সুন্দরবনে বাঘের বাস
দাড়টানা ভৈরব পাশ
সবুজ শ্যামলে ভরা
নদী বাঁকে বসতো যে হাট
তার নাম বাগের হাট।
বাগেরহাট! উত্তরে তার গোপালগঞ্জ ও নড়াইল,পশ্চিমে খুলনা, পূর্বে পিরোজপুর আর বরগুনা আর দক্ষিণে বিশাল বঙ্গোপসাগর। জেলাটির আয়তন ৫৮৮২.১৮ বর্গ কিলোমিটার। এর মাঝে ১৮৩৪.৭৪ বর্গ কিলোমিটারই সবুজে ঘেরা বনাঞ্চল। জলাশয় রয়েছে ৪০৫.৩ বর্গ কিলোমিটার। বাদ বাকি যা থাকে সেখানেই এ জেলার ১৫-১৬ লাখ মানুষের বসবাস।
বাগেরহাটের রয়েছে ৯ টি উপজেলা। কচুয়া, চিতলমারী, ফকিরহাট, বাগেরহাট সদর, মোংলা, মোড়েলগঞ্জ, মোল্লাহাট, রামপাল, শরণখোলা। প্রাকৃতিক এবং মানব সৃষ্ট বহু দৃষ্টিননন্দন স্থানের লীলাভূমি এই বাগেরহাট। আজ আমরা সংক্ষেপে সেসব বিষয়েই জানব।
ষাট গম্বুজ মসজিদ
বাগেরহাটের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত এক সুপ্রাচীন মসজিদ এটি। এ মসজিদের গায়ে কোন শিলালিপি নেই। তাই মসজিদটি কত সালে নির্মিত বা, কে নির্মাণ করেছিলেন তা নিশ্চয়তার সাথে বলা যায় না। তবে স্থাপত্যশৈলি দেখে বিশেষজ্ঞরা মোটামুটি নিশ্চিত যে এটি খান-ই-জাহান নির্মাণ করেছিলেন। ১৯৮৩ সালে ইউনেস্কো এই মসজিদটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের মর্যাদা দেয়। শুনলে অবাক হবেন যে, বাগেরহাট শহরটিই বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের মর্যাদা প্রাপ্ত একটি শহর।
সুন্দরবন
সুন্দরবন শুধু বাংলাদেশের নয় সারা পৃথিবীর প্রাকৃতিক বিস্ময়ের একটি। যে ৫ টি জেলা এই সুন্দরবনের ভাগ পেয়েছে তার মাঝে বাগেরহাট অন্যতম। ১৯৯৭ সালে এই সুন্দরবন ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্থান লাভ করে। এখানেই দেখতে পাওয়া যায় বিশ্বের বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগারের। এছাড়াও রয়েছে নানা ধরনের পাখি, চিত্রা হরিণ, কুমির, সপ সহ অসংখ্য প্রজাতির প্রাণী। সূত্র অনুসারে এখানে ৫,০০ বাঘ রয়েছে, আর চিত্রা হরিণের সংখ্যা প্রায় ৩০,০০০!
খান জাহান আলীর মাজার
হযরত খানজাহান আলী (র.) ছিলেন একজন মুসলিম ধর্ম প্রচারক। তাকে খান-ই-আজমও বলা হত। তার মাজারের গায়ের শিলালিপি থেকে তার কিছুটা পরিচয় পাওয়া যায়। কিন্তু তার বিস্তারিত পরিচয় আজও জানা যায়নি। খাঞ্জেলী দীঘির উত্তর পাড়ে এক উঁচু ভূমিত তার সমাধি সৌধ রয়েছে। এই সৌধটি বর্গাকার। এর দৈর্ঘ্য ৪২ ফুট। প্রাচীরের উচ্চতা ২৫ ফুট। ছাদে একটি গম্বুজও রয়েছে। এই সমাধির সৌধের ভেতরে পাথরের তৈরি এক বেদীতে তার মাজার রয়েছে। সৌধটির স্থাপত্যশিল্প অনেকতাই ষাট গম্বুজ মসজিদের ন্যায়। শিলালিপিতে তার মৃত্যু আর দাফন তারিখ লিপিবদ্ধ রয়েছে। এছাড়াও কুরআন শরীফের কয়েকটি সূরাও লিপিবদ্ধ রয়েছে এতে। এ শিলালিপিতে লেখা রয়েছে যে, তার উপর আল্লাহর শান্তি বর্ষিত হোক। প্রতিদিন দেশ-বিদেশের হাজার হাজার লোক এ মাজার জিয়ারত করতে আসেন।
মংলা বন্দর
বাগেরহাটে অবস্থিত মংলা বন্দর বাংলাদেশের ২য় বৃহত্তম বন্দর। বন্দরটি ১ ডিসেম্বর, ১৯৫০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। বিশ্বের প্রায় সকল প্রধান বন্দরের সাথে মংলা বন্দরের সংযোগ আছে। যদিও এখানে বেশিরভাগ জাহাজ এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকা থেকে এসে থাকে। মাঝে মাঝে কিছু জাহাজ লাতিন আমেরিকা বা, আফ্রিকার দেশগুলো থেকেও এসে থাকে।
বর্তমানে বন্দরটি ২৪ ঘন্টা খোলা থাকে। পণ্য খালাসের জন্য ২২৫ মিটার পর্যন্ত লম্বা জাহাজও এই বন্দরে প্রবেশ করতে পারে। বন্দরে ১১ টি জেটি, পণ্য বোঝাই ও খালাসের জন্য ৭ টি শেড এবং ৮ টি ওয়্যারহাউজও রয়েছে। নদীর আরো গভীরে রয়েছে ১২ টি ভাসমান নোঙ্গরস্থান।
