‘প্যানডোরার বাক্স’ বা ‘Pandora’s box’; পাঠ্যবইয়ে, ইংরেজী ব্যাকরণে এই শব্দগুচ্ছ কখনো না কখনো প্রায় সবাই দেখে থাকবেন। এর অর্থ দেয়া ছিলো- ‘আপাতদৃষ্টিতে ভালো মনে হলেও খারাপ’। ইংরেজী সাহিত্যের এ ধরনের বেশির ভাগ শব্দগুচ্ছের জের টানলে গোড়াতে যা পাই তা হলো গ্রীক পুরাণ। এ ‘প্যানডোরার বাক্স’ও কিন্তু এসেছে গ্রীক পুরাণ থেকেই!
সবার আগে জেনে নিই কে ছিলেন এই প্যান্ডোরা, যার বাক্সের সাথে জড়িয়ে রয়েছে ভালো-মন্দের এই হেঁয়ালি?
ঈশ্বরের সৃষ্টি করা প্রথম মানবী, প্যান্ডোরা। পৃথিবীর সুখী স্বর্ণযুগের প্রথমে নাকি ছিলেন শুধু পুরুষেরা, একচ্ছত্র আধিপত্য নিয়ে। অলিম্পিয়ান দেবতা প্রমিথিউস গ্রীক পুরাণে ভাস্বর হয়ে আছেন মানবকল্যাণের জন্য। মানবজাতির প্রতি তার বড় পক্ষপাত ছিল, কখনো কখনো দেবতাদের চেয়েও বেশি! এদিকে আরেক দেবতা, জিউস, যাকে বহুক্ষেত্রেই লক্ষ্য করা যায় দেবতা প্রমিথিউসের প্রতিপক্ষ হিসেবে, তিনিই প্রথম সৃষ্টি করতে চাইলেন নারী। নারী সৃষ্টির পেছনে জিউসের কারণ ছিল মূলত প্রমিথিউসের বিরুদ্ধাচরণ। মানুষের প্রতি পক্ষপাত দেখাতে গিয়ে বহুবার জিউসকে প্রমিথিউস যে অপমান করেছেন, তার প্রতিশোধ নিতেই জিউসের এই পদক্ষেপ।
বিশ্বকর্মা হেফাস্টাসকে তলব করলেন জিউস। তার কাছে তিনি চাইলেন একটি কন্যা। হেফাস্টাস কাদামাটি থেকে তৈরি করলেন অপূর্ব মানবী, তাতে প্রাণসঞ্চারও করলেন। লজ্জাবতী কুমারীর অবয়বে এলেন সেই মানবী। দেবতারা তাকে নানা পোশাকে, নানা অলঙ্কারে মনমতো বিভূষিত করলেন। মানবীর মুখ ঘিরে ছিলো ঝকমকে ঘোমটা টানা, দেহে রুপোলি পোশাক, আর তার রূপের ছটা তো আছেই! কারুরই যেন চোখ সরছিলো না এই নবনির্মিত মানবীকে দেখে। তার গলায় দেয়া হলো বিশাল ফুলের মালা, মাথায় পরানো হলো কারুকার্যখচিত একটি সোনার মুকুট। দেবতাদের দেয়া বিভিন্ন উপহারে সজ্জিত এই নারীর নাম হলো ‘প্যানডোরা’, গ্রীক ভাষায় এর অর্থ ‘সকলের উপহার’। দেবতা জিউসের আকাঙ্খিত কন্যা প্যানডোরাকে দেখে বারবার মুগ্ধ হচ্ছিল দেবকূল ও মানবকূল।
‘প্যানডোরার বাক্স’ মিথটির একটি তত্ত্ব এটাও বলে যে, এ থেকে আমরা আমরা জানতে পারি পৃথিবীতে অশুভর উৎস কী ছিলো, কীভাবে পৃথিবী ক্রমেই জর্জরিত হয়েছে রোগ-জরা-ব্যাধি-দুঃখ-শোকে? এই প্রশ্নের উত্তরে গ্রীক পুরাণ দিয়েছে ‘প্যানডোরার বাক্স’। এই মিথের প্রথম বর্ণনা পাওয়া যায় গ্রীক লেখক হেসিওদের লেখা থেকে। তবে সেখানে এটিকে বড় একটি পাত্র বা ‘jar’ বলা হয়। কিন্তু ষোড়শ শতাব্দীতে এসে অনুবাদের ভুলের কারণে ‘jar’ হয়ে যায় ‘box’ এবং তখন থেকেই মানবজাতির কাছে এটি বিখ্যাত ‘প্যানডোরার বাক্স’।
জিউসের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী প্রমিথিউসের এক ভাই ছিলো, তার নাম ছিল এপিমিথিউস। তিনিও ছিলেন তার ভাইয়েরই মত সুদর্শন, দয়াবান ও মানবদরদী। জিউস তার কন্যার বিয়ে দিতে চাইলেন এই এপিমিথিউসের সাথে! কী আশ্চর্য! এ আবার কী ফন্দি আঁটলেন জিউস? দেখছি একটু পরেই।
