কয়েক হাজার অক্ষরের বিন্যাসে লেখা ইতিহাসের বইটা যতটা নীরস লাগে, মূল ইতিহাস কিন্তু ততোটা রসহীন হয় না। প্রতিটি ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে থাকে অজস্র উত্থান-পতন, রক্তপাত, দুর্বিষহ বাস্তবতা। “বখতিয়ার খিলজী ১২০৪ সালে মাত্র ১৭ জন অশ্বারোহী সেনা নিয়ে নদীয়ার রাজা লক্ষণ সেনকে পরাজিত করে বাংলা জয় করেন”- ইতিহাসের বইয়ের এই লাইনটি নিশ্চয় সবার ঝাড়া মুখস্ত রয়েছে? যদিও এর আগের বা পরের কোনো কিছুই আমাদের ঠিকমতো জানা নেই। চলুন জেনে নেয়া যাক সেই বখতিয়ার খিলজী আর তার দুর্ধর্ষ অভিযানের কথা।
খ্রিষ্টীয় ত্রয়োদশ শতকের গোড়ার কথা। তখন বাংলায় রাজত্ব করতেন সেন বংশের রাজা লক্ষণ সেন। তিনি নদীয়ায় বাস করতেন। একদিন তার দরবারের পন্ডিতরা তাকে বললেন যে, তাদের প্রাচীন গ্রন্থে লিখিত আছে, বাংলা তুর্কীদের দখলে যাবে। ততদিনে সমগ্র উত্তর ভারত তুর্কীরা অধিকার করেছে এবং বখতিয়ার খিলজী বিহার জয় করেছেন।
রাজা ব্রাহ্মণ পন্ডিতদের কাছে জানতে চাইলেন প্রাচীন গ্রন্থে বাংলা আক্রমণকারীর দেহাবয়ব সম্পর্কে কোনো ইঙ্গিত আছে কিনা। জবাবে পন্ডিতগণ জানান, যে তুর্কী বাংলা জয় করবেন, তিনি আকৃতিতে খাটো এবং দেখতে কুৎসিত হবেন, তার হাতগুলো হাঁটু পর্যন্ত লম্বা হবে। বিশ্বস্ত লোক পাঠিয়ে রাজা লক্ষণ সেন নিশ্চিত হন যে, বিহারজয়ী বখতিয়ার খিলজীর সাথে উক্ত বিবরণগুলি মিলে যায়। তুর্কী আক্রমণ এক প্রকার অত্যাসন্ন বুঝেও লক্ষণ সেন তা আমলে নেন নি। ব্রাহ্মণ পন্ডিতগণ রাজার অনুমতি ছাড়াই নদীয়া ছেড়ে চলে যান।
ঐতিহাসিক মিনহাজ-ই-সিরাজ তার ‘তবকাত-ই-নাসিরি’ গ্রন্থে উপরোক্ত তথ্যটি প্রকাশ করেন। ঘটনাটি সত্যিই ঘটেছিলো কিনা তা জোর দিয়ে বলার উপায় নেই। কিন্তু তার অনতিকাল পরেই বখতিয়ার খিলজী নদীয়া আক্রমণ করেন এবং বাংলায় মুসলিম শাসন সাম্রাজ্য স্থাপন করেন।
উপমহাদেশে মুসলিম সাম্রাজ্য বিস্তারের তিনটি স্তর দেখা যায়। প্রথমত, আরবগণ মুহাম্মদ বিন কাসিমের নেতৃত্বে ৭১২ খ্রিস্টাব্দে সিন্ধু ও মুলতান জয় করে। দ্বিতীয় পর্যায়ে তুর্কী সুলতান আমীর সবুক্তগীন ও তার পুত্র সুলতান মাহমুদ দশম শতাব্দীর শেষ দিকে বারবার উপমহাদেশ আক্রমণ করে লাহোর পরিবেষ্টিত এলাকা স্বীয় গজনী রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন। তৃতীয় পর্যায়েও তুর্কীরাই আক্রমণ পরিচালনা করে। এইবার নেতৃত্ব দেন মুহাম্মদ ঘুরী। এবারের আক্রমণে তুর্কীরা দিল্লীকে কেন্দ্র করে উপমহাদেশে স্থায়ী মুসলিম সাম্যাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। বখতিয়ার খিলজীর বাংলা আক্রমণ এই তৃতীয় পর্যায়ের আক্রমণেরই অংশ।
ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজী আফগানিস্তানের গরমশির এলাকার অধিবাসী ছিলেন। তিনি তুর্কীদের খিলজী সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন। তার বাল্যজীবন সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। তবে মনে করা হয় যে, তিনি দারিদ্রের নিষ্পেষণে স্বদেশ পরিত্যাগ করে জীবিকার সন্ধানে বের হন। মুহাম্মদ ঘুরী তখন ভারতীয় উপমহাদেশে অভিযান চালাচ্ছিলেন। বখতিয়ার, ঘুরীর সৈন্যদলে চাকুরীপ্রার্থী হয়ে ব্যর্থ হন। তখন নিয়ম ছিলো, প্রত্যেক সৈন্যকে নিজ ঘোড়া ও যুদ্ধাস্ত্রের ব্যবস্থা নিজেকেই করতে হতো। সামর্থ্যের অভাবে বখতিয়ার ঘোড়া বা ঢাল-তলোয়ার কিছুই যোগাড় করতে পারেননি। তাছাড়া খাটো দেহ, লম্বা হাত ও কুৎসিত চেহারার বখতিয়ার খিলজী সেনাধক্ষ্যের দৃষ্টিও আকর্ষণ করতে পারেননি।
