বোমা, শব্দটা শুনলেই কেমন যেন একটা আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। মনে হয় যেন বিকট শব্দে কোনো কিছু বিস্ফোরিত হতে চলেছে। মুহূর্তেই ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে অনেক কিছু। হ্যাঁ, বোমা বস্তুটাই ধাতব পদার্থ দিয়ে তৈরি করা এক ধরনের বিস্ফোরক দ্রব্য, যা কিনা খুব দ্রুত গতিতে অভ্যন্তরীণ পদার্থের মধ্যে রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটিয়ে কম্পন তরঙ্গ তৈরি করার মাধ্যমে খুব সহজেই বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে এবং একই সাথে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতিও সাধন করতে পারে।
সম্প্রতি (১৩ই এপ্রিল, ২০১৭) পাকিস্তানের সীমান্তঘেঁষা আফগানিস্তানের নানগারহার প্রদেশের আচিন জেলায় আইএস (ISIS) জঙ্গিদের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত পার্বত্য অঞ্চলের এক গুহায় ‘মাদার অব অল বোম্বস’ নামে এক বোমা নিক্ষেপ করে যুক্তরাষ্ট্র। একে এখন পর্যন্ত ব্যবহার করা সবচেয়ে শক্তিশালী অপারমাণবিক বোমা হিসেবে দাবি করছে তারা।
গত ১৩ এপ্রিল বৃহস্পতিবার স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৭ টা ৩২ মিনিটে জিবিইউ-৪৩/বি ম্যাসিভ অরডিন্যান্স এয়ার ব্ল্যাস্ট বা এমওএবি (MOAB) নামে এই বোমাটি আইএস অধ্যুষিত পার্বত্য অঞ্চলে নিক্ষেপ করা হয়। এতে ৪ জন আইএস কমান্ডারসহ ৯৪ জন জঙ্গি নিহত হয়েছে বলে আফগান প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়।
পাকিস্তানি সীমান্তবর্তী এ স্থানে মাটির নিচে সুরক্ষিত সুড়ঙ্গ পথের নেটওয়ার্ক ছিল এই বোমার মূল লক্ষ্যবস্তু, যা ব্যবহার করে আইএস জঙ্গিরা আফগানিস্তানের সরকারি বাহিনীর ওপর হামলা চালিয়ে নিরাপদে পালিয়ে যেত। বোমাটি বিস্ফোরিত হবার পর সেখানকার তিনটি সুড়ঙ্গপথ ধ্বংস হয়ে যায় এবং এর সাথে সাথে সেখানে মজুতকৃত অস্ত্রশস্ত্র এবং গোলাবারুদও নষ্ট হয়।
আফগানিস্তানে মার্কিন বাহিনীর কমান্ডার জন নিকলসনের নির্দেশে এমসি-১৩০ নামক এক কার্গো বিমান থেকে এটি নিক্ষেপ করা হয়। সঠিক সময়ে সঠিক অস্ত্রের ব্যবহার হয়েছে এবং তাদের সিদ্ধান্তই সঠিক ছিল বলে মনে করছেন মার্কিন বাহিনীর এ কমান্ডার। এছাড়াও এ অঞ্চলে প্রায় ৬০০-৮০০ সক্রিয় আইএস জঙ্গি আছে বলে ধারণা করছেন তারা।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই বোমা হামলাকে সফল একটি মিশন বলে আখ্যায়িত করেছেন। তবে আফগানিস্তানের বর্তমান প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানাই এ হামলার সাথে একাত্মতা পোষণ করলেও সাবেক প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই আফগানিস্তানকে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নতুন এবং ভয়ঙ্কর অস্ত্রের পরীক্ষামূলক ক্ষেত্র বলে অভিযুক্ত করেছেন। এদিকে ‘আমাক নিউজ এজেন্সি’র (Amaq News Agency) বরাত দিয়ে আইএসের এক বিবৃতিতে বলা হয় নিহতদের মধ্যে কেউই এই জঙ্গি গোষ্ঠীর সদস্য নয়। আবার স্থানীয় একজন সাংসদ দাবি করেছেন যে, বিস্ফোরণের ফলে সে অঞ্চলের একজন শিক্ষক এবং তার পুত্র নিহত হয়েছেন। অপর দিকে আফগান এবং মার্কিন কর্মকর্তারা দাবি করছেন এ হামলার কারণে বেসামরিক একজন ব্যক্তিরও কোনো প্রকার ক্ষতি হয়নি।
কেমন ছিল ‘মাদার অব অল বোম্বস’ এর গঠন এবং ভয়াবহতা?
