মালয়েশিয়ার গানের ঐতিহ্য দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক অর্জনের মধ্যে অন্যতম। ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরের সন্ধিস্থলে অবস্থিত এই দেশটি সাংস্কৃতিকভাবে বেশ কয়েকটি ধারার মিলনে গড়ে উঠেছে। স্থানীয় আদিবাসী সংস্কৃতির সাথে এখানে একসময় ভারতবর্ষের বিভিন্ন ঐতিহ্য মিশেছে। পরে মুসলিম সংস্কৃতির আগমনের মাধ্যমে এই সাংস্কৃতিক মিলনের প্রক্রিয়া একেবারে অন্য মাত্রায় গিয়ে পৌঁছেছিল। এই মিলন দেশটির গানের ঐতিহ্যে অনবদ্য অবদান রেখেছে।
মালয়েশিয়ার এক অন্যতম সাঙ্গীতিক ঐতিহ্য হচ্ছে এর স্থানীয় গান ‘দনদাং সায়াং’। মালয়শিয়া ও সিঙ্গাপুর অঞ্চলের মালয় ও পেরানাকান জনগোষ্ঠীর মধ্যে এর উপস্থিতি দেখা যায়। ‘দনদাং সায়াং’ শব্দটি ‘দনদাং’ বা ‘দেনদাং’ শব্দ থেকে এসেছে, যার মূল অর্থ গান গাওয়া। আর ‘সায়াং’ শব্দ দিয়ে বোঝায় প্রেম, বিরহ, কাতরতা ও গভীর অনুরাগের প্রকাশ। ইংরেজিতে তাই ‘দনদাং সায়াং’ এর অনুবাদ করা হয় ‘লাভ ব্যালাড’। এককথায় বলা চলে, এই ঐতিহ্য প্রেম ও বিরহ বিষয়ে রচিত ও অনুষ্ঠিত একরকম গান। বিশ শতকের মধ্যভাগে এর জনপ্রিয়তা কিছুটা কমে গেলেও অনেক অনুরাগী এখনও এই ঐতিহ্যের কদর করে থাকেন।
‘দনদাং সায়াং’ এর ইতিহাস নির্ণয় করা কিছুটা শক্ত। জনপ্রিয় বিশ্বাস অনুযায়ী, বিনতাই দ্বীপের রাজকন্যা ওয়ান বেনাইয়ের হাত ধরে খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতকে এর যাত্রা শুরু হয়। অন্য একটি প্রচলিত মত হলো, চতুর্দশ অথবা পঞ্চদশ শতকে মালাক্কার রাজদরবারে এর যাত্রা শুরু হয়। মালাক্কার সালতানাতের লিখিত ঐতিহাসিক সূত্র ‘হিকায়াত হাং তুয়া’ অনুযায়ী, হাং জিবাত নামক জনৈক রাজকবির হাতে এই গানের উদ্ভব হয়েছে। মালাক্কার রাজদরবারে নাচসহ ‘দনদাং সায়াং’ বেশ উচ্চ সমাদর পেতো। রাজদরবার থেকে এর আবেদন ধীরে ধীরে সাধারণ জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন লৌকিক উৎসবে এই গান গাওয়া হতো। উনিশ শতকে মালাক্কা ব্রিটিশ শাসনের অধীনে আসলে গানের এই ঐতিহ্য সিঙ্গাপুর, পেনাং ও অন্যান্য মালয় জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।
উনিশ শতকের শেষ দিক থেকে ‘দনদাং সায়াং’ ব্যাপক আকারে সাধারণ মানুষের কাছাকাছি আসতে থাকে। সিঙ্গাপুরের মালয় অধ্যুষিত অঞ্চলে প্রায়ই সন্ধ্যা থেকে শুরু হয়ে পরের দিন ভোর পর্যন্ত এটি গাওয়া হতো। মুসলিম সমাজে বিয়ে ও অন্যান্য অনেক পারিবারিক উৎসবে কুরআন পাঠের পর দল বেঁধে গাওয়ার প্রচলন ছিলো। একসময় এই গানে পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাব পড়তে শুরু করে। ফলে এতে নতুন নতুন বাদ্যযন্ত্র যুক্ত হয়েছে। ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষ থেকে তবলা এই গানে যুক্ত হয়েছিলো। এছাড়া ইউরোপীয় সংস্কৃতির প্রভাবও একসময় এর অঙ্গ হিসেবে স্বীকৃত হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, এ গানের সাথে ইতালীয় ও স্প্যানিশ নাচ যুক্ত হয়ে ‘দনদাং সায়াং মাম্বো’ এক অন্য মাত্রার জনপ্রিয় ঐতিহ্য হিসেবে বিশ শতকের মাঝামাঝি ব্যাপক জনপ্রিয় হয়েছিলো।
