বাংলায় ঠগী দমনের এক অনন্য নায়ক উইলিয়াম হেনরি স্লিম্যান। তার প্রশাসনিক দায়িত্ব ও কর্তব্যের অসামান্য ভূমিকার জন্য তিনি পরবর্তীতে উপাধি পান স্যার উইলিয়াম হিসেবে। ঠগী দমন করে তিনি এমনই জনপ্রিয় হয়েছিলেন যে, তার নামই হয়ে গিয়েছিল উইলিয়াম ঠগী স্লিম্যান।
মেজর জেনারেল স্যার উইলিয়াম হেনরি স্লিম্যান ১৭৮৮ সালের ৮ আগস্ট কর্নওয়ালে জন্মগ্রহণ করেন। ১৮১৪ সালে তিনি বেঙ্গল আর্মিতে যোগ দেন। এ সময় নেপাল থেকে গোর্খারা এসে দখল নেয় দার্জিলিং। ফলে ব্রিটিশরা দার্জিলিং দখলের জন্য বেঙ্গল আর্মির একটি রেজিমেন্ট পাঠায়, যে দলে ছিলেন স্লিম্যান। ১৮১৪ সালে অ্যাংলো-নেপাল যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে ১৮১৫ সালের সাগাউলি চুক্তির আওতায় নেপালের নিকট থেকে দার্জিলিং দখল করে নেয় ব্রিটিশরা।
অ্যাংলো-নেপাল যুদ্ধ থেকে ফেরার পথে স্লিম্যানের নজরে পড়ে এলাহবাদে ‘ঠগী’ সংক্রান্ত একটি নথি। এই নথিটি পাওয়ার পর থেকেই তার এই বিষয়ের প্রতি বিশেষ আগ্রহ জন্মায়। স্লিম্যানের বিভিন্ন ভাষা শেখার প্রতি দুর্বলতা ছিল। ভারতে পোস্টিং হওয়ার পর থেকে ভারতের জনসাধারণের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে মেশার জন্য হিন্দি, আরবি ও ফার্সি ভাষা অত্যন্ত যত্নের সাথে আয়ত্ত্ব করেন স্লিম্যান। তিনি চোস্ত হিন্দি ভাষায় কথা বলতে পারতেন। সিভিল সার্ভিসে যোগ দেওয়ার পর বিভিন্ন ভাষার ওপর তার এই দক্ষতা খুব কাজে আসে। ১৮২০ সালে স্লিম্যানের প্রশাসনিক কর্মজীবন শুরু হয় এবং পরবর্তী পনের বছর জুড়ে তিনি সামরিক ও ম্যাজিস্টেরিয়াল দায়িত্ব পালনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। প্রশাসনিক দক্ষতার কারণে তিনি ব্রিটিশ সরকারের খুব গুরুত্বপূর্ণ সদস্যে পরিণত হন।
এই সময়টায় ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে, বিশেষ করে বাংলায় ‘ঠগী’ নামের এক খুনি সম্প্রদায়ের কার্যকলাপ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। এদের মতন নিষ্ঠুর আর নিপুণ খুনীর দল পৃথিবীতে শুধু নয়, ইতিহাসেই বিরল। ১৩ থেকে ১৯ শতকে বাংলা সহ উত্তর ভারতে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে এরা। হিসেব অনুসারে, এসব ঠগীরা ১৮৩০ সালেই প্রায় ৩০,০০০ এর মতো নিরীহ মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। তাদের অত্যাচারে পথচারীদের অনাহুত মৃত্যু তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
