প্রাত্যহিক যান্ত্রিকতায় আর ব্যস্ততায় ভুলতে বসেছি আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের গৌরব। বিদেশীপণ্যের আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের দেশী পণ্য। আমাদের লোকশিল্প ও কারুশিল্প। মসলিন, জামদানি, শীতল পাটি, নকশিকাঁথার দেশের মানুষ হয়ে নিজেরাই নিজেদের ঐতিহ্য সম্পর্কে সঠিকভাবে জানি না।
আজ আমরা আমাদের ঐতিহ্য নিয়ে কথা বলব। বিশেষত মসলিন, জামদানি, শীতল পাটি, মৃৎ শিল্প ইত্যাদি। একটা সময় ছিল যখন গৃহস্থালির নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ঘরেই তৈরি করা হত। এখনও প্রায় অনেক গ্রামেই এই ব্যবস্থা রয়েছে। আর্থিক সচ্ছলতার জন্য অনেকে গৃহস্থালির সামগ্রী বিক্রিও করে থাকে। যাকে কুটির শিল্প বা লোকশিল্পও বলে থাকি। এই কুটির শিল্পের দরুন বাংলার নাম সারা দুনিয়াব্যাপী খ্যাত ছিল।
ঢাকাই মসলিন
প্রথমেই আসা যাক মসলিনের কথায়। শুধু মসলিন না বলে ঢাকাই মসলিন বলা ভাল। কারণ ঢাকার অদুরে ডেমরা এলাকার তাঁতিদের মস্তিষ্কপ্রসূত এই শিল্প কর্মের জন্য একসময় ঢাকা ছিল বিখ্যাত। ঢাকার তৎকালীন মোঘল বাদশাহদের বিলাসব্যসন ছিল এই মসলিন।
মসলিন এতই সূক্ষ্ম সুতা দিয়ে বোনা হত যে কয়েকশো গজ মসলিন একটি ছোট্ট আংটির ভেতর দিয়ে ঢুকিয়ে বের করে আনা সম্ভব ছিল। শুধুমাত্র কারিগরি দক্ষতার জিনিস নয় এই মসলিন। এটি গড়তে শিল্পীমনেরও দরকার। হারিয়ে গেছে ঐতিহ্যবাহী মসলিন।
জামদানি
ঢাকাই মসলিন হারিয়ে গেলে কি হবে মসলিনের কারিগরদের বংশধরেরা তো টিকে আছে। তারা তৈরি করছে মসলিনের জাত ভাই জামদানি। বর্তমানে এই জামদানি শিল্প আমাদের অত্যন্ত গর্বের বস্তু। দেশ বিদেশে প্রচুর রপ্তানি হয় আমাদের ঐতিহ্যবাহী জামদানি।
নারায়ণগঞ্জ জেলার নওয়াপাড়া গ্রামেই জামদানি কারিগরদের বসবাস। বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে দেখা যায় যে এ শীতলক্ষ্যা নদীর পানির বাষ্প থেকে যে আর্দ্রতার সৃষ্টি হয় তা জামদানি বোনার জন্য শুধু উপযোগীই নয়, বরং এক অপরিহার্য বস্ত্তও বলা চলে। ভৌগোলিক অবস্থান, আবহাওয়া এবং পরিস্থিতির জন্য শুধু অতীতের তাঁতিদের তাঁতশিল্পই নয়, বর্তমানের বড় বড় কাপড়ের কারখানাও শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে গড়ে উঠেছে।
নকশিকাঁথা
আরেক মৃতপ্রায় গ্রামীণ লোকশিল্পের নাম নকশিকাঁথা। বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটা গ্রামের একটি সাধারণ কুটিরশিল্প নকশিকাঁথা। গ্রামীণ নারীরা অবসরে পানের বাটাল নিয়ে নকশিকাঁথা বুনত। নকশিকাঁথার তৈরির অনন্য একটা সময় হল বর্ষাকাল। বর্ষাকালে যখন চারদিকে পানি থৈ থৈ করে তখন ঘরের বাইরে বের হওয়া প্রায় অসম্ভব ব্যাপার ছিল।
