এ যেন এক যাত্রায় পৃথক ফল। দক্ষিণ আফ্রিকায় এই মুহূর্তে ভারতের পুরুষ এবং নারী- দুই দলই দুর্দান্ত পারফর্মেন্স করে চলেছে। পুরুষরা ছয় একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচের সিরিজ জিতে নিয়েছে ৫-১ এ। টি-২০ সিরিজেও তারা এগিয়ে আছে ১-০ তে। অন্যদিকে, নারীরাও দক্ষিণ আফ্রিকার সাথে তিনটি একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচের সিরিজ ২-১ ফলে জিতে নেওয়ার পর টি-২০ সিরিজে এগিয়ে আছে ২-১ এ। পুরুষদের সিরিজে ভারতীয় অধিনায়ক বিরাট কোহলির তিনটি সেঞ্চুরি নিয়ে দেশের মিডিয়াকুল প্রবল হইচই বাঁধিয়েছে। তা বাঁধানোরই কথা। কোহলির এমন সুপারম্যানের ফর্ম দেখে ক্রিকেট-পাগল দেশের আপামর জনগণ যে আনন্দে আটখানা হবেন, সেটাই তো স্বাভাবিক।
ভারতের নারী দলও তো দক্ষিণ আফ্রিকায় জিতলেন, তাদের নিয়ে ঢাকঢোল বাজল কই?
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এই একই ক্রিকেট-পাগল দেশে নারীদের ক্রিকেট নিয়ে একইরকম উল্লাস চোখে পড়ে না। কোহলি যখন একের পর এক বড় ইনিংস খেলে চলেছেন দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে, ভারতীয় নারী দলের সদস্য ২১ বছর বয়সী স্মৃতি মন্দনার ব্যাট থেকেও আসছে ম্যাচ জেতানো ইনিংস।
ভারতের নারী ক্রিকেট দল তাদের প্রথম দুটি ম্যাচেই দক্ষিণ আফ্রিকাকে উড়িয়ে দিয়ে সিরিজ পকেটে পুরে ফেলে এবং এই দুটি ম্যাচেই উওম্যান অফ দ্য ম্যাচ মন্দনার ব্যাট থেকে আসে যথাক্রমে ৮৪ এবং ১৩৫ রানের ইনিংস। কিন্তু দুঃখের বিষয়, একই প্রতিপক্ষ এবং একই পরিবেশে ভালো খেলেও ভারতীয় নারী খেলোয়াড়দের কপালে ওই চর্বিতচর্বন প্রশংসা ছাড়া আর কিছু থাকে না।
একই খেলা, একই প্রতিপক্ষ, একই পারফর্মেন্স- কিন্তু তবু বৈষম্য
যদি ভারতীয়রা সত্যিই ক্রিকেটের একনিষ্ঠ ভক্ত হয়ে থাকে, তবে কেন এই দ্বিচারিতা? বিরাট কোহলির দল চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনালে পাকিস্তানের কাছে চূর্ণ হলেও যে মিডিয়া কাভারেজ পায়, মিতালি রাজের ভারতীয় নারী দল বিশ্বকাপ ক্রিকেটে রানার্স আপ হলে তার চেয়েও কম ঢাকঢোল বাজে কেন? আর যেটুকুও বা তখন বাজে, দক্ষিণ আফ্রিকায় সিরিজ জেতার পরেও তা ধারাবাহিক হয় না কেন?
ভারতের সিনেমা জগতে এখন নারী–কেন্দ্রিক ছবি হচ্ছে যথেষ্ঠভাবে
বিগত কয়েকদিনে ভারতে ‘প্যাডম্যান’ বলে একটি ছবিকে ঘিরে বেশ আগ্রহ তৈরি হয়েছে। দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের জনৈক পুরুষের নিজ উদ্যোগে দুঃস্থ নারীদের জন্য এক সস্তা অথচ কার্যকরী স্যানিটারি ন্যাপকিন তৈরি করার সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে এই ছবি।
বলিউডের অভিনেতা অক্ষয়কুমার ওই সামাজিক দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন যুবকের চরিত্রে অভিনয় করেছেন। ক’দিন আগে এই অক্ষয়কুমারই খোলা মাঠে শৌচকর্ম করার বিরুদ্ধে আরও একটি ছবি করেছিলেন, যেটিকেও দেখানো হয়েছিল নারীদের আব্রু রক্ষার্থে এক বিবাহিত পুরুষের লড়াই।
কিন্তু বিসিসিআই–এর মতো দাপুটে সংস্থার এ ব্যাপারে এত ঔদাসীন্য কেন?