নেপাল যুদ্ধে (১৮১৪-১৬) যোগদানের চার বছর পর স্লিম্যান সগর এবং নর্মদা অঞ্চলে গর্ভনর জেনারেলের এজেন্টের সহকারি নিযুক্ত হন। ১৮২৫ থেকে ১৮৩৫ সাল পর্যন্ত স্লিম্যান ভারতের মধ্যপ্রদেশের বিভিন্ন জায়গায় ম্যাজিস্ট্রেট ও জেলা অফিসার হিসেবে কাজ শুরু করেন। সেই সময়ে ঠগীদের কীভাবে প্রতিরোধ করা যায় তা নিয়ে ব্রিটিশ সরকার বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ে। গঙ্গার ধারে একটি গণকবর পাওয়া যায়, যেখানে ৫০টি মৃতদেহ কবর দেওয়া হয়েছিল। এছাড়াও বিভিন্ন স্থানে পাওয়া যাচ্ছিল গণকবর। ফলে ব্রিটিশ সরকারের এ বিষয়ে চুপ করে থাকা কিছুতেই সম্ভব হচ্ছিল না।
ঠগীরা এমন বিশেষ শ্রেণীর খুনি সম্প্রদায় ছিল, যাদের উপর ধর্মের প্রভাব ছিল মারাত্মক। আর তাই ধর্মীয় ভাবাবেগে পাছে আঘাত লাগে, সেই আশঙ্কায় সরকার তখন ঠগী দমন করার ব্যাপারে দ্বিধান্বিত ছিল। বিভিন্ন জায়গা থেকে এবং সরকারের উচ্চপদস্থ বিভিন্ন অফিসারদের মুখে ঠগী নিধনের ব্যবস্থার কথা বলা হলেও, সরকারের উপর মহল থেকে কোনোরকম গ্রিন সিগন্যাল পাওয়া যাচ্ছিল না বলে ঠগীদের বিরুদ্ধে বাস্তব সম্মত কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া যাচ্ছিল না। ব্যাপারটা স্লিম্যানকে বেশ অবাকই করেছিল।
অন্য আর পাঁচজন অফিসারের মতো স্লিম্যান উপর মহলের নিদের্শের অপেক্ষায় থাকলেন না। তিনি তার একদল সোর্সের মাধ্যমে গোপনে ঠগীদের বিষয়ে নানা তথ্য সংগ্রহ করতে লাগলেন। বিভিন্ন সোর্স থেকে তথ্য জোগাড় করতে করতে তিনি হঠাৎ ঠগীদের নিজেদের মাঝে ব্যবহৃত গুপ্ত সাংকেতিক ভাষাটির অর্থ আবিস্কার করে ফেলেন।
ঠগীরা যে ভাষায় কথা বলতো তার নাম ছিল ‘রামাসি’। একজন গুপ্তচরের সাহায্যে স্লিম্যান এই ভাষাটিও শিখে ফেলেন। এই ভাষার মাধ্যমে ঠগীরা নিজেদের মধ্যে তথ্য আদান প্রদান করতো। যেমন- ‘ঝিরনি’ শব্দে হত্যার প্রস্তুতি আর ‘তামাকু লাও’ শব্দের মাধ্যমে হত্যার আদেশ দেয়া হতো, গোষ্ঠীভুক্ত না হলে এসব সাংকেতিক ভাষার অর্থ বোঝা ছিল প্রায় অসম্ভব। কিন্তু বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ স্লিম্যান এই অসম্ভব কাজটিই সম্ভব করে তুললেন এবং ভাষাটি রপ্ত করে নিলেন।
১৮২৬ সালে গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক ভারতের এক বিস্তীর্ণ এলাকায় শ্বাসরুদ্ধকারী ঠগীদের নির্মূল করার দায়িত্ব পেলেন স্লিম্যান। তিন বছর পরে নিজের জেলা প্রশাসনের দায়িত্ব চালানো ছাড়াও স্লিম্যান অপরাধ দমন বিভাগের ভারপ্রাপ্ত অফিসের সহকারি হিসেবে কাজ করার দায়িত্ব পান। প্রথমদিকে স্লিম্যান তার কাজে খুব একটা সাফল্য পাননি। তিনি নিজেও জানতেন