বাবা-মায়ের কাছে সন্তান মানেই চোখের মণি, সাত রাজার ধন। সন্তানের সুস্থ-সুন্দর বর্তমান আর ভাবনাহীন ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে বাবা-মা কত কী করেন, সে সম্পর্কে বলে বা লিখে শেষ করা অসম্ভব। একটি সন্তান জন্ম হওয়া মানেই বাবা-মা হিসেবেও প্রতিটি মানুষের নতুন জন্ম ঘটে। কীভাবে বাচ্চার ভালো হবে, কোনটায় খারাপ হবে, কোনটা করা উচিৎ আর কোনটা উচিৎ নয়- সব কিছু মিলিয়ে এ যেন নতুন এক জগৎ। সন্তানের কল্যাণ চিন্তায় মগ্ন বাবা-মা তাদের ক্ষমতা বা ক্ষমতার বাইরে যতটুকু পারা যায়, সম্ভাব্য এমন সব কিছু করেন। কারণ একটিই, নিজের কলিজার টুকরোকে কোনো দুঃখ, কষ্ট, গ্লানি যাতে স্পর্শ না করতে পারে। কিন্তু আপনার এই সমস্ত চেষ্টা ধুলিসাৎ করে দিয়ে শিশুর সুস্থ মানসিক বিকাশ তথা সুন্দর জীবন যাপনের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে পারে ‘শিশু নির্যাতন’ বা ‘চাইল্ড অ্যাবিউজ’ (Child Abuse)। এটা নিয়ে বিশদ ব্যাখ্যার আগে জানতে হবে- শিশু নির্যাতন কী?
শিশু নির্যাতন
সহজ কথায় বলতে গেলে শিশু নির্যাতন মানে হচ্ছে শিশুর প্রতি বাবা-মা বা অভিভাবক বা আশেপাশের কোনো ব্যক্তির এমন কোনো আচরণ, যার দরুন শিশু মানসিক বা শারীরিকভাবে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ হয়। হতে পারে সেটা বাবা-মা অথবা পরিবারের অন্য কারও কাছ থেকে শারীরিক বা মানসিকভাবে নির্যাতন বা পরিচিত কেউ, স্কুলের বন্ধু, সমবয়সী কেউ অথবা বাইরের কারও কাছ থেকে শারীরিক বা মানসিকভাবে আঘাত পাওয়া।
শিশু নির্যাতনের প্রকারভেদ
শিশু নির্যাতনের বেশ কয়েকটি প্রকারভেদ রয়েছে। তাই ব্যাপারটি নিয়ে পুরোপুরি জানতে হলে এই প্রকারভেদ সম্পর্কে জানা অপরিহার্য।
শারীরিক নির্যাতন (Physical Abuse)
শারীরিক নির্যাতন বা ফিজিক্যাল অ্যাবিউজ বলতে শিশুকে শারীরিকভাবে আঘাত করা বোঝায়, সেটা ইচ্ছাকৃত হতে পারে আবার অনিচ্ছাকৃত হতে পারে। যেমন- শিশুকে লাথি মারা বা পা দিয়ে আঘাত করা, চড় মারা বা চড় মারার হুমকি দেওয়া, জ্বলন্ত কিছু দিয়ে শরীরে কোথাও পুড়িয়ে দেওয়া, চুল ধরে টানা, কান ধরে টানা, শিশুকে ধরে জোরে জোরে ঝাঁকি দেওয়া, অন্ধকার ঘরে আটকে রাখা, লাঠি বা অন্য কিছু দিয়ে আঘাত করা ইত্যাদি।
বাবা-মা বা অভিভাবক হিসেবে আপনার সন্তানকে শাসন করার সমস্ত অধিকার আছে ঠিকই, কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, আপনার এই ধরনের আচরণ আপনার সন্তানকে সারা জীবনের জন্য বিপর্যস্ত করে দিতে পারে। শারীরিক নির্যাতনের জন্য আপনার সন্তান কী কী সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে আসুন দেখি।
- শরীরে অভ্যন্তরীন আঘাত ও মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে।
