জ্যোতিষশাস্ত্রে বিশ্বাস থাকুক আর না-ইবা থাকুক, আমাদের সকলেরই ভবিষ্যৎ জানার প্রতি রয়েছে কম-বেশি কৌতূহল। আধুনিক যুগে বসবাসকারী মানুষ হিসেবে এখন অনেকেরই এ বিষয়ে অনাগ্রহ থাকলেও এমন একটা সময় ছিল যখন দিনের প্রতিটি কাজই শুরু হতো জ্যোতিষশাস্ত্রের উপর নির্ভর করে।
ভবিষ্যৎ জানার লক্ষ্যে একসময় মানুষ কী না করেছে! বিভিন্ন গ্রহের অবস্থান থেকে শুরু করে হাতের রেখা গণনা, ট্যারো কার্ডস ইত্যাদি কোনো কিছুই বাদ রাখেনি মানুষ। শুধুমাত্র নিজের এবং পরিবারের শুভ-অশুভ জানার জন্যই মানুষের মধ্যে ছিল এত ব্যাকুলতা। তবে এতেও সন্তুষ্ট না হয়ে ভাগ্য জানার উদ্দেশ্যে এমন আরও কিছু পদ্ধতি মানুষ খুঁজে বের করেছে। এসবের ব্যবহার ও প্রয়োগবিধি যেমনই অদ্ভুত, তেমনই এর কার্যকারণ বের করা অনেকক্ষেত্রেই দুরূহ।
ভবিষ্যৎ জানার এমনই এক পদ্ধতি হলো ‘ট্যাসিওগ্রাফি’। কীভাবে শুরু হলো এই পদ্ধতি? কীভাবেই বা এটি কাজ করে? এসবের উত্তর দিয়েই ভবিষ্যৎ গণনার এ পদ্ধতি সম্পর্কে কিছুটা ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করছি।
আপাতদৃষ্টিতে পদ্ধতিটি বেশ সহজ-সরল মনে হলেও এটি অনুশীলন করে আয়ত্ত করাটা বেশ কঠিনই বটে। চীনারা প্রথম এর সার্থক প্রয়োগ শুরু করেন। আধুনিক ট্যাসিওগ্রাফিতে স্কটিশ ও আইরিশ সংস্কৃতির প্রভাব ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত হয়।
‘ট্যাসিওগ্রাফি’ শব্দটি এসেছে আরবি শব্দ ‘ট্যাসা’ থেকে যার অর্থ ‘চা’। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে গ্রিক ‘গ্রাফ’ শব্দটি, যার অর্থ ‘লিখন’। ফলে ট্যাসিওগ্রাফির পূর্ণাঙ্গ আক্ষরিক অর্থ দাঁড়ায় ‘চায়ের লিখন’। আরও একটু বিশদ ভাবে ব্যাখ্যা করে বলা যায়, কোনো ব্যক্তি চা পানের পর চা-পাতার প্যাটার্ন দেখে সেই ব্যক্তির ভাগ্য নিরূপণ করার পদ্ধতিকে বলা হয় ট্যাসিওগ্রাফি।
চীনারা সর্বপ্রথম এ পদ্ধতি ব্যবহার করলেও দ্রুত তা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। আনুমানিক সপ্তদশ শতক থেকে ইউরোপে ট্যাসিওগ্রাফি ভবিষ্যৎ কথন পদ্ধতি হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। সেসময় কেবল চা নয়, কফি কিংবা ওয়াইন পানের পর এর তলানি দেখেও শুরু হয় ট্যাসিওগ্রাফি। তবে চায়ের জনপ্রিয়তাই ছিল সর্বাধিক। ঐ সময় ইউরোপে চায়ের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার কারণে ট্যাসিওগ্রাফির মাধ্যমে ভবিষ্যৎ জানার আগ্রহ ইউরোপবাসীদের মধ্যে দ্রুত হারে বৃদ্ধি পায়। আর চীন থেকে আগত এই পানীয়কে ঘিরে ইউরোপীয়দের কৌতূহলও ছিল তখন তুঙ্গে।
ট্যাসিওগ্রাফিতে চায়ের কাপের একটি মস্ত ভূমিকা রয়েছে। সাধারণত বেশ খোলামেলা চায়ের কাপেই পড়ে থাকা চা-পাতার প্যাটার্ন সহজে ধরা পড়ে। চীনারা এই পদ্ধতিতে ভবিষ্যৎ ব্যক্ত করার জন্য প্রথম থেকেই হাতল ছাড়া বেশ বড় মাপের চায়ের কাপ ব্যবহার করতেন। পরবর্তীতে পড়ে থাকা চা-পাতার প্যাটার্ন থেকে ভাগ্য জানার পদ্ধতিকে সুগম করার জন্য তৈরি হতে শুরু করে বিচিত্র দর্শনের সব কাপ। কোনোটির ভিতরে জ্যোতিষ-চিহ্ন, কোনোটিতে রাশিচক্র আবার কোনোটিতে তাসের ছবি ছাপা হতে শুরু করে। তৈরি হতে থাকে ট্যাসিওগ্রাফির নিজস্ব চিহ্ন সম্বলিত কাপও।
এখন জানা যাক, পদ্ধতিটি অনুসরণ করে কীভাবে ভাগ্য গণনা করা হয়। এ পদ্ধতিতে কাজ করার জন্য একটি উপযুক্ত চায়ের কাপ নির্বাচন করা খুবই জরুরী। কাপ নির্বাচনের জন্য বিভিন্ন বিষয় লক্ষ্য রাখতে হয়। যেমন: চায়ের কাপ যেন বেশ চওড়া এবং ঢালু হয়। কাপের ভিতরের রঙ সাদা হওয়া বাঞ্চনীয়। ছোট, অগভীর চায়ের কাপ হলে কিংবা কাপের ভিতরের দিকে গাঢ় রঙ বা কোনো নকশা থাকলে চা পাতার প্যাটার্ন সহজে বোঝা যায় না বলে এ ধরনের চায়ের কাপ ভাগ্য গণনার কাজে ব্যবহৃত হয় না।
