অজানা, অজেয় রহস্যের প্রতি মানুষের আগ্রহ সেই প্রাচীনকাল থেকেই অস্তিত্বশীল। প্রতিটি অজেয়ই অত্যন্ত দুর্ভেদ্য এবং ভয়ানক, কেননা সেখানে জীবন সর্বদাই থাকে সঙ্কটপূর্ণ। তবুও মানুষ সর্বদাই অজেয়কে জয়ের নেশায় মত্ত হয়েছে। লক্ষ্যভেদের পূর্বের অভিযান যতটা দুর্গম, যতটা দুঃসাহসিক; অর্জনটাও ঠিক ততটাই আস্বাদনীয় এবং রোমাঞ্চকর।
সম্প্রতি বিখ্যাত ‘মেন’স জার্নাল’ বিভিন্ন পরিসংখ্যান ও তথ্য-উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে বিগত ২৫ বছরের বিশ্বের সেরা ২৫ জন দুঃসাহসিক নারীর একটি তালিকা প্রকাশ করেছে, যার মধ্যে রয়েছেন বাংলাদেশী পর্বতারোহী ওয়াসফিয়া নাজরীন। পর্বতারোহী ছাড়াও এখানে রয়েছে মেরু অভিযাত্রী, ক্লাইম্বার, সিনেমা পরিচালকসহ আরও অনেকে; যারা মনুষ্যোচিত সীমাবদ্ধতাকে ভেঙ্গে চুরমার করে তা আবার নতুন করে সংজ্ঞায়িত করেছেন। এখানে সেরা পঁচিশ থেকে প্রথম দশ জন নারীর কথা সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো।
১০. স্টেপ ডেভিস
পৃথিবীতে খুব কম সংখ্যক মানুষই আছেন; যারা অগ্রণী ক্রীড়াবিদ স্টেপ ডেভিসের চেয়েও বেশি অভিযাত্রিক ক্ষেত্র আয়ত্ত করেছেন। তিনি একাধারে ক্লাইম্বিং, ফ্রি-সোলোইং (দড়ি বা রশি ছাড়া ক্লাইম্বিং), স্কাই ডাইভিং, বেস জাম্পিং, উইংস্যুইট ফ্লাইং এ বিশেষ পারদর্শী বা এক কথায় বলা যায় এসবের বিশেষজ্ঞ।
বাউণ্ডুলে স্বভাবের ডেভিস ক্লাইম্বিং শুরু করেন ১৯৯১ সালে এবং তা অভ্যাসে পরিণত করার জন্য পরিহার করেছেন বিভিন্ন ধরনের যানবাহন। প্রথম নারী হিসেবে ২০০৫ সালে সালাথ ওয়াল রুটে এল-ক্যাপিটান আরোহণ করেন এই ক্লাইম্বার। এছাড়া পাকিস্তান, কিরগিজস্তান, বাফিন দ্বীপ, আর্জেন্টিনা, ইতালিসহ বিভিন্ন দুর্গম আন্তর্জাতিক রুটে অভিযান চালিয়েছেন তিনি।
২০০৭ সালে তিনি স্কাই ডাইভিং, বেস জাম্পিং, উইংস্যুইট ফ্লাইং শুরু করেন এবং বর্তমানে বছরে ২০০ থেকে ৩০০ বার জাম্প করে থাকেন। উইংস্যুইট ফ্লাইং করতে যেয়ে একবার মৃত্যুমুখেও পতিত হয়েছিলেন ডেভিস। তবে সেবার জানে বেঁচে গেলেও ২০১৩ এবং ১৫ সালে তার সাথে উইংস্যুইট ফ্লাইং করতে গিয়ে প্রাণ হারায় তার সাবেক দুই পতি। এ ব্যাপারে তিনি বলেন, “অভিযানের ক্ষেত্রে কখনো ভাগ্য সহায়ক হয় আবার কখনো হয় না”। ক্লাইম্বিং নিয়ে তার বর্তমান অবস্থান নিয়ে এখনো পর্যন্ত তিনি বেশ খুশি এবং স্বাচ্ছন্দ্যের সাথেই প্রতিনিয়ত জাম্প করে যাচ্ছেন ৪৩ বছর বয়সী এই নারী।
৯. সিলভিয়া আর্ল