- হাড় ভেঙে যেতে পারে ও আপনার সন্তানের দুর্বল জয়েন্টগুলো নড়ে যেতে পারে।
- মানসিকভাবে সারা জীবনের জন্য বিধ্বস্ত হয়ে যেতে পারে।
- শারীরিকভাবে সারা জীবনের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, মৃত্যুর সম্ভাবনাও আছে।
কীভাবে বুঝবেন শিশু শারীরিক নির্যাতনের শিকার কিনা
- খেলার সাথী, পোষা প্রাণী ও অন্যান্য পশু পাখির উপর আক্রমণাত্মক মনোভাব।
- বাবা-মা বা অভিভাবক অথবা বয়সে বড় কাউকে দেখে অনেক ভয় পাওয়া।
- অত্যধিক ভয় পাওয়া, প্রায় সময় বিষণ্ন থাকা এবং সামান্য কিছুতেই খুব বেশি উদ্বেগ প্রকাশ করা।
- ঠিকঠাক ঘুম না হওয়া ও রাতে প্রায়ই দুঃস্বপ্ন দেখা।
- শিশুর মানসিক ও আচরণগত সমস্যা।
- আত্ম-ধ্বংসাত্মক আচরণ বা মনোভাব।
যৌন নির্যাতন (Sexual Abuse)
শিশু নির্যাতনের প্রকারের মধ্যে সবচেয়ে জঘন্য ও ভয়ঙ্কর একটি হলো যৌন নির্যাতন বা সেক্সুয়াল অ্যাবিউজ । যখন কোনো শিশুকে তার চেয়ে বড় বয়সী কোনো ব্যক্তি স্পর্শ বা স্পর্শ ছাড়াই যৌন আচরণের মধ্যে পড়ে এমন ধরনের আচরণ করে, তখন তাকে ‘চাইল্ড সেক্সুয়াল অ্যাবিউজ’ বলে।
সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপারটা হচ্ছে, একটি শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হবার সম্ভাব্য সবচেয়ে বেশি ঝুঁকি থাকে তার পরিবারে, মানে যৌন নির্যাতনের শিকার বেশিরভাগ শিশুই তাদের পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকেই শিকার হয়।
স্পর্শগত যৌন নির্যাতন
- শিশুর শরীরের স্পর্শকাতর অংশে স্পর্শ করা।
- শিশুকে অস্বাভাবিকভাবে জড়িয়ে ধরা বা চুমু খাওয়া।
- শিশুকে জোর পূর্বক নির্যাতনকারীর শরীরের স্পর্শকাতর অংশ বা ঠোঁটে, গলায়, বুকে ও পিঠে স্পর্শ করতে বাধ্য করা।
- শিশুর ঠোঁটে অস্বাভাবিকভাবে হাত বুলানো বা সরাসরি ঠোঁটে চুমু খাওয়া।
- যৌন আনন্দ দেয় এই ধরনের কোনো খেলা ইত্যাদি।
উল্লেখ্য, উপরের সবগুলো বিষয় স্পর্শগত যৌন নির্যাতনের মধ্যে পড়ে। তবে বাবা-মা অথবা পরিবারের অন্য সদস্য যেমন- শিশুর ভাইবোন বা অন্য খুব নিকটতম সম্পর্কের কারও ক্ষেত্রে এই বিষয়গুলো নির্যাতনের তালিকাভুক্ত না-ও হতে পারে। এক্ষেত্রে বলা যায়, একজন মা-বাবা হিসেবে যখন আপনার সন্তানের প্রতি কারও আচরণ সন্দেহজনক হবে, তখন আপনি নিজেই বুঝতে পারবেন সেটা নির্যাতনের পর্যায় পড়ে নাকি পড়ে না।
অস্পর্শগত যৌন নির্যাতন
- শিশুকে ইচ্ছাকৃতভাবে শরীরের স্পর্শকাতর অংশ দেখানো।
- শিশুকে নগ্ন হতে বলা বা লুকিয়ে শিশুর নগ্নতা উপভোগ করা অথবা শিশুকে বাথরুম ব্যবহার করতে দেখা।
- শিশুকে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করতে বলে ছবি তোলা।
- শিশুকে পর্নোগ্রাফি বা অশ্লীল ছবি, ভিডিও ফুটেজ বা অন্যকিছু দেখানো।
- শিশুকে যৌনকাজের কোনো বর্ণনা শোনা বা দেখাতে আগ্রহী করে তোলা।
শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়ার লক্ষণসমূহ
এমন কোনো আচরণ যদি আপনার শিশুর মধ্যে লক্ষ্য করেন, তবে তার উপরে যৌন নির্যাতন হয়েছে কিনা সে ব্যাপারে অভিভাবকের অনুসন্ধান করা উচিত:
- খেলনা পুতুল বা অন্য যেকোনো খেলনার সাথে যৌনকাজের অভিনয় করা।
- ঘুমোতে না পারা ও দুঃস্বপ্ন দেখা।
- জামা কাপড় বদলাতে অসম্মতি জানানো।
- হুট করেই আচরণগত পরিবর্তন। যেমন- হুটহাট রেগে যাওয়া, কান্নাকাটি করা, একা থাকতে চাওয়া অথবা ভয় পাওয়া।
- ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া না করা।
- কোনো কারণ ছাড়াই হঠাৎ গোপনীয়তা নিয়ে খুব বেশি সচেতন হয়ে ওঠা।
- নিজেকে নিয়ে হীনমন্যতায় ভোগা, আত্মবিশ্বাসহীনতা ও নিজের প্রতি সব রকম আগ্রহ হারিয়ে ফেলা।
- টাকা, উপহার বা খাবার হাতে নিয়ে বাড়ি ফেরা অথবা ঘরে এ ধরনের কিছু পাওয়া।
- বয়সে বড় কারও সঙ্গে একসাথে থাকতে না চাওয়া বা দেখে পালিয়ে যাওয়া।
- শরীরে অনাকাঙ্ক্ষিত দাগ যেমন, কামড়, আঁচড় বা জোরে ধরার দাগ এবং শরীরের স্পর্শকাতর অংশে আঘাতের চিহ্ন।
- বয়সের তুলনায় যৌনতার বিষয়ে অতিরিক্ত জ্ঞান বা জানার আগ্রহ।
মানসিক নির্যাতন (Emotional Abuse)
একজন বাবা-মা অথবা অভিভাবক যখন শিশুর স্বাভাবিক মানসিক বিকাশে বাধার সৃষ্টি হয় এমন ধরণের আচরণ করেন, সেটা তখন মানসিক নির্যাতন বা ইমোশনাল অ্যাবিউজের আওতায় পড়ে। আর এই মানসিক নির্যাতনের ফলাফল স্বরূপ একটি শিশুর মানসিক ও সামাজিক উন্নয়ন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
মানসিক নির্যাতন হিসেবে ধরা হয় যে আচরণগুলো
- শিশুর চাওয়া-পাওয়াকে প্রত্যাখ্যান করা
- শিশুর সাথে শত্রুতা/বিরোধিতা করা
- শিশুকে উত্যক্ত করা
- তার উদ্দেশ্যে চিৎকার করা
- শিশুকে সরাসরি সমালোচনা করা
- শিশুকে আলাদা করে রাখা বা আটকে রাখা
মানসিক নির্যাতনের শিকার হওয়া শিশুর মধ্যে নিচের লক্ষণগুলো দেখা যাবে:
- আত্মহত্যা করার প্রবণতা বা নিজেকে কষ্ট দেওয়ার মনোভাব।
- সঠিক মানসিক বিকাশ না হওয়া।
- সমবয়সী অন্যান্য শিশুদের মতো স্বতঃস্ফূর্ত কথাবার্তা বলতে না পারা।
- সঠিক শারীরিক বিকাশ সাধন না হওয়া।
- কোনো কিছু শেখার অক্ষমতা।
- অনেক বেশি রক্ষণাত্মক হওয়া।
- অনেক বেশি আবেগগ্রস্থ ও সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে অক্ষম হওয়া।
- অসামাজিক ও ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ।
উপেক্ষা (Negligence)
শিশু নির্যাতনের প্রকারগুলোর মধ্যে উপেক্ষা অত্যন্ত বাজে প্রভাব ফেলে একটি শিশুর উপর। শিশুকে তার প্রাপ্য ভালোবাসা, আদর, যত্ন এবং মনোযোগ না দেওয়াই হলো তাকে উপেক্ষা করা। যখন আপনার শিশু আপনার কাছে আদর ভালোবাসার বদলে কেবল উপেক্ষা আর অবহেলা পাবে, তখন তার ভেতরের সৃজনশীল সত্তা আস্তে আস্তে মরে যেতে থাকবে। আপনি আপনার সন্তানকে যথেষ্ট ভালোবাসেন, কিন্তু আপনি যদি সেটি তার কাছে উপস্থাপন করতে অপারগ হন, তাহলে আপনার ছোট্ট সোনামণি ধরেই নেবে, আপনি তাকে অবহেলা করছেন।
