করুণাময় ও ইন্দিরা দাশগুপ্তের জমজমাট সংসারে ১৯৩১ সালের ৬ এপ্রিল যোগ হলো আরেকটি ছোট্ট সদস্য, মেজো মেয়ে কৃষ্ণা। গায়ের রঙ একটু চাপা বলে প্রথমে মেয়ের নাম রাখা হলো কৃষ্ণা, কিন্তু কে জানতো একদিন এই নামকে ছাড়িয়ে সে আরো নামের পর্দা চড়িয়ে সে নিজের সীমানাটুকুও অতিক্রম করবে?
নামটি দিয়েছিলেন কৃষ্ণার পিতামহ জগবন্ধু দাশগুপ্ত, নাম রাখার বেলায় যাকে মানা হতো পরিবারের হেড-অফিস! কিন্তু করুণাময়ও পিছিয়ে নন, সাধ করে মেয়ের আরেকটি নাম রাখলেন, ‘রমা’। ‘কৃষ্ণা’ নামের পর্দা ফেলে দিয়ে ‘রমা’ নামেই ক্রমশ বড় হলো মেয়েটি। এরই মধ্যে পাটনা থেকে বদলি হয়ে বাংলাদেশের পাবনায় চলে এসেছেন করুণাময় দাশগুপ্ত এবং পাবনাতেই কাটে সুচিত্রার শৈশব-কৈশোর।
কেমন যেন অধরা, ছিপছিপে শরীরে এক স্বতস্ফূর্ত স্বভাব তার। তার গতির সাথে কেউ এঁটে উঠতে পারে না, সবাইকে দূরে ফেলে ছুটে যাওয়াতেই যেন তার তৃপ্তি। সবসময় একটু দূরে, সে যতই কারো কাছে থাকুক না কেন, তাকে ঠিকই দূর থেকে স্পষ্টভাবে আলাদা করা যাবে। যখন তখন হারিয়ে যাওয়া ইছামতীর চরে কাশের অরণ্যে! নিঃসঙ্গতার সুবাস পেতে সে যায় জামরুলবাগানে, তার হঠাৎ করে যে একা হয়ে যেতে ভালো লাগে! হ্যাঁ, এভাবেই বেড়ে উঠছিলো রমা। তার নিজের মতন করে। হয়তো এ এক ঝলমলে ভবিষ্যতেরই পূর্বাভাস ছিলো।
১৯৪৭ সাল। সতেরো বছর বয়সে ফ্রক ছাড়তে না ছাড়তেই বিয়ের বাদ্যি বাজলো রমার। পুরীতে বাবা-মায়ের সাথে বেড়াতে গিয়েছিলেন। সেখানেই দিবানাথ সেনের ঠাকুমার চোখে ধরা পড়লেন রমা। এরপর দিবানাথের পিতা ব্যারিস্টার আদিনাথ সেন যখন প্রথম দেখলেন তাকে, তখনই ঘরের বউ করে তুলে নিতে চাইলেন। ইচ্ছা বা অনিচ্ছা কোনোটাই দেখাননি বিয়ের ব্যাপারে, এ যেন একটা কাজ যেটা তাকে করতে হতো, তাই করলেন।
বিয়ের পর একা রমা আরো বেশি একা হয়ে পড়েন নতুন পরিবেশে এবং এই একাকীত্বই একসময় তার অভিনয় জগতে প্রবেশের ইন্ধন হিসেবে কাজ করে। পাড়ার ক্লাবের ছেলেরা সুচিত্রাকে দেখে মুগ্ধ হয়ে তাকে নিতে চায় তাদের নাটকে। ‘নটীর পূজা’ নাটকে প্রথম অভিনয় করলেন এবং সেই খ্যাতি পৌঁছুলো টালিগঞ্জের স্টুডিও পাড়ায়। স্বামী ও শ্বশুরের উৎসাহেই সিনেমায় নামলেন রমা সেন।
প্রথমে নেপথ্য গায়িকা হবার জন্যই গেলেন স্টুডিওতে, কিন্তু এই রূপসীকে পর্দার পেছনে রাখার মতো ভুল করেননি রুপোলি পর্দার লোকেরা! বারবার রমা মুখ ফিরিয়ে নিলেও পরিচালকেরা একবার তার খোঁজ পেয়ে যাবার পর তাকে আর ছাড়েন কী করে? ১৯৫২ সালে প্রথম ছবি ‘শেষ কোথায়’ দিয়ে শুরু। কিন্তু কিছুদিন অভিনয়ের পর অর্থাভাবে তা বন্ধ হয়ে গেলো। কখনোই মুক্তি পেলো না।
