২৬ অক্টোবর, ২০১৫; ইউনিভার্সিটি অফ ওয়াশিংটনের একজন জীববিজ্ঞানী এসে নামলেন সিঙ্গাপুর এয়ারপোর্টে। লোকটির বয়স আনুমানিক ৬৩, বয়সের তুলনায় চুলগুলো তেমন একটা পাকে নি, তবে দাড়িগুলোতে কালোর চেয়ে সাদা রঙের আধিক্যই চোখে পড়বে। চোখের নিচে বড় কালো দাগগুলো দেখে যে কেউই বুঝতে পারবে লোকটি কাজপাগল, তাই রাতেও ঠিকমতো ঘুমোনোর সময় পান না। এয়ারপোর্টে নেমেই লোকটি তাড়াতাড়ি বের হলেন সেখান থেকে, একটি ট্যাক্সি ভাড়া করে সোজা চলে গেলেন হার্ডওয়্যারের দোকানে। সেখান থেকে দুটো বৃত্তাকার করাত, কয়েকটি এফ ক্ল্যাম্প ও একটি ছোট ঠেলাগাড়ি কিনে তিনি আবারো ছুটলেন। এবার উদ্দেশ্য সেখানকার একটি বন্দর, আরো ভালো করে বলতে গেলে সেই বন্দরে থাকা পুরাতন একটি পক্ষীশালা। কিন্তু কেন?
বেশ কিছুদিন আগেই বন্দরের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কেনিয়ার মোম্বাসা থেকে আসা ৮০টি চায়ের বস্তার একটি চালান আটক করেছে। চায়ের বস্তায় যদি চা থাকতো, তাহলে তো আর কোনো আপত্তি ছিলো না। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেখানে জনপ্রিয় এ পানীয় তৈরির কাচামালটি ছিলো না, বরং ছিলো হাতির দাঁত! ৮০টি চায়ের বস্তার ভেতর সাজানো ছিলো ১,৭০০টি হাতির দাঁত, যেগুলোর মোট ভর আনুমানিক ৫ টন।
ভ্রমণক্লান্তি বৃদ্ধ লোকটিকে কাবু করতে পারলো না। এসেই কাজে নেমে পড়লেন তিনি। প্রতিটি দাঁতের আকৃতি পরিমাপ করতে লাগলেন তিনি, নিতে থাকলেন সেগুলোর ওজন। গরম আবহাওয়ায় বেশ হাঁপিয়ে উঠছিলেন তিনি, তবুও থামার নাম নেই। একটি একটি করে দাঁতের হিসাব নিচ্ছিলেন আর সেগুলো এক্সেল স্প্রেডশিটে তুলে রাখছিলেন তিনি। সেই সাথে খোঁজ করছিলেন সেগুলোতে বিশেষ কোনো চিহ্নের। কোনো বিশেষ চিহ্ন থাকার অর্থ হলো সেগুলো বিশেষ কোনো বিক্রেতার কাছে যাবে কিংবা বিশেষ কোনো শিকারী দল সেই হাতিগুলোকে শিকার করেছে। পরদিন তার দলের অন্যান্য সদস্যরাও এসে হাজির। তারা এসে হাতির দাঁতগুলো জোড়ায় জোড়ায় মিলাতে বসে গেলো।
এগুলো তো ছিলো কেবল প্রাথমিক কাজ। এবার শুরু হলো আসল কাজ। মুখে মাস্ক আর চোখে গগলস লাগিয়ে নিলেন বৃদ্ধ লোকটি। এরপর ব্যাগ থেকে বের করলেন সিঙ্গাপুরে নেমেই কেনা সেই করাতগুলো। তারপর ম্যাচবাক্সের মতো আকারের অংশ সেখান থেকে কাটতে শুরু করলেন তিনি। কাটতে কাটতে একবার সামনের দিকে তাকালেন লোকটি, দেখতে পেলেন সারি সারি হাতির দাঁত পড়ে রয়েছে সেখানে। দেখেই মনটা মারাত্মক খারাপ হয়ে গেলো তার। শুধুমাত্র কিছু অর্থের জন্য প্রকৃতির এমন চমৎকার একটি প্রাণীকে মানুষ এভাবে নিধন করে চলেছে ভাবতেই মনটা খারাপ হয়ে গেলো তার। দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবারো কাজে মন দিলেন তিনি, নিতে লাগলেন হাতির দাঁতের নমুনা। আর দীর্ঘশ্বাস তিনি ফেলবেনই না কেন বলুন তো? এই পরিমাণ দাঁত সংগ্রহ করতে কম করে হলেও এক হাজার হাতিকে যে জীবন দিতে হয়েছে!