নারীদের সামাজিক কল্যাণের দিকগুলোকে তুলে ধরে বলিউডের মতো এক বিশ্ববিখ্যাত চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রি যদি সমানতালে কাজ করে যেতে পারে এবং জনসমক্ষে তার প্রচার করতে পারে, তবে ভারতের ক্রিকেট বোর্ড (বিসিসিআই)-এর মতো এক ধনী এবং শক্তিশালী সংস্থা দেশের নারীদের ক্রিকেটে আরও মনোনিবেশ করে তাকে তার ন্যায্য মর্যাদা দিতে পারে না কেন?
এই প্রশ্নের প্রথম এবং প্রধান উত্তর হচ্ছে মানসিকতা। আমরা মুখে নারীর অধিকার বা লিঙ্গ নির্বিশেষে সমোন্নয়নের কথা বললেও কাজে তা করে দেখতে যথেষ্ঠ কুন্ঠাবোধ করি। না হলে, গত জুলাইতে ভারতীয় নারী দল বিশ্বকাপে রানার্স-আপ হওয়ার পরে ভারতজুড়ে নারী ক্রিকেট সম্পর্কে যে উৎসাহ দেখা গিয়েছিল, তা ক্রমেই ঝিমিয়ে পড়ল কেন এই কয়েক মাসেই?
দক্ষিণ আফ্রিকায় নারী দলের দুর্দান্ত খেলা কোনো চ্যানেলে সম্প্রচারিতই হয়নি। বিসিসিআই হয়তো বলবে যে, খেলা দেখানোটা উদ্যোক্তা দেশের দায়িত্ব। কথাটি ভুল হয়তো নয়, কিন্তু যে বিসিসিআইকে অতীতে দেখা গেছে অন্যান্য দেশের ক্রিকেট বোর্ডকে রীতিমতো চাপে ফেলে কাজ আদায় করে নিতে, তারা এই সিরিজটিকে সম্প্রচার করার জন্য দক্ষিণ আফ্রিকান ক্রিকেট কর্তাদের উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারল না? বিশ্বাস করতে একটু হলেও কষ্ট হয় বৈকি।
ভারতের নারী ক্রিকেট- প্রদীপের নিচেই অন্ধকার?
মিতালি রাজ, মন্দনা বা ঝুলন গোস্বামীর নারীদের ভারতীয় ক্রিকেটকে যথেষ্ঠ গৌরবান্বিত করলেও একটু যদি তলিয়ে দেখা যায়, তবে বোঝা যাবে প্রদীপের নিচে কতটা অন্ধকার বিরাজমান। ভারতে অনূর্ধ্ব-১৬ বা অনূর্ধ্ব-২৫ নারীদের কোনো ক্রিকেট প্রতিযোগিতা হয় না। এর অর্থ, প্রাথমিক পর্যায়ে ‘ট্যালেন্ট সাপ্লাই’ ব্যবস্থাটি নড়বড়ে, যার দরুণ আগামী দিনে বড় প্রতিভার উঠে আসার রাস্তাটি যথেষ্ঠ সংকীর্ণ।
আজ যদি ভারতীয় ক্রিকেট মিতালি-ঝুলনদের সাফল্যকে কাজে লাগিয়ে নারী প্রতিভাদের উৎসাহিত না করতে পারে, তাহলে আগামী দিনের সাফল্য খোয়াবই থেকে যাবে। ১৯৮৩ সালে ভারত প্রথমবার পুরুষদের বিশ্বকাপ জেতার পর দেশটিতে ক্রিকেটে অভূতপূর্ব জোয়ার এসেছিল। ছেলেদের ক্রিকেটেও চার-চারটি বিশ্বকাপ চলে এসেছে ইতিমধ্যে, আইপিএল-এও চড়া দামে বিকোচ্ছে জুনিয়র খেলোয়াড়রা। অথচ নারীদের ক্ষেত্রে দু’দুবার বিশ্বকাপ রানার্স-আপ হওয়া সত্ত্বেও নেই কোনো পেশাদারিত্বের লক্ষণ।
এর পাশাপাশি রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে নারীদের ক্রিকেটের প্রতি বিসিসিআইয়ের ঔদাসীন্য। এর ফলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে নারী খেলোয়াড়-কেন্দ্রিক দল গঠনের কোনো সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। যার কারণে ক্রিকেট খেলতে চায় এমন মেয়েদের প্রাতিষ্ঠানিক সুযোগ এবং পরিচিতি পাওয়া হয়ে উঠছে না। একইরকম চিত্র এদেশের কর্পোরেট ক্রিকেটেও, যার ফলে ক্রিকেট কোটায় খেলোয়াড়দের চাকরি পাওয়ার রীতি চালু হচ্ছে না নারীদের ক্ষেত্রে।