জিবিইউ-৪৩/বি ম্যাসিভ অরডিন্যান্স এয়ার ব্ল্যাস্ট বা ‘মাদার অব অল বোম্বস’ এবারই প্রথমবারের মতো কোনো সামরিক কাজে ব্যবহার করা হল। এটি তৈরি করতে খরচ করতে হয়েছে প্রায় ১৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা টাকার হিসাবে ১২৯ কোটি ৭৬ লাখ। কলমের মতো দেখতে এই অপারমাণবিক বোমাটির ওজন ১০ টনের কিছু কম এবং এর দৈর্ঘ্য ৯.২ মিটার বা ৩০ ফুট।
এর বিস্ফোরক দ্রব্যের মধ্যে ৮০% ট্রাই-নাইট্রো টলুইন (TNT) এবং ২০% অ্যালুমিনিয়াম পাউডারের মিশ্রণ থাকে। এই বোমাটি জিপিএস দ্বারা পরিচালিত হয়। ভূপতিত হবার সময় টার্গেট থেকে প্রায় ৫-৬ ফুট ওপরে থাকাকালীন এটি বিস্ফোরিত হয়। প্রাথমিকভাবে এটি বিশাল বিস্ফোরণ তরঙ্গ সৃষ্টি করে এবং চারপাশের এক কিলোমিটার এলাকা পর্যন্ত ওই বিস্ফোরণ তরঙ্গ পৌঁছে যেতে সক্ষম হয়। ভূমির ওপরে ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর পাশাপাশি ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গ এবং বাঙ্কার ধ্বংস করাতেও সমান মাত্রায় পারদর্শী এ বোমাটি। এমনকি এটি বিস্ফোরণের সময় যে পরিমাণ শক্তি অপসারিত হয়, তা রিখটার স্কেলে ৬ মাত্রার ভূমিকম্পের সমান। অপারমাণবিক হওয়ায় মার্কিন প্রেসিডেন্টের অনুমতি ছাড়াই এ ধরনের বোমা ব্যবহার করতে পারে দেশটির সামরিক বাহিনী।
ম্যাসিভ অরডিন্যান্স এয়ার ব্ল্যাস্ট তৈরির ধারণাটা আসে ভিয়েতনাম যুদ্ধে ব্যবহৃত বিএলইউ-৮২ থেকে। এবং ইরাক যুদ্ধে ব্যবহারের উদ্দেশে ২০০৩ সালের দিকে এটি বানানো হয়। সর্বপ্রথম ২০০৩ সালের ১১ই মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় পরীক্ষামূলকভাবে এর বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। তার বেশ কিছু মাস পর আবার আরেকটি পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ চালানো হয় এবং সফলভাবে পরীক্ষণ শেষ হয়। তবে ইরাক যুদ্ধে এই বোমাটি ব্যবহার করা হয়নি। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে জিবিইউ-৪৩/বি মডেলের প্রায় ১৫টি ‘মাদার অব অল বোম্বস’ সংরক্ষিত আছে।
কিন্তু এটিও যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর সবচেয়ে ভারি অপারমাণবিক বোমা নয়। ম্যাসিভ অরডিন্যান্স পেনেট্রেটর বা এমওপি এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে বড় বোমা। এর ওজন প্রায় ৩০ হাজার পাউন্ড। কিন্তু এখনও পর্যন্ত শত্রু ঘাঁটিতে বর্ষণকৃত বোমার মধ্যে এমওএবিই পৃথিবীর সবচে বড় এবং ভারি অপারমাণবিক বোমা।
ফাদার অব অল বোম্বস