গজনীতে ব্যর্থ হয়ে বখতিয়ার দিল্লীর সম্রাট কুতুবউদ্দিন আইবেকের কাছে আসেন এবং সেখানেও ব্যর্থ হন। অতঃপর বখতিয়ার পূর্বদিকে অগ্রসর হয়ে বদাউনে গিয়ে পৌঁছেন। বদাউনের শাসনকর্তা মালিক হিজবর-উদ-দীন তাকে নগদ বেতনে চাকুরীতে রাখেন, তবে এমন চাকুরীতে বখতিয়ার সন্তুষ্ট ছিলেন না। কিছুদিন কাজ করার পর তিনি অযোধ্যায় চলে যান। অযোধ্যার শাসক হুসাম-উদ-দীন বখতিয়ারের প্রতিভা অনুধাবন করেন এবং তাকে ভিউলী ও ভগত নামে দু’টি পরগনার জায়গীর প্রদান করে মুসলিম রাজ্যের পূর্বসীমান্তে সীমান্তরক্ষীর কাজে নিযুক্ত করেন। এখানে বখতিয়ার তার ভবিষ্যৎ উন্নতির সম্ভাবনা দেখতে পান।
বখতিয়ারের জায়গীর সীমান্তে অবস্থিত হওয়ায় তিনি পার্শ্ববর্তী হিন্দু রাজ্যগুলির সংস্পর্শে আসেন এবং স্বীয় রাজ্য বিস্তারের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। পার্শ্ববর্তী হিন্দু রাজ্যগুলিতে পূর্বে থেকেই তুর্কী আক্রমণের আতঙ্ক লেগে ছিলো। তার উপরে পারষ্পারিক অন্তর্বিরোধ লেগে থাকাতে সংঘবদ্ধ হওয়া তাদের জন্য সম্ভব ছিল না। বখতিয়ার খিলজীর জন্যে এটা ছিল উপযুক্ত সুযোগ। তিনি কিছু সৈন্য সংগ্রহ করে এক এক করে হিন্দু রাজ্য আক্রমণ ও লুট করতে থাকেন। এই সময় ঠিক রাজ্য বিস্তার করা তার উদ্দেশ্য ছিল না, বরং ধন-সম্পদ হস্তগত করে একটি বিরাট সৈন্যবাহিনী গঠন করে বড় একটা কিছু করাই তার পরিকল্পনা ছিল। ধীরে ধীরে তার নাম ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলে চারিদিক থেকে ভাগ্যান্বেষী মুসলিমরা, বিশেষ করে বখতিয়ারের স্বীয় খিলজী সম্প্রদায়ভুক্ত লোকজন এসে তার সাথে যোগ দিতে থাকে।
এইভাবে অগ্রসর হবার সময় একদিন তিনি প্রাচীরবেষ্টিত দুর্গের ন্যায় একটি স্থানে এসে উপস্থিত হন। সেখানেও স্বভাবসুলভ চড়াও হয়ে তিনি এর বহু অধিবাসী হত্যা করেন এবং কোনো বাধা ছাড়াই জায়গাটি দখল করে নেন। সেখানকার অধিবাসিরা সকলেই ছিল মুন্ডিত মস্তক, এরা ছিল বৌদ্ধ ভিক্ষু এবং স্থানটি ছিল বই-পুস্তকে পরিপূর্ণ। জিজ্ঞাসাবাদ করে তিনি জানতে পারেন সেটি কোনো দুর্গ নয়, বৌদ্ধবিহার। বিহারটির নাম ওদন্তপুরী বিহার। ঐ সময় থেকে মুসলিমরা জায়গাটির নাম দিলেন বিহার বা বিহার শরীফ। জায়গাটি সেই নামেই এখনও পরিচিত। এভাবেই বিহার জয় করে নেন বখতিয়ার খিলজী। বিহারে এখনও বখতিয়ারপুর নামে একটি জায়গা আছে। এছাড়া এই লাগামহীন বিজয়ের পথে বখতিয়ার ঐতিহাসিক নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ও ধ্বংস করেন।
এর পরের বছর আরও বিপুল সংখ্যক সৈন্য নিয়ে বখতিয়ার নদীয়া আক্রমণ করেন। তিনি এতোই ক্ষিপ্রতার সাথে ঘোড়া চালনা করেন যে, তার সাথে মাত্র ১৮ জন সেনা আসতে পেরেছিলো। আমাদের দেশে প্রবাদ আছে যে, ১৭ জন অশ্বারোহী বাংলা জয় করেন। কথাটি সম্পূর্ণ সঠিক নয়। ঐতিহাসিক মিনহাজ সুস্পষ্টভাবে বলেন, বখতিয়ার খিলজী ১৮ জন অশ্বারোহী নিয়ে নদীয়া পৌঁছেন এবং তার মূল বাহিনী পেছনে আসছিল।