যে, ঠগীদের দমন করা খুব একটা সহজ কাজ হবে না। কেননা, অন্যান্য দুষ্কৃতকারীদের থেকে ঠগীদের কোনোভাবেই আলাদা করা যাচ্ছিল না। সুকৌশলে অপরাধ ঢেকে রাখছিল তারা। একদিকে ধনী জমিদার ছিল ঠগীদের পৃষ্ঠপোষক, অন্যদিকে বিভিন্ন জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসাররা তার হস্তক্ষেপে ক্ষিপ্ত হওয়া এবং তাকে সহযোগিতা না করার দরুণ ঠগী দমনে কোনো সাফল্য আসছিল না। তাছাড়া জেলার সমস্ত আদালত তাদের আওতার বাইরের মামলাগুলো চালাতে নানা সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছিল। ফলে ঠগীদের সাথে জড়িত লোকরা শাস্তি এড়িয়ে চলতে লাগলো। ধীরে ধীরে স্লিম্যান সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে লাগলেন।
১৮৩২ সাল নাগাদ স্লিম্যান প্রায় সব বাধা কাটিয়ে উঠলেন। তার সমস্ত অফিসারকে একত্র করে তৈরি করলেন ঠগী দমনে একটি ‘অ্যাকশন প্ল্যান’, গঠন করা হলো বিশেষ ট্রাইব্যুনাল ও দ্রুত বিচার আদালত। তিনি সমস্ত অফিসারকে ঠগীদের গ্যাংগুলি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দিলেন এবং ওসব চক্র কোথায় কোথায় সক্রিয়, সে খবরও তার গুপ্তচরের বরাত দিয়ে প্রতিনিয়ত সরবরাহ করতে লাগলেন। সাথে সাথে ঠগীদের অপরাধস্থল বিশ্লেষণ করে তৈরি করলেন মানচিত্র এবং অপরাধের দিনক্ষণের একটি তালিকা, যাতে পরবর্তী হত্যার সময়কাল আঁচ করা যায়। গুপ্তচরদের সাহায্যে আসতে লাগলো আরো বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ খবরাখবর।
স্লিম্যান তার সাহসী অফিসার ও নিজের লোকদের ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশে অস্ত্রসহ পাঠান। ঠগী গোষ্ঠীগুলিকে অবিরাম অনুসরণের ফলে ১৮৩০ থেকে ১৮৪১ সালের মধ্যে ৩,৭০০ ঠগী ধরা পড়ে। ঠগীদের জিজ্ঞাসাবাদের ফলে উঠে আসে তাদের দ্বারা সংগঠিত গণহত্যার নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য। গ্রেফতার হওয়া সেসব ঠগীদের মধ্য থেকে ৫০০ জনের মতো ঠগীর ফাঁসি হয়, বাকিদের দ্বীপান্তর অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। আর এভাবে একের পর এক শাস্তি দিয়ে বহু ঠগী নির্মূল করা হয়।
পরবর্তীতে ঠগী দমনের জন্য গড়া হলো বিশেষ দফতর। স্লিম্যান হলেন তার প্রথম সুপারিনটেনডেন্ট। ১৮৩৯ সালে তিনি হলেন ঠগী ও ডাকাত দমনের কমিশনার। স্লিম্যান ঠগীদের শাস্তি দিয়েই ক্ষান্ত হননি। তিনি তাদের পুনর্বাসনেরও চেষ্টা করতেন। তিনি চাইতেন, নতুন করে আর কোনো ঠগী যেন ভারতবর্ষে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে। তার এই ইচ্ছেকে সম্মান দেখিয়েছিল প্রাণে বেঁচে যাওয়া ঠগীরা। লাহোর থেকে কর্ণাটক পর্যন্ত প্রায় গোটা ভারতবর্ষই ছিল তার নিয়ন্ত্রণে। তিন বছর পরে তিনি বুন্দেলখনদে গর্ভনর জেনারেলের এজেন্ট নিযুক্ত হন। সেখানেও তিনি ডাকাতদের দমন করেন। চাকরি থেকে অবসর নেয়ার আগে স্লিম্যান ঠগীদের সাম্রাজ্য চিরতরে নির্মূল করেন।