এপিমিথিউস যতই দয়াবান হোন না কেন, জিউসকে চিনতে তার ভুল হয়নি। তিনি ঠিকই বুঝতে পারলেন এর পেছনে জিউস কিছু একটা অভিসন্ধি লুকিয়ে রাখছেন, হঠাৎ করে আত্মীয়তা করার ঝোঁক এমনিতেই চাপেনি! কিন্তু এখানে বাঁধ সাধলেন প্যানডোরা, সন্দেহ থাকা সত্ত্বেও প্রস্তাব অস্বীকার করতে পারলেন না এপিমিথিউস। প্রথম দেখাতেই প্যানডোরার প্রেমে পড়লেন এপিমিথিউস, প্রত্যাখ্যান করতে পারলেন না জিউসের প্রস্তাব। তৎক্ষণাৎ রাজি হয়ে গেলেন এপিমিথিউস। তারপর আর কী, দেবতার বিয়ে বলে কথা, তাও আবার প্রথম মানবীর সাথে! প্রচন্ড জাঁকজমকের সাথে, পুষ্পিত সৌরভে, মোহনীয় আলোতে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেন প্যানডোরা ও এপিমিথিউস। সকলের উপহার দিয়ে সজ্জিত প্যানডোরা এবার উপহার হয়ে চললেন এপিমিথিউসের গৃহে।
এদিকে জিউসের স্বভাব সম্পর্কে সচেতন প্রমিথিউস আগেই তার ভাইকে বলে দিয়েছেন জিউসের কাছ থেকে কোনো উপহার গ্রহণ না করতে। এপিমিথিউস তো কোনো উপহার নিলেন না, তবে আদরের কন্যা প্যানডোরাকে জিউস উপহার দিলেন একটি অদ্ভুত বাক্স যা পরবর্তীকালে পরিচিত হয়েছে ‘প্যানডোরার বাক্স’ নামে।
জিউসের উপহার দেয়া বাক্সটি ছিল সত্যিই খুব অদ্ভূত। অদ্ভুত এ কারণে যে তাতে লেখা ছিলো ‘কখনো খোলো না’, কিন্তু এর সাথে একটি চাবি দিয়ে দেয়া ছিলো! যদি তা কখনো খোলা বারণই ছিল, তবে তার সাথে চাবি দিয়ে দেয়া কেন? হয়তো এটিই ছিল জিউসের পরিকল্পনা। মানবজাতির একটি প্রবৃত্তির সাথে সবাই বেশ ওয়াকিবহাল, তা হলো ‘নিষিদ্ধ বস্তুর প্রতি আকর্ষণ’। যা করতে বারণ করা হয়, তা যেনো করা অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে! নিয়মকে ভাঙ্গাই যেনো একমাত্র নিয়ম পৃথিবীর। বাস্তবের সাথে গ্রীক মিথটিরও বেশ মিল দেখতে পাচ্ছি। জিউসও এই প্রবৃত্তি ভালোই বুঝেছিলেন এবং এই প্রবৃত্তিকেই সমগ্র মানবজাতির বিরুদ্ধে তিনি ব্যবহার করলেন প্যানডোরার মাধ্যমে।
বিয়ের পর প্যানডোরা-এপিমিথিউস দম্পতি বেশ সুখেই দিন কাটাচ্ছিলো। কিন্তু একদিন এর ব্যাত্যয় ঘটে, যা শুধু এই দম্পতির জন্যই নয়, অভিশাপ বয়ে আনে সমগ্র মানবজাতির ওপর।
একদিন এপিমিথিউস কোনো এক কাজে ঘরের বাইরে আছেন, প্যানডোরা তার বাক্সটিকে দেখছেন আর ভাবছেন খুলে ফেললে কীইবা হবে? বারবার ওর ইচ্ছে হচ্ছে বাক্সটির ভেতর কী আছে দেখতে, কিন্তু তার পিতা যে না করেছেন! না-ই যদি করলেন তবে চাবি দিয়েছেন কেন? প্যানডোরা কিছুতেই আর তার কৌতূহল দমন করতে পারলেন না, চাবি দিয়ে খুলেই ফেললেন বাক্সটির ডালা। তারপরেই বাক্সটি থেকে সমস্ত অশুভ শক্তি ঈর্ষা-ব্যাধি-ঘৃণা-জরা-শোক একের পর এক বের হতে থাকে। প্যানডোরা তাড়াতাড়ি ডালাটি বন্ধ করে ফেলেন, কিন্তু ততক্ষণে যে ভীষণ দেরি হয়ে গেছে! অশুভ আর খারাপ যা কিছু আছে তা ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে, মানুষের মনে-শরীরে। এপিমিথিউস এ সময় ঘরে ফিরে দেখলেন, প্যানডোরা কাঁদছেন। এরপর এপিমিথিউসকে দেখানোর জন্য প্যানডোরা আবার বাক্সটি খুললেন এবং তখন থেকে একটি উজ্জ্বল হাসি নিয়ে বেরুলো বাক্সের সবচেয়ে শুভতা, ‘আশা’। ‘আশা’ প্যানডোরাকে ধন্যবাদ জানালো তাকে মুক্ত করে দেয়ার জন্য এবং সেও চলে গেল মানুষের কাছে। এই আশাই মানবজাতিকে টিকিয়ে রেখেছে প্রাগৈতিহাসিককাল থেকে। সকল অশুভর মধ্যে একমাত্র আশাই রয়েছে যা বাঁচিয়ে রাখছে সকল শুভ সম্ভাবনাকে।
‘প্যানডোরার বাক্স’ মিথে মূলত নারী-চরিত্রের ‘কৌতূহল’ বিষয়টিতে আলোকপাত করা হয়েছে, এ কৌতূহলই জিউসকে সু্যোগ করে দিয়েছে চির অশুভকে দুয়ার খুলে দিতে।