এরপর সুকুমার দাশগুপ্তর ‘সাত নম্বর কয়েদী’ সিনেমা থেকে চলচ্চিত্রে নিয়মিত হলেন রমা। না, এখন আর রমা নয়, সুকুমার দাশগুপ্তর সহকারী নীতীশ রায় তার নাম দিলেন সুচিত্রা। রমার নবজন্ম ঘটলো ‘সুচিত্রা’ হয়ে, সিনেমার রূপোলি পর্দায়। এর পরের ছবি অর্থাৎ নীরেন লাহিড়ীর ‘কাজরী’ ছবির মাধ্যমে সালে রমা সেন পাল্টিয়ে ‘সুচিত্রা সেন’ নামে আত্মপ্রকাশ করেন তিনি
সুচিত্রার চলন-বলনের নিজস্ব স্টাইল যেন ক্রমেই অনুকরণীয় হয়ে উঠেছিলো সেকালের যুবতীদের কাছে। তার শাড়ি পরা বা চুল বাঁধার কেতা ছিলো পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে কলকাতা, ঢাকার বাঙ্গালি সমাজে আভিজাত্য এবং ফ্যাশনসচেতনতার প্রতীক।
তার অভিনীত বাংলা সিনেমা ৫২টি আর হিন্দিতে করেছেন মোট ৭টি সিনেমা। বাঙ্গালি চরিত্রের পাশাপাশি হিন্দি চলচ্চিত্রের পর্দাও কাঁপিয়েছেন তিনি। দর্শকরা তার সাথে “খোলি হাওয়ামে ডোলে, আজ মেরা মন বোলে, দিলকি বাহার লেকে আয়েগা সাওয়ারিয়া” গানের সুরেও মেতেছেন।
চরিত্রের সীমাবদ্ধতায় আটকে থাকেননি আর আটকে থাকতে পারেনি তার গ্ল্যামারও! যখনই যে চরিত্রে পর্দায় আসুন না কেন তিনি, চোখ আটকে যাবার মতন কিছু একটা সবসময়ই থেকে যেতো তার মধ্যে। সেটা ভক্তিরসে টইটুম্বুর ‘ভগবান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য’তে বিষ্ণুপ্রিয়া কিংবা ‘সপ্তপদী’তে আধুনিকা ‘রিনা ব্রাউন’ই হোন- সুচিত্রার জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েনি, তার গ্ল্যামার কিছুতেই লুকিয়ে থাকেনি।
সুচিত্রা সেনের নাম শুনলেই সাথে সাথে আরেকটি নাম স্মৃতির পর্দায় ভেসে ওঠে। উত্তম কুমার আর সুচিত্রা সেনের পর্দার রসায়ন কার না মন কেড়েছে! ১৯৫৪ সালের ২৬শে জুন থেকে শুরু করে বহু সিনেমায় একসাথে আবির্ভূত হলেও, ১৯৫৪ সালের ৩রা সেপ্টেম্বর পরিচালক অগ্রদূতের ‘অগ্নিপরীক্ষা’ সিনেমাটিতেই তাদের জুটি প্রথম সাফল্য পায়। টানা ১৫ সপ্তাহ হলে চলেছিলো এই সিনেমা। ইতিহাস সৃষ্টি করা এই সিনেমা উত্তম-সুচিত্রা জুটিতে সিনেমা জগতে প্রতিষ্ঠা দেয়ার পেছনে এই ছবিটিই প্রথম মাইলফলক স্থাপন করেছে।
রূপোলি পর্দার পাশাপাশি ব্যক্তিজীবনেও খুব কাছের ছিলেন তারা। উত্তম কুমারের মৃত্যু সুচিত্রার মনোজগতে এক আলোড়ন তুলেছিলো। ১৯৮০ সালের ২৪শে জুলাই হঠাৎ মারা গেলেন উত্তম কুমার। গভীর রাতে শহর যখন নীরব, সবাই যখন প্রিয় মহানায়ককে শেষ বিদায় জানিয়ে ঘরে ফিরে এসেছে, তখন নিভৃতে দেখা করতে গেলেন সুচিত্রা। ভবানীপুরে উত্তম কুমারের পৈতৃক বাড়িতে গিয়ে ছবিতে মালা পরিয়ে শেষ সাক্ষাৎটুকু করলেন। কেউ কেউ উত্তমের মৃত্যুকেও সুচিত্রার অন্তরালের কারণ বলে দাবি করেন। কিন্তু তিনি পুরোপুরি লোকচক্ষুর আড়ালে গিয়েছেন তার দীক্ষাগুরুর মৃত্যুর পর।
