রিসে ভ্রিকলাকাস ও রোমানিয়াতে স্ত্রিগই নামে পরিচিত উপকথার এ রক্তচোষা প্রজাতি। প্রাচীন গ্রিসে বিশ্বাস করা হতো, রাজা বেলাসের মেয়ে লামিয়া ছিল দেবরাজ জিউসের গোপন প্রেমিকা। জিউসের স্ত্রী দেবী হেরা যখন জেনে যায় লামিয়ার কথা, তখন লামিয়ার সকল সন্তানকে সে হত্যা করে ফেলে। প্রতিশোধস্বরূপ লামিয়া ভ্যাম্পায়ার হয়ে যায় এবং রাতের বেলা শিশুদের রক্ত পান করত। তাছাড়া দেবী হেক্যাটির মেয়ে এম্পুসাও ভ্যাম্পায়ার ছিল বলে কথিত আছে।
মধ্যযুগে ইউরোপে ভ্যাম্পায়ার ভীতি এত প্রবল ছিল যে, লাশকে হৃৎপিণ্ড বরাবর ফেঁড়ে দেয়া হতো, কারণ বিশ্বাস করা হতো যে, এতে ভ্যাম্পায়ার হয়ে লাশ ফেরত আসতে পারে না। যেমন তেমন মানুষকে তখন ভ্যাম্পায়ার বলে অভিযুক্ত করা হতো। রোমানিয়ার কাউন্ট ভ্লাদ বা কাউন্ট ড্রাকুলার নিষ্ঠুরতা থেকে ব্রাম স্টোকার তার উপন্যাসে তাকে ভ্যাম্পায়ার (‘নসফেরাতু’ একটি হাঙ্গেরিয়ান-রোমানিয়ান শব্দ) বানিয়ে দেন। তবে এর আগে তাকে ভ্যাম্পায়ার বলা হয়েছে বলে জানা যায় না।
ভ্যাম্পায়ার নিয়ে রচিত হয়েছে হাজারো উপন্যাস, নির্মিত হয়েছে শত শত চলচ্চিত্র। তবে এই আধুনিক যুগে এসে ভ্যাম্পায়ারকে আলো ঝলমলে মডেল নায়ক হিসেবে দেখা গেলেও, চিরাচরিত উপকথায় ভ্যাম্পায়ার যে কতটা ভীতিকর ছিল, সেটা ভুলে গেলে চলবে না।