রাজা লক্ষণ সেনের রাজধানী ছিল ঢাকার বিক্রমপুরে। তিনি বৃদ্ধ বয়সে গঙ্গাপাড়ের পবিত্র তীর্থস্থান নদীয়ায় বাস করছিলেন। তিনি একজন সাহসী যোদ্ধা এবং সুশাসক ছিলেন। নিজ রাজ্য রক্ষার কোনো পূর্ব প্রস্তুতি তিনি নেন নি এমনটা ধরা যায় না। ঐতিহাসিকগণ মনে করেন, তিনি রাজ্যের মূল প্রবেশপথ তেলিয়াগড় গিরিপথে প্রহরার ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু সুকৌশলী বখতিয়ার খিলজী সেই পথে না গিয়ে দক্ষিণ দিকের জঙ্গলাকীর্ণ এলাকা ঝাড়খন্ডের মধ্যে দিয়ে অগ্রসর হন।
তিনি তার বাহিনীকে ছোট ছোট দলে ভাগ করেন এবং নিজে এরকম একটি দলের অগ্রভাগে ছিলেন। ফলে যখন তিনি নদীয়া পৌঁছেন, কেউ ভাবতেও পারেননি যে তুর্কী বীর বখতিয়ার খিলজী বাংলা জয় করতে এসেছেন। সবাই তাকে সাধারণ ঘোড়া ব্যবসায়ী ধরে নেয়। খিলজী সোজা রাজা লক্ষণ সেনের প্রাসাদদ্বারে উপস্থিত হন এবং দ্বাররক্ষীদের হত্যা করেন। রাজা তখন মধ্যাহ্নভোজে লিপ্ত ছিলেন। খবর শুনে তিনি নগ্নপদে প্রাসাদের পশ্চাৎদ্বার দিয়ে পলায়ন করেন এবং বিক্রমপুরে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করেন।
বখতিয়ার খিলজী ৩ দিন যাবৎ নদীয়া লুটপাট করেন। লক্ষণ সেনের বিপুল ধন-সম্পদ, ভৃত্যবর্গ ও অনেক হস্তী তার হস্তগত হয়। প্রায় বিনা যুদ্ধেই বখতিয়ার নদীয়া জয় করে নেন। মনে রাখতে হবে, তিনি সমগ্র বাংলা জয় করেননি, বাংলার একটি অংশ জয় করেছিলেন মাত্র। তিনি নতুন জয় করা রাজ্যের নাম রাখেন ‘লখনৌতি’।
নবপ্রতিষ্ঠিত রাজ্যে তিনি সুশাসনের ব্যবস্থা করেন। তার সাথে অভিযানে সময় এবং পরবর্তীতে যেসব মুসলিম সেখানে বসবাসের জন্য আসেন, তাদের জন্য তিনি মসজিদ, মাদ্রাসা ও খানকাহ নির্মাণ করেন। তিনি জানতেন, শুধু সামরিক শক্তির উপরেই একটি রাজ্যের প্রতিরক্ষা নির্ভর করে না, পরিপূর্ণ শান্তির জন্য চাই অভ্যন্তরীন শৃঙ্খলা। আর তাই তার প্রতিষ্ঠিত মুসলিম রাজ্যের স্থায়ীত্ব বিধানে তিনি সুষ্ঠু মুসলিম সমাজ তৈরির প্রয়াস নেন।
হিন্দু ও বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের কাছে বখতিয়ার খিলজী শুধুই একজন খুনী, লুটেরার নাম। তবে এটাও ঠিক, ইতিহাসের একটি অংশের ধ্বংস তার হাতে এবং আরেকটি অংশের সৃষ্টি তার হাতে। তার আমলে ভারতবর্ষে বিপুল পরিমাণ মানুষ ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়। বাংলাদেশের খ্যাতিমান কবি আল মাহমুদ তার ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’ কাব্যগ্রন্থে বখতিয়ার খিলজীকে একজন প্রশংসনীয় বীর হিসেবে চিত্রায়িত করেছেন। যদিও এই দুর্ধর্ষ বীরের পরিসমাপ্তি সুখকর হয়নি। বাংলা বিজয়ের অনতিকাল পরে তিনি তিব্বত আক্রমনে বের হন। এই অভিযানে তিনি শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হন এবং তার বিপুল সংখ্যক সেনা ধ্বংস হয়ে যায়। মানসিক ও শারীরিকভাবে বিপর্যস্ত অবস্থায় ১২০৬ সালে বখতিয়ার খিলজী ইহলোক ত্যাগ করেন।
তথ্যসূত্র
১) বাংলার ইতিহাসঃ সুলতানী আমল- আবদুল করিম
২) en.wikipedia.org/wiki/Muhammad_bin_Bakhtiyar_Khilji
৩) thetinyman.in/2012/09/bakhtiyar-khiljis-conquest-of-bengal.html