তাই বাড়ির মেয়ে বৌরা সংসারের কাজ শেষে দুপুরে খাওয়াদাওয়া সেরে পাটি বিছিয়ে পানের বাটাটি পাশে নিয়ে পা মেলে বসতেন এবং নকশা তোলা কাঁথা সেলাই করতে। পড়শিরাও সুযোগ পেলে আসত গল্প করতে। প্রায় ছয়মাস লেগে যেত একেকটা নকশিকাঁথা সেলাই করতে। আপন ভুবন রচনা করত নকশিকাঁথার জমিনে, নিজের সংসার, জীবন, কল্পনা আর ভালবাসার মানুষ থাকত দেই নকশিকাঁথায়। একেকটা ফোঁড়ের পেছনে থাকে কতনা গল্প, হাসি, কান্না।
খাদি শিল্প
খাদি শিল্পের সাথে আমরা অনেকেই পরিচিত। ঈদে খাদি পাঞ্জাবী না হলে অনেকের ঈদ আনন্দ নষ্ট হয়ে যায়। এর বিশেষত্ব হল, এ ধরণের কাপড় পুরোটাই হাতে প্রস্তুত করতে হয়। কুমিল্লা, নোয়াখালী ও চট্টগ্রামে প্রস্ত্তত খাদি বা খদ্দরের সমাদর শুধু গ্রামজীবনেই নয়, শহরের আধুনিক সমাজেও যথেষ্ট রয়েছে।
গ্রামীণ এলাকায় কাটুনি নামক এক সম্প্রদায় রয়েছে যারা অবসর সময়ে সুতা কাটে। গ্রামে অনেক বাড়িতেই তুলা গাছ লাগানোর রেওয়াজ আছে। সেই তুলা গাছের তুলা দিয়ে সুতা কাটা ও হস্তচালিত তাঁতে প্রস্তুত করা হয় খাদি কাপড়। খাদির একটি অনন্য ইতিহাস আছে।
স্বদেশী আন্দোলনের যুগে বিদেশি কাপড় বর্জন করে দেশি কাপড় ব্যবহারের যে আদর্শ প্রবর্তিত হয়েছিল তারই সাফল্যের স্বাক্ষর এই খাদি।
আদিবাসী তাঁতশিল্প
আমাদের দেশের আদিবাসী সমাজ আমাদের চেয়ে অনেক বেশি নির্ভরশীল। তারা নিজেদের বস্ত্র নিজেরা বুনে পরিধান করে শুধু তাই নয় সেটা বিক্রিও করে। এতে আর্থিক সচ্ছলতা যেমন আসে তেমনই পরনির্ভরশীলতা কমে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটি, বান্দরবান এলাকার চাকমা, কুকি ও মুরং মেয়েরা এবং সিলেটের মাছিমপুর অঞ্চলের মণিপুরী মেয়েরা তাদের নিজেদের ও পুরুষদের পরিধেয় বস্ত্র বুনে থাকে। এ কাপড়গুলো সাধারণত মোটা ও টেকসই হয়। নকশা, রং ও বুননকৌশল সবই তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য অনুযায়ী হয়।
পোড়ামাটির শিল্প
পোড়ামাটির শিল্প আমাদের আধুনিক গৃহিণী সমাজে বেশ সমাদৃত। বাংলাদেশের পালপাড়া, কুমোরপাড়ার অধিবাসীরা সারা বছরই এই শিল্প নিয়ে ব্যস্ত থাকে। তাদের রুটি রুজি বা জীবিকা এই পোড়ামাটির শিল্প।
মাটির হাড়ি, পাতিল, শখের হাড়ি, সানকি, ফুলদানি, রসের ঠিলা, সন্দেশ ও পিঠার ছাঁচ, টেপা পুতুল, হিন্দু সম্প্রদায়ের দুর্গা, সরস্বতী, লক্ষ্মী ইত্যাদির মূর্তি এরাই গড়েন। এছাড়াও প্রাচীন মসজিদ মন্দিরের গায়েও পোড়ামাটির ফলকের প্রাচুর্য দেখা যায়। এ থেকেই বোঝা যায় পোড়ামাটির এই শিল্প কতটা জনপ্রিয় ছিল এই জনপদে।
কাঠশিল্প
কাঠে শিল্প তেমন একটা দেখা যায় না আজকাল। তবে পুরাতন খাট পালঙ্ক, খুঁটি দরজা ইত্যাদির নমুনা আজও দেখা যায়। এ ধরনের কাজকে বলা হয় হাসিয়া। বরিশালের কাঠের নৌকার কাজও বেশ নিপুণতার দাবি রাখে।
শীতল পাটি