আমাদের আজকের নায়কের পরিচয় কিছুক্ষণ পরেই জানাচ্ছি। তার আগে বলুন তো তিনি কেন পাচার হওয়া হাতির দাঁত থেকে কিছু অংশ কেটে নিচ্ছিলেন? আপনি নিশ্চয়ই বলবেন, “গবেষণা করার জন্য”, তাই না? হুম, ঠিক বলেছেন। কিন্তু কোন ধরনের গবেষণা সেটা বলতে পারবেন কি?
আজ থেকে প্রায় দু’দশক আগে হাতির জেনেটিক্স নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন লোকটি। তখন তিনি মধ্যবয়স্ক, শরীরে এখনকার থেকে জোর অনেক বেশি, তাই কাজও করতে লাগলেন পুরোদমে। হাতির মল থেকে প্রাপ্ত ডিএনএ থেকে তিনি জেনেটিক্সের উপর ভিত্তি করে তৈরি করলেন একটি মানচিত্র। এলাকাভেদে হাতিদের মিউটেশন হয়ে থাকে বিভিন্ন রকম। তার দীর্ঘদিনের পরিশ্রমের ফসল হিসেবে প্রাপ্ত এ মানচিত্র থেকে জানা সম্ভব কোন অঞ্চলে সেই মিউটেশনটি হয়েছে। যখনই তিনি কোনো হাতির দাঁতের নমুনা নিয়ে কাজ করেন, তখন তিনি সেটার মিউটেশন চিহ্নিত করতেন পারেন। এরপর সেই মিউটেশন আর হাতির মল থেকে প্রাপ্ত ডিএনএ ব্যবহার করে বানানো মানচিত্র থেকে তিনি খুঁজে বের করেন হাতিগুলো কোথা থেকে এসেছে। হাতির উৎসস্থল খুঁজে কী লাভ? সেটা বুঝতে চলুন আজকের লেখার বাকি অংশ থেকে ঘুরে আসা যাক।
যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান অঙ্গরাজ্যের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহর ডেট্রয়েট। এখানেই বেড়ে ওঠেন আমাদের আজকের আলোচ্য ৬৩ বছর বয়সী সেই বৃদ্ধ, নাম তার স্যাম ওয়েসার। আমাদের অনেকেই শৈশব-কৈশোরে বাংলা রচনায় ‘জীবনের লক্ষ্য’ হিসেবে মুখস্ত করে বড় হয়ে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, নাহয় শিক্ষক হবার কথা। বাস্তবে সেটা যে কতজন হতে পারে সেটা সময় এবং পরবর্তীকালের পরিস্থিতিই জানিয়ে দেয়। তবে এদিক থেকে একেবারেই ব্যতিক্রম ছিলেন ওয়েসার। ছোটবেলায় যখন পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশনে আফ্রিকার দেশগুলোতে নির্বিচারে পশু হত্যা, তাদের দেহের বিভিন্ন অংশ পাচারের খবর পড়তেন কিংবা দেখতেন, তখন তার মনটা ব্যথিত হতো। ব্যথিত সেই মনকে শান্ত করতেই তাই কিছুটা পরিণত বয়সে এসে তিনি সিদ্ধান্ত নেন বড় হয়ে আফ্রিকার পশুচিকিৎসক হবার!
