আধুনিক বিজ্ঞাপনের জগতে পোস্টারের অবদান এক বিশাল জায়গা জুড়ে বিস্তৃত। বিজ্ঞাপনের প্রাচীনতম মাধ্যমগুলোর মাঝে একটি প্রধান মাধ্যমই ছিল পোস্টার। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে দৃশ্যমান যোগাযোগের এক অনন্য মাধ্যম হিসেবে সূচনা ঘটে এই পোস্টার শিল্পকর্মের। বিজ্ঞাপনের দুনিয়াতে ‘পোস্টার আর্টের’ বয়স ১৫০ বছরেরও বেশি।
পোস্টার আর্টের অর্থ সহজে বুঝতে পারা যায় বলে সাধারণ মানুষ শুরু থেকেই একে সাদরে গ্রহণ করে নেয়। কিভাবে এই শিল্পটি গড়ে উঠলো? কারাই বা এ শিল্পকে বিকাশমান করে তু্লেছে? তা জানতে হলে আমাদের একটু পিছনের দিকে তাকাতে হবে। ফিরে যেতে হবে ১৮৬০ সালের দিকে। পোস্টারকে শিল্প হিসেবে যিনি প্রথম এই শিল্পটিকে তুলে ধরেছেন তিনি হলেন জুল শেরেট।
‘থ্রি স্টোন লিথোগ্রাফিক প্রসেস’ শেরেটের এক বিরাট আবিষ্কার। লাল, হলুদ আর নীল রঙে তিনটি পাথর রাঙিয়ে তার উপরে কালি মাখিয়ে রামধনুর সাতটি রঙই তৈরি করে ফেলেছিলেন শেরেট। খুব সাবধানে সেই পাথর বসিয়ে ছাপা হতো পোস্টার। এভাবে খুব তাড়াতাড়ি কম সময়ে এবং কম খরচে তৈরি করা হত পোস্টার।
তবে ‘লিথোগ্রাফি’ পদ্ধতিটি শুরু হয়েছিল তারও অনেক আগে। ১৭৯৮ সালে ধাতুর পাত থেকে ছাপার পদ্ধতিটি আবিষ্কার করেন জার্মানির আলোয়েস সেনেফেলার।
সে সময়টাতে শিল্পকলা ও সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দু ছিল প্যারিস। ছবির জগতে চলছে নানা পরিবর্তনের জোয়ার। পাশাপাশি মধ্যবিত্ত সমাজে বাড়ছে ভোগ্যপণ্যের ব্যাপক চাহিদা। ব্যবসায়ীরা নিজেদের উৎপন্ন জিনিসের চাহিদা বাড়াতে সাধারণ মানুষের জন্য বেছে নিলেন সহজ ভাষায় কম খরচের চিত্র-বিচিত্র পোস্টার। কিন্তু তখন কাঠের আর ধাতুর প্লেটের মূল্য ছিল খুব বেশি। আর সেগুলো কয়েকবার মাত্র ব্যবহার করা যেতো।
সেনেফেলার এই সমস্যা নিয়ে শুরু করলেন চিন্তা-ভাবনা। তিনি বললেন, প্রিন্টিং প্লেটগুলি যদি লাইমস্টোনের মতো করা হয়, তাহলে জিনিসটা বার বার ব্যবহার করা যাবে, আর বিজ্ঞাপনদাতার খরচও কমবে।
১৮৩০ সালের মধ্যে লিথোগ্রাফির মাধ্যমে ইংল্যান্ড আর আমেরিকায় প্রচুর পরিমাণে তৈরি হতে থাকলো পোস্টার। প্যারিস, মিলান, বার্লিনের রাস্তাঘাট পোস্টারে ছেয়ে গেলো। তখন পোস্টারের সর্বপ্রথম ক্রেতা ছিল সার্কাসের লোকেরা। তখনকার পোস্টারগুলো খুব একটা উন্নতমানের হতো না। রঙের ব্যবহার কিংবা নকশার উপস্থাপন- কোনো কিছুই থাকতো না সেই পোস্টারগুলোতে।
জুল শেরেটই প্রথম রঙ ও লেখায় এক নতুন ধারার প্রবর্তন করেন। ১৮৬৭ সালের মধ্যে তিনি পোস্টারে ছাপিয়ে ফেললেন প্যারিসের নৈশ জীবনের চিত্র এবং তৈরি করলেন বিখ্যাত অভিনেত্রী সারা বার্লহাটের অনুষ্ঠানের একটি বিজ্ঞাপন। ১৮৭০ সালের মধ্যে ‘পোস্টার মুভমেন্ট’ ছড়াতে শুরু করলো সারা পৃথিবী জুড়ে। ১৮৮৯ সালে শিল্পে নব দিগন্তের সূচনার জন্যে শেরেট পেলেন ফ্রান্সের সর্বোচ্চ সম্মান ‘লিজিঁয় দ্য’নর’।