আপনার আচরণের উপর ভিত্তি করে তিনভাবে আপনার সন্তান নিজেকে উপেক্ষিত ভাবতে পারে। যেমন,
শারীরিক চাহিদার অধিকার উপেক্ষা করা
প্রতিটি শিশু অধিকার রাখে সুস্বাস্থ্য, সুন্দর পরিবেশ ও পর্যাপ্ত যত্ন পাবার। এখন আপনি যদি কেবল সন্তানের খাবার, কাপড় আর থাকার জায়গা নিশ্চিত করেই ভাবেন আপনার দায়িত্ব শেষ, তাহলে আপনার সন্তান নিজেকে উপেক্ষিত ভাববে, এর শতভাগ গ্যারান্টি দেয়া যায়।
মানসিক চাহিদার অধিকার উপেক্ষা করা
শিশুরা আদর, ভালোবাসা আর আপনার একটু মনোযোগ এগুলোই সবচেয়ে বেশি খোঁজে। আপনি যদি এগুলো নিশ্চিত করতে না পারেন বা আপনার সন্তান আপনার দিক থেকে কোনো সাপোর্ট না পায়, তাহলে তার মন উপেক্ষার শিকার হবে।
সুচিকিৎসার অধিকার উপেক্ষা করা
আপনার সন্তানের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করার দায়িত্ব আপনার। শরীর খারাপ করলে কেবল ডাক্তার দেখিয়ে আনলেই আপনার দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না, তার যত্ন নেয়া এবং সময়মতো খোঁজ খবর নেয়া আপনার দায়িত্ব। এমনকি অসুস্থ অবস্থায় আপনার সামান্য উদাসীনতাও কিন্তু শিশুর জন্য অবহেলা। এগুলো দিতে ব্যর্থ হলে আপনার শিশু উপেক্ষার শিকার হবে।
শিক্ষার অধিকার উপেক্ষা করা
একটি শিশুর সুন্দর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার জন্য তার পড়ালেখা ও সুরক্ষিত শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করে দেওয়া আপনার কর্তব্য। শুধু তা-ই নয়, তার লেখাপড়ার খোঁজ খবর নেওয়া, তাকে মানসিকভাবে সাপোর্ট দেওয়াও আপনারই দায়িত্ব। এগুলো যদি দিতে না পারেন, আপনার কাছে শিশু নিজেকে অবহেলিত ভাবতে শুরু করবে।
লক্ষ্য করুন, আপনার শিশু যদি অন্যান্য বাচ্চাদের প্রতি বন্ধুসুলভ আচরণের পরিবর্তে রুঢ় আচরণ করে, নিজের শরীরের তুলনায় ছোট-বড় কাপড় পরে অথবা আবহাওয়া অনুযায়ী কাপড় পরে না বের হয়, বয়স অনুযায়ী ওজন অনেক কম থাকে বা নিয়মিত অসুখে ভোগে, অপরিস্কার থাকে, পড়াশোনায় অনিয়মিত হয় এবং সব সময় ক্লান্ত ও নিজেকে নিয়ে হীনমন্যতায় ভোগে ইত্যাদি ঘটনা ঘটে; তাহলে ধরে নেবেন একজন বাবা-মা বা অভিভাবক হিসেবে আপনি বাচ্চার সঠিক যত্ন নিতে পারেননি এবং আপনার বাচ্চা উপেক্ষিত হয়েছে আপনার কাছে।
শিশু নির্যাতন কী, এর প্রকারভেদ ও এর লক্ষণগুলো নিয়েই ছিল আজকের লেখা। পরবর্তী পর্বে ‘কীভাবে শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ করবেন’ তা নিয়েই থাকছে বিস্তারিত আলোচনা।
ফিচার ইমেজ- dnaindia.com