আমেরিকার মতো দেশে থেকে আফ্রিকার বনজঙ্গলে গিয়ে পড়ে থাকার ব্যাপারটি যে কারো কাছেই বিস্ময়কর ঠেকবে। আমাদের দেশে হলে হয়তো বাবা-মা, পাড়া-প্রতিবেশীরা নাক সিটকে নানা কটুকথা শোনাতো, অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে দিতো এমন মহৎ একটি স্বপ্নকে। তবে ওয়েসারের ভাগ্য ভালো বলতে হবে। কারণ পরিবারের সমর্থন তার ভাগ্যে জুটেছিলো।
কলেজে পড়াকালে এক গ্রীষ্মে উগান্ডায় একজন গবেষকের সাথে সিংহদের নিয়ে কাজ করার প্রস্তাব পান ওয়েসার। এমন একটি চাকরিই তো ছিলো তার বহুদিনের আকাঙ্ক্ষা। তাই আর দেরি করলেন না, বাক্স-পেটরা গুছিয়ে উড়াল দিলেন উগান্ডার উদ্দেশ্যে। পথিমধ্যে কেনিয়ার নাইরোবিতে একটি ঘটনা ঘটে যায়। তিনি জানতে পারেন, যে গবেষকের সাথে তিনি কাজ করতে যাচ্ছিলেন, তৎকালীন উগান্ডার স্বৈরশাসক ইদি আমিনের সেনারা ক্যাম্পে হানা দিয়ে তার ট্রাক নিয়ে গেছে, নষ্ট করে দিয়ে গেছে এতদিন ধরে জমানো সব তথ্য! ওয়েসারকে একটি চিঠিও দেয়া হয় যাতে লেখা ছিলো, “এসো না”। কিন্তু ওয়েসারও এত সহজে ছাড় দেয়ার পাত্র না। যে স্বপ্নকে ছুঁতে তিনি এত দূর ছুটে এসেছেন, নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী একদল মানুষরূপী পশুর জন্য তিনি সেই স্বপ্নকে হাতছাড়া হতে দিতে চাইলেন না। তাই একটু খোঁজাখুঁজি করে কেনিয়াতেই বসত গড়লেন তিনি, শুরু করলেন সেখানকার সিংহদের নিয়ে গবেষণামূলক একটি চাকরি।
কালক্রমে তিনি তানজানিয়ার বেবুনদের নিয়ে কাজ শুরু করেন। সেখানে কিছু বিষয়ে বুঝতে সমস্যা হওয়ায় পরিচিত এক ক্যান্সার গবেষকের শরণাপন্ন হন ওয়েসার। সেই গবেষক আবার তার রোগীদের মলের নমুনার সাহায্যে তাদের হরমোন লেভেল ট্র্যাক করছিলেন। সেবারই প্রথম ওয়েসার মলের ক্ষমতা বুঝতে পারেন।
বেবুনদের নিয়ে গবেষণা করতে তাকে অনেক এলাকাজুড়ে ঘুরে বেড়াতে হতো। এভাবে ঘুরে বেড়ানোর সময় কখনো তিনি পড়ে থাকতে দেখতেন হাতির খুলি, কখনো আবার পেতেন পুরো কঙ্কালটিই। তবে একদিনের ঘটনা তাকে বেশ ব্যথিত করে। সেদিন তিনি একজোড়া দাঁত দেখতে পেয়েছিলেন- একটি ছোট, অপরটি বেশ বড়। সম্ভবত শিকারীরা প্রথমে বাচ্চাটিকে হত্যা করেছিলো। এরপর মা তার সন্তানকে বাঁচাতে এলে তাকেও হত্যা করে। এমন একটি ঘটনা চিন্তা করেই বেশ মুষড়ে পড়েন ওয়েসার। সাথে সাথে চোয়ালগুলো শক্ত হয়ে আসে তার, করে বসেন এক দৃঢ় প্রতিজ্ঞা- যেভাবেই হোক হাতিদের রক্ষা করতে হবে। সেদিন থেকেই নিজের জীবনের নতুন এক মিশন শুরু করে দেন তিনি।