সত্তরের দশকে এই গানের জনপ্রিয়তা কিছুটা কমে আসে। তবে আশির গানের এই সমৃদ্ধ ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারের একটি প্রচেষ্টা নেওয়া হয়। সিঙ্গাপুরের গণমাধ্যম সংস্থা ‘সিঙ্গাপুর ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন’ ১৯৮২ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত ‘কেলাব দনদাং সায়াং’ নামে একটি টেলিভিশন প্রোগ্রাম সম্প্রচার করতো। এছাড়া ‘সেন্তোসা ডেভলপমেন্ট কর্পোরেশন’ বিভিন্ন কমিউনিটি সেন্টার ও হোটেল রেস্তোরাঁয় ‘দনদাং সায়াং’ এর আয়োজন ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতো।
‘দনদাং সায়াং’ গানের সাধারণ আসরে সাধারণত দুইয়ের অধিক গায়ক-গায়িকা অংশ নিয়ে থাকেন। গানের লিরিক বা গীতিকাব্যের স্টাইল ‘পান্তুন’ নামে পরিচিত। গানের বিষয়বস্তুকে স্থানীয় ভাষায় ‘তাজুক’ বলা হয়। বর্তমানে পাবলিক প্লেসে অনুষ্ঠিত গানের অনুষ্ঠানে সাধারণত পুরুষ ও নারী কণ্ঠে ডুয়েট হয়ে থাকে। বিভিন্ন বিষয়ের উপর গান হতে পারে। তবে সবচেয়ে জনপ্রিয় হলো ‘পুণ্যের কাজ’ বা ‘বুদি’, ‘প্রেম’ বা ‘কাসিহ’, ‘ফল’ বা ‘বুয়াহ বুয়াহান’, ‘ফুল’ বা ‘বুঙ্গা’ এবং ‘সাগর’ বা ‘লাউতান’।
গানের লিরিক হিসেবে ‘পান্তুন’ চার লাইনে গঠিত। প্রতিটি লাইন আবার চারটি শব্দে গঠিত। প্রথম দুই লাইনে একটি নির্দিষ্ট ঘটনার কাব্যিক বর্ণনার মাধ্যমে দর্শকের উৎসুক দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। এতে অনেক সময় লুকানো বার্তাও দেওয়া হয়ে থাকে। তৃতীয় লাইনে সেই বার্তা বা মেসেজ উন্মোচিত হয়। চতুর্থ লাইনে থাকে গানের মাধ্যমে প্রদান করা আকস্মিকতা। গানে পুনরাবৃত্তি এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
গানে গানে কথোপকথন ‘দনদাং সায়াং’ এর চমৎকার ও আকর্ষণীয় একটি দিক। গায়ক-গায়িকারা সাধারণত প্রায় একশোর অধিক ‘পান্তুন’ মুখস্থ করে থাকে। তবে ভালো পারফর্মের জন্য শুধু মুখস্থ করা ‘পান্তুন’ যথেষ্ট নয়। অনেক সময় উপস্থিত বুদ্ধি পারফর্মেন্সের জন্য বেশি সহায়ক হয়। সেক্ষেত্রে মালয় সংস্কৃতির জ্ঞান, ভাষার গতিবিধি ও অভিজ্ঞতা গায়ক-গায়িকার উপস্থিতি সার্থক করতে অনেকাংশে বেশি সহায়তা করে থাকে।
‘দনদাং সায়াং’ এর গানের দল ছোট ব্যান্ডের মতো হয়ে থাকে। বাদ্যযন্ত্র হিসেবে এতে বেহালা, ‘রেবানা’ নামের একধরণের হ্যান্ড ড্রাম ও গং বাজানো হয়। বর্তমানে এসব ঐতিহ্যবাহী বাদ্যযন্ত্রকে মূল হিসেবে ধরে সহায়ক হিসেবে গিটার, ড্রামস, অ্যাকর্ডিয়ান, ট্যাম্বোরিন ও বাঁশির ব্যবহার হয়।
বর্তমানে সিঙ্গাপুরে ‘দনদাং সায়াং’ এর বেশ ভালো প্রচলন আছে। উনিশ শতক থেকে সিঙ্গাপুরের স্থানীয় মালয় জনগোষ্ঠী এটি চর্চা করে আসছে। জনপ্রিয় মালয় অপেরা ‘বাংসাওয়ান’ এ দৃশ্য পরিবর্তনের সময় এই ঐতিহ্যবাহী গানের বহুল ব্যবহার হয়। ১৯৮০ সাল থেকে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনেক উৎসবে এই গানের প্রচলন বৃদ্ধি পেয়েছে। সিঙ্গাপুরের মালয় জনগোষ্ঠীর আর্ট ফেস্টিভাল ‘পেস্তা রায়া’ ও মালয় ভাষা ও সাংস্কৃতিক মাস ‘বুলান বাহাসা’ উৎসবে ‘দনদাং সায়াং’ অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।