গত ১৩ই এপ্রিল সকল বোমার মাকে দেখা যাবার পরদিন শুক্রবার জানা যায় সকল বোমার বাবা বা এফওএবি (FOAB) সম্পর্কে। এটি রাশিয়ান সামরিক বাহিনীর কাছে সংরক্ষিত রয়েছে। তবে সামরিক ক্ষেত্রে এটি ব্যবহার না করার কারণে এর ভয়াবহতার কোনো নজির এখনও পর্যন্ত দেখা যায়নি।
রাশিয়ার ফাদার অব অল বোম্বসকে প্রযুক্তির ভাষায় বলা হয় থার্মোবারিক অস্ত্র। এটি দু’পর্যায়ে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে থাকে। আকারে এটি এমওএবি থেকে দেখতে ছোট হলেও বিস্ফোরক হিসেবে মাদারের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী এই বোম। ফাদার অব অল বোম্বস বা এফওএবি’র ভর ৭,০৫৮ কেজি বা ৭ টনের কিছু বেশি। রাশিয়ান সামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে শক্তিমত্তার দিক থেকে এটি চারগুণ বেশি শক্তিশালী এবং আরও অনেক বেশি বিধ্বংসী। এর বিস্ফোরক ধারণ ক্ষমতা প্রায় ৪৪ টন যেখানে এমওএবি ধারণ করে ১১ টন।
২০০৭ সালে প্রথমবারের মতো এর পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। ‘মাদার অব অল বোম্বস’ চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ এলাকা জুড়ে এটি তার ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে সক্ষম। এমওএবি বিস্ফোরণের ফলে যে পরিমাণ তাপমাত্রা উৎপন্ন হয়, তার চেয়ে এফওএবির বিস্ফোরক কেন্দ্রের তাপমাত্রা অনেক বেশি। এমনকি চাইলে এর ভিতরে পারমাণবিক উপাদানও যুক্ত করা যায়।
পৃথিবীতে ব্যবহৃত এখন পর্যন্ত সবচেয়ে শক্তিশালী অপারমাণবিক বোমা মার্কিন বাহিনীর এমওএবি। তবে এর চাইতেও ভয়ঙ্কর অপারমাণবিক বোমা রাশিয়ান এফওএবি। এটিকে ছোটখাটো একটি পারমাণবিক বোমার সাথেও তুলনা করা যেতে পারে বলে মনে করছেন রাশিয়ান কর্মকর্তারা।
যুক্তরাষ্ট্রের এই মাদার অব অল বোম্বস ব্যবহার সমন্ধে সামরিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন সামরিক দিক থেকে এটি তেমন বড় কোনো সাফল্য নয়। তবে তারা মনে করছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে ভ্লাদিমির পুতিনের যে গোপনীয় আঁতাতের সন্দেহ রয়েছে, তা মিথ্যা প্রমাণ করতেই এ ধরনের বোমার বিস্ফোরণ ঘটাচ্ছে মার্কিনীরা। এদিকে মস্কো টাইমস বলছে যদি রাশিয়াকে ভয় দেখানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্র ১০ টনের এ বোমা বিস্ফোরণ করে, তাহলে তা খুব বেশি কাজে আসে নি। কারণ রাশিয়ার আছে এর চেয়ে চার গুণ বেশি শক্তিশালী বোমা। এ সম্পর্কে মস্কো টাইমস তাদের শিরোনামে বলেছে, ‘Dear America, Russia Wants You to Know Its Bombs Are Bigger’