হিন্দি চলচ্চিত্রে তার ক্যারিয়ার সম্পর্কে বলতে গেলে সামনে আসে দু’টি নাম- ‘দেবদাস’ ও ‘আন্ধি’। অনেক নায়িকার স্বপ্নের চরিত্র ‘পার্বতী’ হয়ে দিলীপ কুমারের বিপরীতে তার মুগ্ধতাভরা অভিনয়ের প্রতিভা দেখিয়েছিলেন সুচিত্রা। আর তার অভিনয় ক্যারিয়ারের শেষ দিকে আসে ‘আন্ধি’, পরিচালনায় গুলজার। অনেকে মনে করেন ইন্দিরা গান্ধীকে মাথায় রেখে রাজনীতিবিদের চরিত্রটি সাজানো হয়েছিলো। এই চরিত্র বাস্তবায়নে বলিউডের কাউকে না নিয়ে বাংলার সুচিত্রা সেনকেই প্রথম পছন্দ বলে মনে হয় গুলজারের। এ ছবিতে তার বিপরীতে ছিলেন সঞ্জীব কুমার।
নিজের শর্তে পথ চলতেন, অভিনয় করতেন এই বহুল আলোচিত অভিনেত্রী। শোনা যায়, মহান পরিচালক সত্যজিত রায় একবার সুচিত্রাকে তার ‘দেবী চৌধুরানী’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের প্রস্তাব দেন, কিন্তু তারিখের সাথে মিলছিলো না বলে সুচিত্রা সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। অদ্ভুত ব্যাপার, ১৯৭৪ সালে দীনেন গুপ্তের পরিচালনায় এই ‘দেবী চৌধুরানী’ সিনেমায়ই প্রফুল্লমুখীর চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি। ঠিক এভাবেই রাজ কাপুরের ‘আর কে ফিল্মস’ এর ব্যানারে কাজ করার প্রস্তাবও সুচিত্রা কখনো গ্রহণ করেননি। তিনি কোথায় অভিনয় করবেন, কোন ব্যানারে তার নাম আসবে, তা শুধু তিনিই নির্ধারণ করতেন। তার সময়ের সবচেয়ে বেশি পারিশ্রমিক নিতেন তিনি। ‘সপ্তপদী’ সিনেমাটির কথাই ধরা যাক, তাতে সুচিত্রা সেনের পারিশ্রমিক ছিলো দু’লক্ষ টাকা, যা সেসময়ের যেকোনো অভিনেতার চাইতে বেশি।
১৯৬৩ সালে ‘সাত পাকে বাঁধা’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য মস্কো চলচ্চিত্র উৎসবে সুচিত্রা সেন ‘সিলভার প্রাইজ ফর বেস্ট অ্যাকট্রেস’ জয় করেন। তিনিই প্রথম ভারতীয় অভিনেত্রী যিনি কোনো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কৃত হয়েছিলেন। ১৯৭২ সালে ভারত সরকার তাকে পদ্মশ্রী সম্মান প্রদান করে।
২০০৫ সালে তাকে ‘দাদাসাহেব ফালকে পুরষ্কার’ দেবার কথা উঠলেও তিনি এই পুরষ্কার গ্রহণ করতে আরো একবার পেছনে ফেলে আসা ঐ চাকচিক্যের দুনিয়ায় পা ফেলতে চাননি। তিনি পুরষ্কারটি ঘরে পাঠিয়ে দিতে বলেছিলেন এবং স্পষ্টতই পুরষ্কারটি তিনি আর পাননি।
২০১৩ সালে বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ার পর আবার আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেন সুচিত্রা। এবং ২০১৪ সালের ১৭ জানুয়ারি ভারতীয় সময় সকাল ৮টা ২৫ মিনিট নাগাদ কলকাতার বেল ভিউ হাসপাতালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে সুচিত্রা সেনের মৃত্যু হয়।
বাঁকা ঠোঁটের হাসিতে যে কত তরুণের হৃদস্পন্দন বাড়িয়েছেন সুচিত্রা, তা এতো দিন পরও বাঙ্গালির মুখে মুখে ফেরে। সুচিত্রা ঘাড় ঘুরে তাকালে সময়ও কি একটু করে থমকে যেতো না? যেতো। পর্দায় সুচিত্রার চোখ টলমল করে উঠলে জল গড়াতো পর্দার এপারে। তার মুগ্ধতাকে আকণ্ঠ গ্রহণ করেছে দর্শকসমাজ। সুচিত্রা এক চিরসবুজ প্রেয়সী, যার বয়স ঐ পর্দার ছবিতেই আজো স্থির হয়ে আছেন।