খাঞ্জেলী দীঘি
হযরত খান জাহান আলী (রঃ) এর মাজারের দক্ষিণদিকে প্রায় ২০০ বিঘা জমি জুড়ে এই দীঘি বিস্তৃত। দীঘির প্রধান ঘাটটি বেশ প্রশস্ত এবং সুন্দর। মহিলাদের জন্য আলাদা ঘাটেরও ব্যবস্থা রয়েছে। এ দীঘিতে কালা পাহাড় এবং ধলা পাহাড় নামের কুমিরের বংশধররা আজও জীবিত। এদের ডাকলেও এরা সারা দিয়ে কাছে আসে। দীঘির পানি বেশ সুপেয়। অনেকেই আছেন যারা তাদের রোগ বালাই থেকে আরোগ্য লাভের জন্য এ দীঘির পানি পান করে থাকেন এবং এই দীঘিতে গোসল করে থাকেন।
বাগেরহাট জাদুঘর
বাগেরহাটের আগের নাম ছিল খলিফাতাবাদ। পঞ্চদশ শতকে গড়ে ওঠা এ খলিফাতাবাদ শহরের প্রাচীন ইতিহাস এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ এবং সবার সামনে তুলে ধরার জন্য ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশ সরকার এবং ইউনেস্কোর যৌথ উদ্দ্যোগে ৫২০ বর্গ মিটার এলাকা জুড়ে এ জাদুঘর নির্মিত হয়। জাদুঘরটি উম্নুক্ত করা হয় ২০০১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে।
অযোধ্যা মঠ বা, কোদলা মঠ
পুরাতন বাগেরহাট-রুপসা সড়কে অবস্থিত বাজার যাত্রাপুর থেকে প্রায় ৪ কিলোমিটার দূরবর্তি প্রাচীন ভৈরব নদীর পূর্ব তীরে কোদলা গ্রামে এই অযোধ্যা মঠ অবস্থিত। এ মঠটি তলদেশে বর্গাকারে নির্মিত। মঠে ইটের তৈরি প্রাচীর দেখা যায়। এ প্রাচীরগুলো ৮ ফুট সারে ৭ ইঞ্চি প্রশস্ত। মঠে ব্যবহৃত ইটগুলো বেশ উচ্চ মানের এবং পালিশ করা। ইটগুলোর আয়তন ৬ ইঞ্চি x ৩ ইঞ্চি x ২ ইঞ্চি। ভূমি থেকে মঠটির উচ্চতা প্রায় ৬৪ ফুট ৬ ইঞ্চি। মঠে বিভিন্ন অলঙ্করণও রয়েছে। পোড়ামাটির এ অলঙ্করণগুলো বেশ সুন্দর। এর নির্মাণ সাল বা, নির্মাণকারীর পরিচয় সঠিকভাবে নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। মধ্যযুগে নির্মিত এই মন্দিরটি স্থাপত্যশিল্পের এক উজ্জ্বল নিদর্শন হিসেবেই বিবেচনা করা হয়।
রেজা খোদা মসজিদ
রেজা খোদা মসজিদের অপর নাম ছয় গম্বুজ মসজিদ। এটি বাগেরহাট জেলার সদর উপজেলায় অবস্থিত। খান জাহান আলীর মাজারের উত্তর পশ্চিম দিকে ঠাকুর দিঘির কাছে এর অবস্থান। মসজিদটির দেয়ালের কিছু অংশ বাদে প্রায় সম্পূর্ণ মসজিদটিই প্রায় ধ্বংশপ্রাপ্ত।
১৫ শতক জমির উপর এই মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছিল। মসজিদটির দেয়াল ছিল ১.৭৪ মিটার মোটা। আয়াতাকার মসজিদটির বাইরের দিক দৈর্ঘ্য এবং প্রস্থে ১৬.৫ মিটার X ১২.৪ মিটার ছিল। মসজিদের চার কোণায় চারটি অষ্টভুজাকৃতির বুরুজ ছিল। ধারণা করা হয় সেগুলো টেরাকোটার মোল্ডিং বন্ধনির দ্বারা অলঙ্কৃত করা ছিল। যদিও এসবের বেশিরভাগই ধ্বংশ হয়ে গেছে। এর তিনটি মেহরাবের কেন্দ্রীয় মেহরাবটি অন্য দুটির তুলনায় বেশ বড়। এই মসজিদটির ছয়টি গম্বুজ ছিল বলেই একে ছয় গম্বুজ মসজিদ নামেও ডাকা হয়। এর স্থাপত্য থেকে শুরু করে অলঙ্করণ পর্যন্ত খান জাহান আলীর সমাধির সাথে বেশ সাদৃশ্য রয়েছে।
এছাড়াও বাগেরহাটে আরো বেশ কিছু দর্শনীয় স্থান রয়েছে। যেমনঃ জিন্দা পীর মসজিদ, ঠান্ডা পীর মসজিদ, সিংগাইর মসজিদ, বিবি বেগুনী মসজিদ, চুনাখোলা মসজিদ, নয় গম্বুজ মসজিদ, রণবিজয়পুর মসজিদ, দশ গম্বুজ মসজিদ, সুন্দরবন রিসোর্ট (বারাকপুর), চন্দ্রমহল (রনজিতপুর) ইত্যাদি। বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত বাগেরহাটের সব দর্শনীয় স্থান সম্বন্ধে এই ছোট্ট কলেবরে আসলে বলা সম্ভবপর নয়। সেসব নিয়ে না হয় আরেকদিন লেখা যাবে। আজ এ পর্যন্তই। ধন্যবাদ।