১৯৭৯ সাল, পানির নিচে থাকা সাবমেরিন থেকে বের হয়ে আসলেন একজন নারী; ওয়াহুর সমুদ্র উপকূল থেকে প্রায় ১২৫০ ফিট গভীরে সমুদ্র তলদেশ দিয়ে হেঁটে গেলেন কিছুক্ষণ এবং স্থাপন করলেন একজন নারীর সর্বোচ্চ গভীরতার রেকর্ড। বলছিলাম সমুদ্রবিজ্ঞানী সিলভিয়া আর্লের কথা যিনি ৭০০০ ঘণ্টারও বেশি সময় কাটিয়েছেন সমুদ্রের তলদেশে এবং সম্পন্ন করেছেন ১০০’র বেশি অভিযাত্রা। এছাড়া সোলো ডাইভের ক্ষেত্রেও নারীদের হয়ে সর্বোচ্চ গভীরতার রেকর্ড করেছেন এই গবেষক।
বর্তমান বয়স ৮১ হলে একটুও বৃদ্ধ হননি তিনি। তাই এখনো বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে ঘুরে মানুষকে সমুদ্র ও তার জীব-বৈচিত্র্য রক্ষায় উদ্বুদ্ধ করে যাচ্ছেন এই সমুদ্রপ্রেমী। জীবনে বহু অভিযান করায় তার প্রিয় স্থান কোনটি প্রশ্ন করলে তারুণ্যজ্জল ভঙ্গিমায় তিনি উত্তর দেন, “the next place, wherever it is.” (পরবর্তী স্থান, সেটি যেখানেই হোক)
৮. ক্যাথারিন বিগেলো
ক্যাথারিন বিগেলো একজন আমেরিকান চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক, এবং লেখক যিনি স্রোতের বিপরীতে গিয়ে তৈরি করেছেন দুঃসাহসিক কিছু সিনেমা যা দর্শকদের ভাবাতে বাধ্য করেছে। তিনি কাজ করেছেন যুদ্ধ, বৃক্করস-ক্রীড়া জাতীয় ভিন্ন ধারার চলচ্চিত্র নিয়ে।
বিগেলো প্রথমে চিত্রশিল্পী হিসেবে কাজ শুরু করলেও পরে স্থানান্তরিত হয়ে চলে আসেন পরিচালনায়। বেশ কয়েকটি সিনেমা নির্মাণের পর ‘পয়েন্ট ব্রেক’ নির্মাণ করেন এই আমেরিকান, যার মাধ্যমে ক্রীড়া ও একশন মিলিয়ে সিনেমা জগতে নতুন এক ধারার প্রবর্তন ঘটে। এরপর ২০০৮ সালে ‘দ্যা হার্ট লকার’ নামে যুদ্ধ ভিত্তিক এক ভিন্ন ধারার সিনেমা নির্মাণ করেন ক্যাথরিন; যা তাকে নিয়ে যায় অনন্য এক উচ্চতায়। তার দুঃসাহসিকতার পরিমাণ বুঝতে হলে গভীর মনোযোগ সহকারে দেখতে হবে তার সিনেমাগুলো।
৭. সিলেন কাস্টেও
মাত্র নয় বছর বয়সে দাদা-দাদির সাথে ভ্রমণ করেছিলেন অ্যামাজন জঙ্গল। ব্যাস! সেখান থেকেই মাথায় ঢুকে গেল এই জঙ্গল যা আর কখনো মাথা থেকে বের করতে পারেন নি। অ্যামাজনের অ্যানাকন্ডা ও কুম্ভীরের সাথে সাঁতার, এন্টার্কটিকায় ডাইভিং, অ্যামাজনে ভ্রমণসহ নানা বিপদসংকুল অভিযান চালিয়েছেন সিলেন।
২০০৭ সালে ব্রাজিলের এক আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জীবন-যাত্রার মান ও তাদের সমস্যাগুলো নিয়ে “Tribes on the Edge” সিনেমা নির্মাণ করেন যেখানে সমগ্র মানব জাতির সাথে জীব-বৈচিত্র্যের সম্পর্কের চিত্র তুলে ধরেন এই নির্মাতা। এছাড়া ডিসকভারি, পিবিএস-সহ আরও বিভিন্ন সাইটের জন্য অসংখ্য ডকুমেন্টারি বানিয়েছেন ৪৪ বছর বয়সী এই অভিযাত্রী।
৬. জেনিফার ডেভিস