এসবের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ভারতীয় ক্রিকেট। লিঙ্গ বৈষম্যের এমন উদাহরণ বেশ উদ্বেগজনক।
সাম্প্রতিক সময়ে নারী ক্রিকেট দলের সাফল্য দলটির সদস্যদের পারিশ্রমিক বাড়িয়েছে ঠিকই, কিন্তু যদি পরিকাঠামো এবং প্রাথমিক ব্যবস্থার উপর জোর না দেওয়া হয়, তবে দেশটির নারী ক্রিকেটকে ঘিরে তৈরি হওয়া সমস্ত আশা বাষ্পের মতো উবে যেতে বেশি সময় লাগবে না।
ক্রিকেট ভারতে অত্যন্ত জনপ্রিয় হলেও লিঙ্গ বিশেষে তার আদর যথেষ্ঠ দৃষ্টিকটু। প্রখ্যাত ক্রিকেট লেখক বোরিয়া মজুমদার তার একটি কলামে জানিয়েছেন, যেখানে পুরুষ এবং নারীদের ক্রিকেট দল একই প্রতিপক্ষ দেশে বিরুদ্ধে খেলছে, সেখানে শুধুমাত্র পুরুষদের ক্রিকেটের টেলিভিশন সম্প্রচার বৈষম্যমূলক। নারীদের ক্রিকেটের পৃথক সত্ত্বাকে স্বীকৃতি দেওয়ার আশু প্রয়োজন বলেও তিনি মনে করেন।
বোরিয়ার যুক্তি অকাট্য। পশ্চিমে নারীরা অনেক ক্রীড়াতেই- তা দলগত হোক বা ব্যক্তিকেন্দ্রিক- অংশগ্রহণ করেন এবং আলাদা স্বীকৃতি পান। টেনিস, দৌড়, ব্যাডমিন্টন, টেবিল টেনিস, ফুটবল নানা ক্ষেত্রেই নারীদের নিজস্ব পরিচিতি রয়েছে। নিজেদের দেশের পুরুষ খেলোয়াড়দের ছায়ায় তারা ঢাকা পড়ে যান না।
কিন্তু আমাদের এই উন্নয়নশীল বিশ্বে সেই চিন্তাভাবনা এখনও এসে পৌঁছুতে পারেনি। ব্যাডমিন্টন, টেনিস, বক্সিং, কুস্তি, দৌড় বা টেবিল টেনিসের মতো খেলায় যদিও বা ভারতের নারী খেলোয়াড়রা নিজস্ব পরিচিতি বানাতে সফল হয়েছেন; ক্রিকেট, হকি বা ফুটবলের মতো দলভিত্তিক খেলায় তারা এখনও তিমিরাচ্ছন্ন। বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলার পরেও এদেশের নারী ক্রিকেট দলের টিভিতে মুখ দেখানোর সৌভাগ্য হয় না।
কৃতীদের দেখানো পথেই নতুন প্রজন্ম উঠে আসে
যেকোনো ক্ষেত্রে কৃতীদের দেখানো পথেই পরবর্তী প্রজন্ম তৈরি হয়। ভারতে অ্যাথলেটিক্স এম ডি ভালসাম্মা এবং পি টি উষার কৃতিত্বে অনুপ্রাণিত হয়ে আরও নারী দৌড়ে আগ্রহ দেখতে শুরু করেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে সেই সাফল্যের পরম্পরা বজায় না থাকার ফলে ক্রমেই ফিকে হয়ে আসতে শুরু করে ভারতের নারী অ্যাথলেটিক্সের রমরমা সময়।
একইভাবে, টেনিসে সানিয়া মির্জা, ব্যাডমিন্টনে সাইনা নেহওয়াল এবং পিভি সিনধু, বক্সিংয়ে মেরি কম বা কুস্তিতে সাক্ষী মালিকের সাফল্য এই সমস্ত খেলায় নতুন প্রজন্মকে আসতে উৎসাহিত করছে। কিন্তু সাফল্যের সঙ্গে আসা উৎসাহকে ধরে রাখতে গেলে দরকার ধারাবাহিক উৎসাহ এবং পরিকাঠামোগত উন্নতি।
ভারতের নারী ক্রিকেটে সেটারই অভাব বোধ হচ্ছে। আর আরও বেশি করে হচ্ছে কারণ, এখানে পুরুষ ক্রিকেট দলের কাছে আর সব কিছুই ফিকে- সাফল্য, গ্ল্যামার, পয়সা- সব কিছুর নিরিখেই। ভারতের চলচ্চিত্র নির্মাতারা ‘দঙ্গল’ বা অতীতে ‘চাক দে! ইন্ডিয়া’ এবং ‘মেরি কম’ ছবিগুলো বানিয়েছিলেন নারী ক্রীড়াবিদদের পর্বতপ্রমাণ সাফল্যকে গৌরবান্বিত করতে। ছবির এই মেজাজ এখন আমাদের বাস্তব জীবনেও সার্বিকভাবে প্রতিফলিত হওয়া প্রয়োজন। নচেৎ নারীদের ক্ষমতায়নের বুলির বেশিরভাগটা কাগজে-কলমেই থেকে যাবে।
ফিচার ইমেজ: Dream11 Pandit