ওয়েসারের ভাগ্য ভালোই বলতে হবে। কারণ বনে-জঙ্গলে খুব সহজেই হাতির মলের দেখা মিলতো। এমনকি কখনো কখনো তো তিনি বিশ্রাম নেয়ার জন্য হাতির শুকিয়ে যাওয়া মলের উপরই বসে পড়তেন! প্রতি গ্রাম মলেই থাকতো লাখ লাখ কোষ, যেগুলো তার মালিকের ডিএনএ’র কপি সংরক্ষণ করতো। শুরুতে এ পথে তার কোনো সঙ্গী ছিলো না। নিজেই সব মল সংগ্রহ করে সেগুলো নিয়ে গবেষণা করতেন ওয়েসার। কিছুদিন পর মনে হলো কাজের পরিধি আরো বাড়ানো দরকার। তাই এবার আফ্রিকাতে পরিচিত সব জীববিজ্ঞানী আর হাতির খেলা দেখিয়ে জীবিকা অর্জনকারীদের কাছে তাদের হাতির মলের নমুনা চেয়ে আবেদন জানালেন তিনি, সাড়াও মিললো আশাতীতভাবে। এভাবেই যেন ধীরে ধীরে এক ইতিহাস গড়ার পথে হাঁটছিলেন স্যাম ওয়েসার।
বিভিন্ন হাতির দলের মিউটেশনগুলো হয়ে থাকে বিভিন্ন রকম। এই ভিন্নতার দরুন ওয়েসার নজর দিলেন তাদের জাঙ্ক ডিএনএ’র দিকে। তিনি হাতির ডিএনএ-তে এমন ১৬টি মাইক্রোস্যাটেলাইট শনাক্ত করলেন যেখানে এলাকাভেদে পুনরাবৃত্ত হওয়া অংশের সংখ্যা ভিন্ন হয়ে থাকে। এভাবে দশ বছর ধরে হাজার হাজার হাতির মল নিয়ে গবেষণা করে এক অসাধারণ ডাটাবেজ বানাতে সক্ষম হলেন ওয়েসার। তখন ১৯০ মাইলের ভেতরে যেকোনো জায়গা থেকে হাতির মল এনে দিলেই কিছুক্ষণ গবেষণা করে তিনি বলে দিতে পারতেন সেটি কোথা থেকে এসেছে!
মানচিত্র তো বানানো হলো, এবার এটাকে কাজে লাগানো দরকার। সেই সু্যোগটিও ওয়েসার পেয়ে যান ২০০৫ সালে। সেই বছর সিঙ্গাপুরের বন্দর কর্তৃপক্ষ ‘সোপস্টোন’ নামক এক জাহাজ থেকে ৭ টন হাতির দাঁতের বিশাল এক চালান আটক করে। দক্ষিণ-পূর্ব আফ্রিকার দেশ মালাউই থেকে এই চালান প্রথমে আসে দক্ষিণ আফ্রিকায়। এরপর সেটি এশিয়ায় এসে সিঙ্গাপুরে আটক হয়। সেখানে ৫০০টি হাতির দাঁত ও ৪০,০০০ হাতির দাঁতের তৈরী সিলিন্ডার ছিলো। বন্দরের কর্মকর্তারা ভেবেছিলেন এত বড় চালান বোধহয় বিশ্বের নানা দেশ থেকে হাতি মেরে প্রস্তুত করা হয়েছে। কিন্তু ওয়েসারের ম্যাপ বের করে আনলো এর থেকেও বড় এক করুণ সত্য। সবগুলো হাতিই আসলে আফ্রিকা মহাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের দেশ জাম্বিয়ার। অর্থাৎ কেবলমাত্র একটি অঞ্চলেরই অগণিত হাতিকে মেরে ফেলা হয়েছিলো এ দাঁতগুলো সংগ্রহ করতে।