গড়ে একদিনে ৪৭ মাইল বা ৭৬ কিলোমিটার! প্রায় ঝড়ের বেগে ৪৬ দিন ১১ ঘণ্টা ২০ মিনিটে ২১৮১ মাইল দীর্ঘ অ্যাপালেচিয়ান ট্রেইল পাড়ি দিয়েছেন জেনিফার। প্রায় ৪০ যা দখল ছিল পুরুষের তা ভেঙ্গে করে নিলেন নিজের নামে। এর জন্য অবশ্য দিনে প্রায় ১৬ ঘণ্টা হাঁটতে হয়েছে এই হাইকারকে।
৬টি মহাদেশ মিলিয়ে প্রায় ১৩০০০ হাজার মাইলেরও বেশি পথ পাড়ি দিয়েছেন জেনিফার। এবং যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি প্রদেশের সবক’টিতেই হাইকিং করেছেন আমেরিকান হাইকিং সোসাইটি’র এই দূত। হাইকিং এর পাশাপাশি লেখালেখির প্রতিও বেশ ঝোঁক আছে তার, এবং এরই মধ্যে ৬টি বই প্রকাশিত হয়েছে ৩৩ বছর বয়সী এই নারীর।
৪. পাসং লামু শেরপা আকিতা
খুব ছোটবেলায় মাউন্ট এভারেস্টে চড়ার স্বপ্ন দেখতেন আকিতা, যদিও তাকে বলা হয়েছিল এটা মেয়েদের কাজ না। তিনি হাল ছাড়েন নি। এবং এক সময় ঠিকই তা জয় করেছেন। এর পাশাপাশি হয়েছেন নেপালের প্রথম নারী পর্বতারোহী গাইড।
২০১৫ সালে ভূমিকম্পে নেপালে ক্ষতিগ্রস্থ পাহাড়ি পরিবারকে সাহায্য করেছেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। বাঁচিয়েছেন হাজারো প্রাণ। তার সাহসী এ উদ্যোগের পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমানে নেপালের একজন রোল মডেল হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছেন এই পর্বতারোহী।
৩. অ্যানা ফ্রস্ট
সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রায় সকল দৌড় প্রতিযোগিতায়ই প্রথম হয়েছেন ফ্রস্ট। এর মধ্যে হার্ড রক ১০০ অন্যতম, যেখানে নারীদের মধ্যে প্রথম এবং সব মিলিয়ে অষ্টম হয়েছেন এই দৌড়বিদ। অর্থাৎ অনেক পুরুষ দৌড়বিদদেরও পেছনে ফেলে এসেছেন তিনি। এ দৌড়ে প্রায় ৬১০০০ ফিট উচু টিলাও পাড়ি দিতে হয়েছে তাকে।
অন্নপূর্ণা আর এভারেস্ট অঞ্চলে এভারেস্ট স্কাই রেসে দৌড়ানর সময় প্রায় ১৭৩০০ মিটার টিলা পাড়ি দেন অ্যানা। এর জন্যেও দিনে প্রায় ৬-১২ ঘণ্টা হাঁটতে বা হাইকিং করতে এবং দৌঁড়াতে হয়েছে এই নিউজিল্যান্ডিস দৌড়বিদকে।
২. ক্রিস্টিন ম্যাকডীবট তোম্পকিন্স
প্রায় দুই দশক ধরে চিলি এবং আর্জেন্টিনায় প্রায় ৩.৪ মিলিয়ন একর আদি ভূমি সংরক্ষণে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন তোম্পকিন্স ও তার স্বামী। উদ্দেশ্য হচ্ছে একটি সিরিজ ন্যাশনাল পার্ক বানানো যাতে করে বন্যপ্রাণ এবং প্রকৃতি লাগসই ভাবে সংরক্ষিত ও সুরক্ষিত থাকে। চিলিয়ান সরকারকে প্রায় ১ মিলিয়ন একর ভূমি অনুদান করার পর বর্তমানে তার স্বপ্ন সত্যি হবার পথেই হাঁটছে।