১৮৯০ সাল, পোস্টার ম্যানিয়ায় ফ্রান্স তখন পুরোপুরি আক্রান্ত। ১৮৯১ সালের দিকে পোস্টারের আরেক নতুন মাত্রা এনে দিলেন বহু সমালোচিত ও আলোচিত অসাধারণ চিত্রকর অঁরি তুলোস লোত্রেক। তিনিই সর্বপ্রথম পোস্টারকে নিয়ে গেলেন যথার্থ শিল্পের পর্যায়ে। তার আঁকা ‘মুঁল্যা রুজ’ পোস্টার শিল্পকলার এক অপূর্ব নিদর্শন।
তার শিল্পকর্মের নিখুঁত শৈলীগত দক্ষতা, শূন্য স্পেস আর সহজ ফর্মের কম্পোজিশন, রেখার ‘কনট্যুর’ আর গাঢ় রঙের ব্যবহারে- লোত্রেককে সমকালীন শিল্পগুরুদের সমকক্ষ হিসেবে অনেকেই বিবেচনা করেন। প্যারিসের মুঁল্যা রুজ নাইট ক্লাবের ক্যান ক্যান নৃত্যরতা এক নর্তকীর ছবি এঁকেছিলেন তিনি। হু হু করে বাড়তে লাগলো পোস্টারের চাহিদা আর পোস্টার কারবারিদের সংখ্যা।
নানা জায়গায় আয়োজন হতে লাগলো পোস্টার প্রদর্শনীর। ইতালিতে তৈরি হতে লাগলো অপেরা ও ফ্যাশন সংক্রান্ত পোস্টার, স্পেনে বুলফাইট উৎসব, হল্যান্ডে সাহিত্য বিষয়ক ও গৃহস্থালির জিনিসপত্র, জার্মানিতে বাণিজ্য মেলা, ব্রিটেন আর আমেরিকায় সাহিত্য পত্রিকা ও সার্কাস বিষয়ক পোস্টার বাজার কেড়ে নিলো।
১৮৯৪ সালে প্রথম পোস্টার প্রদর্শনী হয়েছিল ইতালি ও গ্রেট ব্রিটেনে। ১৮৯৭ সালে জার্মানিতে হয় পরের পোস্টার প্রদর্শনী। ১৮৯৭ সালের শুরুর দিকে রাশিয়াতে হয় আরেকটি পোস্টার প্রদর্শনী। পোস্টার নিয়ে ১৮৯৭ সালে ফ্রান্সের রিম শহরের প্রদর্শনী দর্শকদের ভোটে সেরা ছিল।
বিভিন্ন দেশের পোস্টারের বিশেষত্ব বিভিন্ন ধরণের। যার যার দেশের সামাজিক ঐতিহ্য, সংস্কৃতি তাদের পোস্টারগুলোতে মূলত স্থান পেত। ডাচ পোস্টারে যেন সবসময় একটা সুশৃঙ্খল নিয়মানুবর্তিতার ছাপ দেখা যেত। ইতালির বিশালাকারের পোস্টারে ছিল নাটকীয়তার আভা। তাছাড়া জার্মান পোস্টারেও ছিল মধ্যযুগীয় ভাব, সাথে সোজা সরল আঁকার ধরণ। তারপরেই শুরু হলো ‘আর্ট ন্যুভো মুভমেন্ট’। তখন চিত্রশিল্পে এলো এক নতুন ধারা। সাথে সাথে যোগ হলো প্রতীকী চিহ্নের ব্যবহার। চেকোস্লোভাকিয়ার আলফোঁশ মুশো ছিলেন এই ঘরানার শিল্পী। ১৮৯৪ সালে তিনি সৃষ্টি করলেন ‘আর্ট ন্যুভো’ নকশায় সর্বপ্রথম পোস্টার।
১৯০১ সালে ঘটে গেলো এক অকাল দুর্ঘটনা। লোত্রেকের অকাল মৃত্যুতে পোস্টার শিল্পে নেমে এলো বিশাল শূন্যতা। মুশা এবং শেরেট তার আগেই কিন্তু পোস্টার শিল্প ছেড়ে দিয়ে মন দিলেন ছবি আঁকাতে।
পোস্টার শিল্পের এই শূন্যতা দূর করতে এগিয়ে এলেন এক ইতালিয় ব্যাঙ্গচিত্রী লিয়োনেত্তো কাপ্পিয়েল্লো। মূলত তার হাত ধরেই আজ অবধি চলে এসেছে আধুনিক চিন্তা-ভাবনার পোস্টার অলঙ্করণ।
তিনি ছেঁটে ফেললেন ‘আ র্ট ন্যুভো’র অতিরিক্ত জটিল মনস্তত্ত্ব। তিনি তৈরি করলেন সহজ কৌতুকপূর্ণ ছবি, যা দেখামাত্রই কর্মব্যস্ত জনসাধারণের মগজে জায়গা করে নেবে এবং খুব দ্রুত জয় করে নেবে তাদের মন। ১৯০৩ সালে কাপ্পিয়েল্লোর আঁকা অতি জনপ্রিয় একটি পোস্টার ‘মরিন কিনা’। তেতো, সবুজ রঙের এক ধরণের ক্ষতিকর মদের নাম ‘মরিন কিনা’। কালো রঙের প্রেক্ষাপটে লিয়োনেত্তো এঁকেছিলেন সবুজ রঙের এক প্রতিকৃতি, যেখানে উপরের লেখাগুলি ছিল ব্লক লেটারে।