ভারতে প্রশাসনিক কাজের অভিজ্ঞতা নিয়ে ‘র্যামব্লস অ্যান্ড- রিকালেকশনস অফ অ্যান ইন্ডিয়ান অফিসিয়াল’ (১৮৪৪) এবং ‘আ জার্নি থ্রু দ্য কিংডম অব অয়ুধ ইন এইটিন ফর্টিনাইন-ফিফটি’ নামে স্লিম্যান দুটি বই লেখেন। দ্বিতীয় বইটি প্রকাশিত হয় তার মৃত্যুর পর, ১৮৫৮ সালে। ‘র্যামব্লস অ্যান্ড- রিফ্লেকশন্স অফ অ্যান ইন্ডিয়ান অফিসিয়াল’ বইটিতে তিনিই প্রথম ভারতীয়দের ডাইনী বিশ্বাসের গল্পটি বিশদভাবে তুলে ধরেন।
এছাড়াও ব্রিটিশ প্রশাসক উইলিয়াম হেনরি স্লিম্যানের আরেকটি উল্লেখযোগ্য অবদান হচ্ছে, ভারতের মাটিতে পাওয়া প্রথম ডাইনোসরের ফসিল আবিস্কার। ‘দেশজ’ এই ডাইনোসরের বিজ্ঞানসম্মত নাম হচ্ছে টাইটানোসরাস ইন্ডিকাস ৷ মধ্যপ্রদেশের জব্বলপুরে ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি এই জীবাশ্মটি আবিষ্কার করেন। ১৮৭৮ সালে ব্রিটিশ প্রকৃতিবিদ ও ভূতাত্ত্বিক রিচার্ড লাইডেকার এই জীবাশ্মটি গবেষণা করে দেখেন যে, স্লিম্যানের আবিস্কৃত ফসিলটি ছিল সম্পূর্ণ নতুন প্রজাতির চারপেয়ে তৃণভোজী (সরোপড) ডাইনোসরের। লন্ডনের ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামে সেটির একটি নকল রাখারও ব্যবস্থা হয়। এভাবে প্রশাসক থেকে প্রকৃতির রহস্যভেদেও স্লিম্যানের অনবদ্য ভূমিকার কথা জানতে পারা যায়।
১৮৪৩ থেকে ১৮৪৯ সালে গোয়ালিওর এবং ১৮৪৯ থেকে ১৮৫৬ সাল পর্যন্ত স্লিম্যান ব্রিটিশরাজের রাজনৈতিক আঞ্চলিক প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন। এই সময় তাকে তিনবার হত্যার চেষ্টা করা হয়। এসব চেষ্টা ব্যর্থ হলেও তিনি দুর্বল ও অসুস্থ হয়ে পড়েন। ভগ্নস্বাস্থ্য নিয়ে স্লিম্যান মুসৌরিতে যান ১৮৫৪ সালে, স্বাস্থ্য উদ্ধারের আশায়।
১৮৫৬ সালে জানুয়ারিতে তিনি ইংল্যান্ড রওনা হন। স্বদেশে পৌঁছানোর আগেই সমুদ্রপথে তিনি মারা যান। সিলন সমুদ্রের তীরে তাকে সমাহিত করা হয়। তার মৃত্যুর ছয়দিন পর তাকে অর্ডার অব দ্য বাথ পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। ভারত সরকার তার সম্মানে মধ্যপ্রদেশের একটি গ্রামকে স্লিম্যানবাদ হিসেবে নামকরণ করে।
ঠগীদের সম্বন্ধে বিস্তারিত জানতে চাইলে দেখতে পারেন শ্রীপান্থের লেখা ‘ঠগী‘ বইটি।