প্রচণ্ড গরমে শীতল পাটিতে শরীর পেতে দিয়ে মরার মত ঘুমাতে কে না ভালবাসে? সিলেটের শীতলপাটি খুলনার মাদুরের কথা কে না শুনেছে। শুধু গরমের আরামের জন্যই নয়, শীতলপাটির নকশা একটি মৌলিক শিল্পের পরিচায়ক। অতীতে শীতলপাটির অনেক কারিগর ছিল। বর্তমানে তাদের সংখ্যা অনেক কমে এসেছে। ঢাকার নবাব পরিবার এককালে হাতির দাঁতের শীতলপাটি ব্যবহার করত যা বর্তমানে বাংলাদেশ কুটিরশিল্প ও লোকশিল্প জাদুঘরে শোভা পাচ্ছে।
তামা কাঁসার শিল্প
এখন গ্রামীণ এলাকায় তামা ও কাঁসার বাসনপত্র ব্যবহার করেন। এমন নয় যে এগুলো শহর থেকে কেনা। তামা কাঁসার এই তৈজসপত্র গ্রাম্য কারিগরেরাই তৈরি করতেন। প্রথমে মাটির ছাঁচ করে তার মধ্যে ঢেলে দেয় গলিত কাঁসা। ধীরে ধীরে এ গলিত ধাতু ঠান্ডা হয়ে আসে। তখন ওপর থেকে মাটির ছাঁচটি ভেঙে ফেললেই ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে বদনা, বাটি, গ্লাস, থালা ইত্যাদি। এরপর এগুলোকে পালিশ করে নানা রকমের ডিজাইন আঁকা হয়।
অন্যান্য
ইদানিং শহর এলাকায় অনেকে শিকা, হাতপাখা, ফুলপিঠা ইত্যাদি ব্যবহার করেন। এদের বিচিত্র নকশা, রং এবং কারিগরি সৌন্দর্যের যে নিদর্শন চোখে পড়ে তা শুধু আমাদের অতি আপন বস্ত্তই নয়, সৌন্দর্যের দিক দিয়েও এদের স্থান বহু উচ্চে। সাধারণ সামগ্রী হলেও যাঁরা এগুলো তৈরি করেন তাঁদের সৌন্দর্য প্রিয়তার প্রকাশ ঘটে এসব জিনিসের মধ্য দিয়ে। অনেক আধুনিক বাসা বাড়িতে প্রায়ই রঙ বেরঙের শিকার ব্যবহার দেখা যায়।
বাঁশ এবং সোলা দ্বারা অনেক শৌখিন দ্রব্যাদি তৈরি হয়। অনেক বাড়িতে বেতের আসবাবপত্র ব্যবহৃত হয়। কাপড় দিয়ে তৈরি পুতুল, প্রতীকধর্মী মাটির টেপা পুতুল আমাদের শিশুদের অত্যন্ত প্রিয়।
আমাদের দেশ, আমাদের ঐতিহ্য আমাদেরই রক্ষা করতে হবে। বাংলাদেশের বিশাল একটি জনগোষ্ঠী বেকার। কিংবা যারা কারিগর তারা উপযুক্ত মুল্য, সুযোগ সুবিধা এবং সম্মানের অভাবে এই শিল্পকে ধরে রাখতে পারছেন না। সুপরিকল্পিত উপায়ে এবং সুরুচিপূর্ণ লোকশিল্প প্রস্ত্ততির দিকে মনোযোগ দিলে তাদের সমস্যার কিছুটা সমাধান হবে। লোকশিল্পের সম্প্রসারণের দায়িত্ব আমাদের সকলের।
সরকারের বিসিক প্রতিষ্ঠানটি লোকশিল্প ও কুটির শিল্পের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। শুধু তাই নয় তারা যুব প্রশিক্ষণের উদ্যোগও নিয়েছে।
ঢাকার মতিঝিলে অবস্থিত বিসিক প্রধান কার্যালয(বিসিকভবন)এ বিসিকের একটি সমৃদ্ধ ও আধুনিক নকশা কেন্দ্র রয়েছে। সেখান থেকে উদ্যোক্তাদেরকে বিভিন্ন পণ্যের নকশা সরবরাহের পাশাপাশি বিভিন্ন ট্রেডে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়ে থাকে। প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রসমূহ হচেছ :
ব্লক ও বাটিক প্রিন্টিং , পুতুল তৈরী , মৃৎ শিল্প, চামড়ার কাজ , বাঁশ-বেতের কাজ , ধাতব শিল্প, কাঠের কাজ , পাটজাত হস্তশিল্প ,প্যাকজিং ইত্যাদি।