পরের বছর কাহিনী ঘটলো তাইওয়ানে। সেখানকার কর্তৃপক্ষ সিসল কাঠে ভরা দুটো কন্টেইনার উদ্ধার করে। সেগুলো বহনকারী জাহাজের গতিবিধি তেমন সুবিধার মনে না হওয়াতেই আটক করা হয়। সেখান থেকে পাওয়া যায় ১,১০০ হাতির দাঁত। এর কিছুদিন পরের কথা, ঘটনাস্থল এবার হংকং। একজন তার প্রতিবেশীর বাসার গুদাম থেকে দুর্গন্ধ আসার ব্যাপারে পুলিশকে জানালে পুলিশ সেখানে অভিযান চালায়। অবিশ্বাস্যভাবে সেখানে পাওয়া যায় ৪০০টি হাতির দাঁত। উৎস সন্ধানে আবারো ডাক পড়ে ওয়েসারের। দু’জায়গার হাতির দাঁতের উৎস হিসেবেই তিনি শনাক্ত করেন দক্ষিণ তানজানিয়াকে।
সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়ে ওয়েসার যখন গবেষণা শুরু করেন, তখন আফ্রিকা মহাদেশে হাতির সংখ্যা ছিলো আনুমানিক পনের লক্ষ। কালক্রমে হাতির দাঁতের মূল্য বৃদ্ধি পেতে থাকে। আশির দশকে গিয়ে তা প্রায় পাঁচগুণ বৃদ্ধি পায়, ফলে আশঙ্কাজনক হারে কমতে থাকে হাতির সংখ্যা। ১৯৮৯ সালে দেখা যায় এ সংখ্যা নেমে এসেছে মাত্র ছয় লাখে। টনক নড়ে ওঠে বিশেষজ্ঞদের, এভাবে চললে অল্প দিনের ভেতরেই আফ্রিকা হাতিশূন্য হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তারা।
নব্বইয়ের দশক থেকে তাই আন্তর্জাতিকভাবে আফ্রিকান হাতির দাঁত বিক্রি নিষিদ্ধ করা হয়। এভাবে আস্তে আস্তে পরিস্থিতি উন্নতির দিকে যেতে থাকে, বাড়তে শুরু করে হাতির সংখ্যা। কিন্তু ২০০৬ সালের দিকে এসে পরিস্থিতি আবারো উল্টোপথে হাঁটতে শুরু করে। ২০১২ সালে বেইজিংয়ে কালোবাজারে হাতির দাঁতের দাম দাঁড়ায় পাউন্ডপ্রতি ১,০০০ ইউএস ডলারে। শুধুমাত্র সেই বছরই সারা বিশ্বে আনুমানিক ২২,০০০ হাতিকে হত্যা করা হয়! ফলে আবারো পৃথিবীর বুক থেকে হাতি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবার ব্যাপারে আশঙ্কা প্রকাশ করেন বিশেষজ্ঞগণ।
বর্তমানে আফ্রিকায় হাতির সংখ্যা নেমে এসেছে চার লাখের ঘরে। ২০১৫ সাল পর্যন্ত ওয়েসার ২৮টি হাতির দাঁতের চালান নিয়ে কাজ করেছেন, যেগুলোতে থাকা দাঁতের পরিমাণ সব মিলিয়ে প্রায় ৬২.৫ টন! উত্তর-পূর্ব গ্যাবন, উত্তর-পশ্চিম কঙ্গো, দক্ষিণ-পূর্ব ক্যামেরুন, তানজানিয়া, মোজাম্বিকের উত্তরাঞ্চল ও কেনিয়ার দক্ষিণাঞ্চলই মূলত হাতি শিকারের স্বর্গরাজ্য। হিসেব করে দেখা গেছে কেবলমাত্র ২০০৯ থেকে ২০১৬, এ সাত বছরে কেবলমাত্র তানজানিয়াতেই হাতির সংখ্যা ১,০৯,০৫১ থেকে নেমে এসেছে ৪২,৮৭১ এ! ওয়েসারের মানচিত্র যে কেবল হাতিগুলো কোথাকার সেটা জানাতে পেরেছে তা-ই নয়, বরং এর সাথে জড়িত অনেক অপরাধীকে ধরাও সম্ভব হয়েছে শুধু তার সেই হাতির মলের মানচিত্রের বদৌলতে। এদের মাঝে শীর্ষস্থানীয় বলা যায় টোগোর এক হাতির দাঁত ব্যবসায়ীকে, যাকে সবাই ‘দ্য বস’ নামে চেনে; আছে আরেকজন চীনা নারীও, যাকে সবাই বলে ‘হাতির দাঁতের রানী’।