শুরু হলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। তার পর পরই বদলে গেলো অংকন শিল্পের ধারা। প্রতিষ্ঠিত হলো ‘আর্ট ডেকো’। মূলত ‘ডেকোরেটিভ আর্ট’ থেকেই এসেছ ‘আর্ট ডেকো’ শব্দটি। প্যারিসে বসে লিয়োনেত্তো খোলনলচে বদলে ফেললেন ব্যাঙ্গাত্মক পোস্টারের। তার মডার্ন আর্টের পোস্টারে ঢুকে গেলো চলতি ধারার কিউবিজম, ফিউচারিজম আর এক্সপ্রেশনিজম।
জার্মানিতে ১৯০৫ সালে মডার্ন আর্টের স্টাইলকে বলা হতো ‘প্লাকাত স্টিল’। বার্লিনের শিল্পী লুসিয়েন বার্নহার্ড এটি চালু করেন। তার পোস্টারের সারল্য এবং সহজবোধ্যতার কারণে বার্লিনে আয়োজিত পোস্টার প্রতিযোগিতায় তিনি সেরা নির্বাচিত হয়েছিলেন।
১৯২৩ সালে কিছু অভিনব আর্ট ডেকো পোস্টার তৈরি করে প্যারিসের সে সময়ের এক জনপ্রিয় শিল্পী ক্যাসান্দ্র কুড়িয়ে নিলেন ‘ফাদার অফ মডার্ন অ্যাডভার্টাইজিং’ খেতাব। ‘নরম্যান্ডি’, ‘স্ট্যাটেনডাম’, এবং ‘আটলান্টিক ওশন’ ক্যাসান্দ্রের বিশাল আয়তনের পোস্টারগুলির মধ্যে বিখ্যাত।
তারপর শুরু হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। এরপরেই শেষ হয়ে গেলো লিথোগ্রাফিক পোস্টারের যুগ, এলো ফটো অফসেট প্রিন্টিং। ১৯৫০ সালের মধ্যে একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে গেলো লিথোগ্রাফিক পোস্টার। নবাগত ‘ইন্টারন্যাশনাল টাইপোগ্রাফিক স্টাইল’কে সামনে রেখে আমেরিকা এবং পোল্যান্ডে দারুণভাবে চালু হয়ে গেলো ‘সাররিয়ালিস্টিক’ ধাঁচের পোস্টার।
১৯৬৭ সালে এই আঙ্গিকে বিখ্যাত পপ গায়ক বব ডিলানের অ্যালবাম কভার এঁকে বিখ্যাত হয়ে যান শিল্পী মিলটন গ্লেসার। উলফগ্যাং ওয়েইনগার্ট নামে এক শিক্ষক অফসেট প্রিন্টিং এর উপর নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা করে আনলেন ‘গ্রাফিক স্টাইল’।
সবশেষে একটি মজার তথ্য জানাই। ১৯৬৩ সালে প্যারিসে এক সাহিত্য পত্রিকার অফিসে মেরামতের সময়ে লোত্রেকের আঁকা কতগুলো অসাধারণ ছবি উদ্ধার করা হয়। ১৯৮৯ সালে এক নিলামে উদ্ধারকৃত লোত্রেকের মুঁল্যা রুজ এর তিনটি কপি বিক্রি হয়েছিল ২,২০,০০০ ডলারে। আজ পর্যন্ত কোনো পোস্টারের জন্য পাওয়া সর্বোচ্চ মূল্য এটিই।
ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় অধ্যায় হলো পোস্টার। ইতিহাসের বিভিন্ন সময়কে নিখুঁতভাবে তুলে ধরা পোস্টার আজ পৌঁছে গেছে আধুনিকতার এক চরম উৎকর্ষতায়। কিন্তু এখনো পর্যন্ত এই মাধ্যম সর্বসাধারণের কাছে সবচেয়ে সহজ ও গ্রহণ্যযোগ্য মাধ্যম হিসেবেই ব্যাপকভাবে বিবেচিত হয়ে আসছে। আর সেই কারণেই হয়তো চিত্র সমালোচক জে কে হাইসমানস বলেছিলেন, “পোস্টার হলো ‘জার্নালিজম অফ পেইন্টিং’।”