মালয়শিয়া ও সিঙ্গাপুরের চীনা সমাজের মধ্যে ‘পেরানাকান’ জনগোষ্ঠী অন্যতম। এই জনগোষ্ঠীর মধ্যেও ‘দনদাং সায়াং’ প্রচলিত আছে। মালয় ও পেরানকান জনগোষ্ঠীর গানের মধ্যকার মূল পার্থক্য হচ্ছে গানের ভাষায়। পেরানকান সমাজ মালয় জনগোষ্ঠীর ভাষার বদলে তাদের নিজেদের ‘বাবা মালয়’ ঐতিহ্য অনুসরণ করে থাকে। চীনা এই সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর ধর্ম, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও অভিজ্ঞতার ভিন্নতার কারণে তাদের গানের ঐতিহ্যও মালয় সমাজের চেয়ে ভিন্ন। সেজন্য তারা একই ধাঁচের গান ভিন্ন আঙ্গিকে পরিবেশন করে থাকে।
চীনা জনগোষ্ঠী উনিশ শতক থেকে তাদের নিজস্ব স্টাইলে ‘দনদাং সায়াং’ গানের অনুষ্ঠান করে আসছে। ১৯৬০ সাল অবধি এটি মূলত চীনাদের যে কোন ঘরোয়া উৎসবে অনুষ্ঠিত হতো। স্থানীয় চীনাদের একটি অন্যতম উৎসব হচ্ছে ‘চাপগোহ মেহ’। এটি চীনাদের লুনার ক্যালেন্ডার অনুযায়ী নববর্ষের পনেরতম দিন। এ উৎসবে বেশ জাঁকজমকের সাথে ‘দনদাং সায়াং’ এর আয়োজন করা হয়ে থাকে। এছাড়া বিয়ে, জন্মদিন ও অন্যান্য নানা উৎসবে এটি গাওয়া হয়। অনেক সময় চীনাদের নিজস্ব ঐতিহ্য ‘রংগেং’ এর সাথে ‘দনদাং সায়াং’ একসাথে পারফর্ম করা হয়ে থাকে। এই মিলিত উৎসবে নাচ, অভিনয় ও অন্যান্য মিশ্র সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান প্রদর্শিত হয়।
অনেক ‘পেরানকান’ চীনা পরিবার রবিবার ছুটির দিনে ‘দনদাং সায়াং’ এর ঘরোয়া আয়োজন করে থাকে। এ ধরনের অনুষ্ঠানে ৮-৯ জন একটি টেবিলের চারপাশে বসে গান করে থাকেন। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে একজন গানের তালে তালে প্রথম এক লাইন গেয়ে শোনান। তার ঠিক পরের জন সুরে সুরে তার উত্তর দেন। কোন গায়ক তা না পারলে তার পরেরজন একই চেষ্টা করেন। এক্ষেত্রে এই গান শুধু চিত্তবিনোদন হিসেবে থাকে না, রীতিমত কুইজ প্রতিযোগিতা বা ‘অন্তাক্ষরী’র মতো অনুষ্ঠানে রূপ নেয়।
মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরের এই অসাধারণ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ২০১৮ সালে ইউনেস্কো কর্তৃক ‘ইন্ট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ অব হিউম্যানিটি’ খেতাবে ভূষিত হয়। ‘দনদাং সায়াং’ এক অনন্য সাঙ্গীতিক ঐতিহ্য হিসেবে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের সমঝদার মানুষের সমাদর পেয়ে থাকে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাধারণ মানুষের অন্যতম সাংস্কৃতিক অর্জন হিসেবে এটি যে শুধু অসাধারণ তা-ই নয়, রীতিমত বিশেষ ঐতিহাসিক গুরুত্বেরও দাবি রাখে। পৃথিবীর অজস্র সংস্কৃতিবান মানুষ মালয়শিয়া ও সিঙ্গাপুরের গানের এই ঐতিহ্যেকে শ্রদ্ধার চোখে দেখেন।