স্বামীকে সাথে নিয়ে ক্রিস্টিন চড়েছেন হিমালয়ের শিখরে, পাড়ি দিয়েছেন অনেক বিচ্ছিন্ন, অনাসন্ন নদী। এমনকি ক্লাইম্বিং এর জন্য সিয়েরাতে তৈরি করেছেন নতুন রুট। ২০১৫ সালে স্বামী ডউগ মৃত্যুবরণ করায় কিছুটা ভেঙ্গে পড়লেও হাল ছাড়েননি প্যাটাগোনিয়ার এই সাবেক নির্বাহী।
১. সারাহ ম্যাকন্যায়ার-ল্যান্ডরি
মাত্র ১৮ বছর বয়সে সারাহ অনেকটা জোর করেই পাড়ি দেন দক্ষিণ মেরু। এবং তার পরের বছর অর্থাৎ ১৯ বছর বয়সেই স্লেজগাড়ি ভ্রমণ করে জয় করেন উত্তর মেরু; করেন সবচেয়ে কম বয়সে দুই মেরু জয়ের রেকর্ড।
এছাড়াও সারাহ পাঁচ বার পাড়ি দিয়েছেন গ্রিনল্যান্ড আইস শীট, স্লেজগাড়িতে করে অতিক্রম করেছেন এলেসমেয়ার দ্বীপ এবং উটের পিথে চড়ে পাড় হয়েছেন সাহারা। মাত্র ৩০ বছর বয়সে এত দুঃসাহসিক অভিযান পরিচালনা করে তিনি আছেন মেন’স জার্নালের দুঃসাহসিক নারীর তালিকার শীর্ষে।
৫. ওয়াসফিয়া নাজরীন
বাংলাদেশ তথা সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ায় নারীদের অবস্থান সম্পর্কে আমরা সবাই অবগত। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই নারীদের সম্মুখীন হতে হয় বিভিন্ন বাধা-বিপত্তির। ঘরের বাইরে বের হলেই শুনতে হয় নানান মন্তব্য। জীবনে নারীরা কী কী করতে পারবে না সেটা শুনতে শুনতেই পার হয়ে যায়। তাই কী কী করা যাবে সেটা অধিকাংশ সময়ই জানা হয় না। এখানকার নারীরা নিজের স্বপ্ন পূরণে নয় বরং অন্যের স্বপ্ন পূরণেই নিজের জীবন বলি দিয়ে যায়। তবে এসব কিছু গায়ে মাখেন নি ওয়াসফিয়া। কারণ তিনি জানতেন এসব গায়ে মাখলে আর দশটা মেয়ের মতো তাকেও এমন জীবনই কাটাতে হবে। তাই নিজেকে গড়ে তুলেছেন নিজের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়েই। নিজের স্বপ্ন পূরণ করেছেন নিজ সামর্থ্য গুণে।
ওয়াসফিয়া বাংলাদেশের সর্বকনিষ্ঠ পর্বতারোহী হিসেবে ২০১২ সালে এভারেস্টের সর্বোচ্চ চূড়ায় আরোহণ করেন। পরবর্তীতে তিনি প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে সপ্তশৃঙ্গ (সেভেন সামিট) জয় করেন। ২০১৪-১৫ সালে ন্যাশনাল জিওগ্রাফির বর্ষসেরা অভিযাত্রীদের মধ্যে ওয়াসফিয়া অন্যতম। এবং ২০১৬ সালে তিনি ন্যাশনাল জিওগ্রাফির সেরা উদীয়মান অভিযাত্রীর তকমা জয় করেন; যার মাধ্যমে প্রথম নারী হিসেবে জিওগ্রাফির এই দুটি খেতাব জয় করতে সক্ষম হন তিনি। এ সকল অর্জনের মাধ্যমে বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে আরও একটু উচ্চতর স্থানে প্রতিষ্ঠিত করেছেন ৩৪ বছর বয়সী এই বাংলাদেশী নারী। মেন’স জার্নালের জরিপে বিগত ২৫ বছরের সেরা ২৫ দুঃসাহসিক নারীর তালিকার পাঁচ নম্বরে জায়গা করে নিয়েছেন এই বাঙালি।