ওয়েসারের এভাবে কাজ করে যাওয়া যে অপরাধীদের গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দেবে তা তো সহজেই অনুমান করা যায়। সেজন্য তানজানিয়াকে আফ্রিকার হাতিদের মরণভূমি হিসেবে চিহ্নিত করার পর সেখানে কাজ করতে যেতে তিনি ঠিক সাহস পাচ্ছিলেন না। পরিস্থিতি আরো খারাপ হয় যখন তার খুব কাছের এক সহকর্মীকে সেখানেই খুন করা হয়। তবে ২০১৫ সালের নভেম্বর থেকে পরিস্থিতি পাল্টাতে শুরু করে। তানজানিয়ার নতুন প্রেসিডেন্ট জন মাগুফুলি শপথ নেবার পরপরই হাতির দাঁত পাচারের বিরুদ্ধে নিজের কঠোর অবস্থান ঘোষণা করেন। সেই সাথে ওয়েসার ও তার দলকে সেখানে কাজ করার ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে পূর্ণ নিরাপত্তা ও সহযোগিতা দেয়া হতে থাকে।
হাতিদের নিয়ে আজও তাই নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন ওয়েসার। তবে এখন তার চিন্তা পাচারকারীরা হয়তো নতুন নতুন জায়গা বের করে সেখানকার হাতি মারা শুরু করবে। এজন্য তিনি চান কোথাও হাতির দাঁতের কোনো চালান ধরার পড়লে সেই দেশের সরকার যেন যত দ্রুত সম্ভব তার সাথে যোগাযোগ করে। কখনো কখনো ১-২ বছর দেরি করে তার সাথে যোগাযোগ করা হয় যা পাচারকারীদের নতুন জায়গা খুঁজে নেয়ার জন্য অনেক লম্বা সময়। কিন্তু তাড়াতাড়ি যোগাযোগ করলে নতুন কোন জায়গাগুলো থেকে হাতি শিকার করা হচ্ছে তা জেনে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হবে।
ওয়েসার যে তার কাজ শুধু হাতিদের মাঝে সীমাবদ্ধ রেখেছেন, এটা বললে ভুল হবে। বরং অন্যান্য আরো বেশ কিছু প্রাণী নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি, কাজ করছেন তাদের বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষার জন্য। এ তালিকায় রয়েছে কিলার হোয়েল, পোলার বিয়ার, প্যাসিফিক পকেট মাউস, সেজ গ্রাউস, ক্যারিব্যু ইত্যাদি। তার সহকর্মীরা তাকে মজা করে ডাকেন ‘মলের গুরু’ নামে। আর গর্বভরে তিনি এ উপাধি মাথা পেতে নিয়েছেন। মলের গুরু হয়ে যদি বিশ্বের বাঘা বাঘা পাচারকারীদের ধরিয়ে দেয়া যায়, বাঁচানো যায় বিভিন্ন প্রজাতির হাজার হাজার প্রাণীর জীবন, তবে প্রকৃতিকে আরো সুন্দর করে সাজাতে, প্রকৃতির সাথে মানবসমাজের বন্ধন সুদৃঢ় করতে এমন মলের গুরুই তো আমাদের দরকার!
ইন্টারপোলের ওয়াইল্ডলাইফ ক্রাইমস গ্রুপের সাবেক প্রধান বিল ক্লার্ক ওয়েসার সম্পর্কে যর্থার্থই বলেছেন, “আমি মনে করি নোবেল পুরষ্কারটা স্যামের প্রাপ্য।” পাঠক, আপনি কি ক্লার্কের সাথে দ্বিমত পোষণ করবেন?