পদ্ধতির দ্বিতীয় ভাগে আসে উপযুক্ত চা-পাতা নির্বাচন করা। মিহি চা-পাতা ট্যাসিওগ্রাফির জন্য আদর্শ। বড় দানার চা-পাতা দিয়ে বা টি ব্যাগের মাধ্যমে সঠিকভাবে গণনা করা একটু কষ্টসাধ্য।
ভাগ্য গণনার এই কাজটি সঠিকভাবে সম্পাদন করার জন্য শান্ত, নিরিবিলি জায়গা বেছে নেয়া প্রয়োজন। মনঃসংযোগে বিঘ্ন যাতে না ঘটে এমন জায়গা নির্বাচন করতে হয়। প্রচুর বাতাস চলাচল করে, তীব্র শব্দ হয় কিংবা অন্ধকার জায়গা এ পদ্ধতির জন্য উপযুক্ত নয়। এ সময়টায় মোবাইল, টিভি, কম্পিউটার কিংবা ইলেকট্রিক ফ্যান বন্ধ রাখাই শ্রেয়। একটি ছোট চায়ের টেবিল এবং তার উপরে একটি টেবিল ক্লথ রাখা যেতে পারে। যার ভাগ্য গণনা করা হবে তাকে টেবিলের অপর পাশে রেখে শান্ত থাকার পরামর্শ দেয়া হয়।
পরের ধাপে যে ব্যক্তির ভাগ্য গণনা করা হবে তাকে যথারীতি চা পান করতে দেয়া হয়। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে ছোট চায়ের চামচের অগ্রভাগ অঞ্চলের সমপরিমাণ পানীয় যাতে কাপে থাকে।
চায়ের কাপ প্রস্তুত হলে এরপর ভাগ্য জানার লক্ষ্যে আগত ব্যক্তিকে প্রশ্ন করার জন্য প্রস্তুতি নিতে বলা হয়। এ সময় চায়ের কাপের হাতলটি প্রশ্নকর্তার মুখোমুখি রাখা হয়। তাকে চায়ের কাপটিকে বাম হাতে রেখে তিনবার বাম থেকে ডানে এবং উপর থেকে নিচে ঘুরিয়ে আবার যথাস্থানে রাখতে বলা হয়। এরপর এক থেকে সাত গুণতে যে সময় লাগে তার মধ্যে একটি প্রশ্ন ভাবতে বলা হয়। তখন জ্যোতিষী সেই কাপের মধ্যকার চা-পাতার অবস্থান গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন এবং সেই মোতাবেক প্রশ্নকর্তার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে থাকেন।
এই পড়ে থাকা চা-পাতার চিহ্নের ব্যাপারটাও কিন্তু বেশ গোলমেলে। পড়ে থাকা চা-পাতার প্যাটার্ন কখনো সাপের মতো, কখনো পাহাড়ের মতো, কখনোবা তার মধ্যে দেখা যায় অন্য কোনো জন্তুর ছায়া। এর প্রত্যেকটিই এক একটি ট্যাসিওগ্রাফির প্রতীক। এদের প্রত্যেকেরই কিন্তু আলাদা আলাদা অর্থ রয়েছে। সাধারণ মানুষের পক্ষে যা বোঝা বেশ দুরূহ।
কিন্তু সবচেয়ে অদ্ভুত ও মজার ব্যাপার হলো, সপ্তদশ শতক পার হয়েছে বহু আগে। অষ্টাদশ, ঊনবিংশ, বিংশ শতাব্দী পার হয়ে আমরা একবিংশ শতাব্দী অতিক্রম করছি। তা সত্ত্বেও আজ অবধি ট্যাসিওগ্রাফি নিয়ে পশ্চিমের কৌতূহল মোটেও কমেনি। এ প্রসঙ্গে মজার একটি তথ্য জানাই আপনাদের। স্বনামধন্য লেখিকা জে কে রাওলিং তার বিখ্যাত উপন্যাস ‘হ্যারি পটার’ সিরিজে ট্যাসিওগ্রাফির ব্যবহার দেখিয়েছেন। গোটা সিরিজ জুড়ে লেখিকা মজার ছলে এই ট্যাসিওগ্রাফিকে উপস্থাপন করেছেন। লেখিকার যে এই পদ্ধতিতে ভাগ্য গণনায় একেবারেই বিশ্বাস ছিল না, এ গল্পের মাধ্যমে তা প্রকাশ পায়।
মানুষ আগামীকে জানতে চেয়েছে সভ্যতার জন্মলগ্ন থেকেই। শতাব্দীর পর কত শতাব্দী পার হয়েছে, তবু মানুষের জানার চেষ্টা আজ অবধি শেষ হয়নি। বরং ভবিষ্যৎ জানার কৌতূহল মানুষের মনের মধ্যে প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমান আধুনিক যান্ত্রিক সভ্যতার যুগেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। ইন্টারনেটের যুগে এসেও ট্যাসিওগ্রাফি জানা জ্যোতিষীরা বেশ রমরমিয়ে ব্যবসা করছেন। এখনকার জ্যোতিষদের মতে, ট্যারো বা সাধারণ জ্যোতিষচর্চার চাইতেও নাকি অনেক বেশি কার্যকর এই চা-পাতার পাঠ। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, তাদের মতে কোনো হস্তরেখা বা কোষ্ঠী নয়, শুধু এক কাপ চা-ই বলে দেবে আপনার ভাগ্য!