পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার সিঙ্গুরে টাটা কোম্পানির ছোট্ট ন্যানো গাড়ির কারখানা স্থাপন করতে জমি অধিগ্রহণ করা নিয়ে যে তুমুল কেলেঙ্কারি বাঁধে বছর ১২ আগে, সেকথা আজ সবারই জানা। বিগত বাম সরকার রাজ্যের ধুঁকতে থাকা শিল্পায়নকে চাঙ্গা করতে এই কারখানাটি বসানোর পরিকল্পনা করলেও তার বাস্তবায়নে দেখা দেয় রাজনৈতিক-সামাজিক সমস্যা। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট পার্টি ২০০৬ সালের প্রথম ভাগে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় ফেরার সময়েই টাটারা এই কারখানা স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়।
বুদ্ধদেব তখন পরিচিত ‘ব্র্যান্ড বুদ্ধ’ হিসেবে; বামেদের বিকল্প হিসেবে তখন দেখা হয় উন্নততর বামফ্রন্টকেই। তাই পশ্চিমবঙ্গের অর্থনৈতিক স্বাস্থ্য ফেরাতে সবচেয়ে বড় ভরসা তখন দেখা হতো বুদ্ধবাবুকেই। পাশাপাশি ২০০৬ এর বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা তার পক্ষের সওয়ালকে আরও জোরদার করে।
সিঙ্গুরে শেষপর্যন্ত হাসল কে?
কিন্তু এরপর কীভাবে দিশা হারায় সিঙ্গুর পরিকল্পনা এবং সেখানে শুরু হওয়া প্রবল রাজনৈতিক ঝড়ে শেষমেশ উল্টেই পড়ে বুদ্ধবাবু তথা বামেদের গণেশ, এরপর ক্ষমতায় আসেন বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়; তা আজ ইতিহাস। এখন প্রশ্ন হচ্ছে: সিঙ্গুরে নানাবিধ রাজনৈতিক-আইনি বাগবিতণ্ডা এবং নেতিবাচক সামাজিক প্রভাবের পরে শেষমেশ কে শেষ হাসি হাসল? যার জন্যে লড়ছি বলে দেশনেতারা এত তর্জনগর্জন করলেন, ‘ঐতিহাসিক জয়’ বলে আস্ফালন করলেন, সেই সাধারণ মানুষের আদতে কতটা উপকারে এল এই ‘জয়’?
ইতিহাসকে পিছন দিকে হাঁটানোর এই স্পর্ধা; ইতিহাস ছেড়ে কথা বলবে তো?
সম্প্রতি ভারতের ‘দ্য ওয়্যার’ পত্রিকায় সিঙ্গুর সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনে বেশ ভালোভাবে ধরা পড়েছে সেখানকার স্থানীয়দের বাস্তবিক অবস্থা। ইতিহাসকে উল্টোদিকে চালানোর যে দাবি করেছিলেন শ্রীমতি বন্দ্যোপাধ্যায় আজ থেকে বছর দেড়েক আগে- সিঙ্গুরে চাষীদের জমি ফেরত দেওয়ার সময়ে; তা আসলে সিঙ্গুরের গ্রামীণ অর্থনীতিকে চূড়ান্ত পরিণতির দিকে এগিয়ে দিয়েছে।
কংক্রিটের কারখানা ভেঙে আবার সেই জমিতে চাষ চালু করার প্রায় অসম্ভব এবং অবিশ্বাস্য এই প্রকল্পটিকে বাস্তবায়িত করার জন্যে দিনরাত ঘাম ঝরিয়ে চলেছেন কিছু কৃষক, অথচ তারা জানেন যে কতটা দুরূহ এই কাজ। ইট-পাথর-কংক্রিটের টুকরো বোঝাই সেই জমিতে আগের মতো ফসল ফলানোর বুলি আওড়ানো রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে তুড়ি বাজানোর মতো সহজ হতে পারে, কিন্তু যিনি জমিকে কাছ থেকে দেখছেন, তিনি জানেন, তা মৃত সন্তানকে জীবিত করে তোলার প্রয়াস বৈ কিছু নয়।
সিঙ্গুর বৃত্তান্ত শুধুমাত্র জমি-আইনেই সীমাবদ্ধ নয়; তার ব্যাপ্তি বিশাল
সিঙ্গুরের সঙ্কট শুধুমাত্র জমি বা ফসলেই সীমাবদ্ধ নয়। বলতে গেলে, সিঙ্গুরে হওয়া এই বিরাট রাজনৈতিক অপদার্থতা টালমাটাল করে দিয়েছে সেখানকার অর্থনৈতিক এবং সমাজজীবনকে। মমতা সরকার চাষী পরিবারগুলোর জন্যে সস্তায় চাল এবং হাজারখানেক টাকার বন্দোবস্ত করেছে, কিন্তু তা তো কোনো সমাধান নয়, বরং একটি জনপ্রিয়তাবাদকে ভাসিয়ে রাখতে আরেকটি জনপ্রিয়তাবাদ। সিঙ্গুরের বর্তমান অবস্থাকে সম্পূর্ণ নিরাময় করতে যে দীর্ঘমেয়াদি এবং গভীর অর্থনৈতিক পরিকল্পনার আশু প্রয়োজন, তার ছিটেফোঁটাও পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক বা সামাজিক নেতৃত্বের কাজে দেখা যায় না। প্রথমে বাম সরকারের অপদার্থতা এবং পরে তৎকালীন বিরোধীদের ধ্বংসের রাজনীতির ফলে, যে সিঙ্গুরের আজ সারা দেশের সামনে মডেল ভিলেজ হয়ে ওঠার কথা ছিল, তা আজকে আরও দরিদ্র, আরও অন্ধকার।
সিঙ্গুরকে ঘিরে প্রথম যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তা ছিল সুশীল সমাজের নেতৃত্বে। কিন্তু সুযোগসন্ধানী রাজনৈতিক নেতৃত্ব বুঝতে পারে শীঘ্রই, বাম দুর্গে মরণ কামড় বসানোর এটাই চরম সুযোগ। শ্রীমতি বন্দ্যোপাধ্যায় তার তৃণমূল কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা করার পর দুটি বিধানসভা এবং তিনটি লোকসভা নির্বাচনে লেজেগোবরে হওয়ার পরে আহত বাঘের মতো অপেক্ষায় ছিলেন চিরশত্রু বামেদের হারানোর। সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রাম তাকে সেই সুযোগ এনে দেয়।
সিঙ্গুরে প্রতিবাদের দিনগুলোতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘উর্বর জমি’ এবং ‘অনিচ্ছুক চাষি’কে বাঁচানোর নামে নিজের রাজনৈতিক লক্ষ্যপূরণের জন্যে জান লড়িয়ে দেন। বছরের পর বছর ধরে গড়ে ওঠা তার প্রবল জনভিত্তি এবং অন্যদিকে, বামেদের বিরুদ্ধে তিন দশকের প্রতিষ্ঠানবিরোধী হাওয়া ব্যর্থ হতে দেয়নি নেত্রীর মিশন। টাটারা সিঙ্গুর ছাড়ে ২০০৮ এর অক্টোবরে; বুদ্ধবাবু ক্ষমতাচ্যুত হন ২০১১ এর মে মাসে। তারপর থেকে বঙ্গ রাজনীতি শুধুই মমতাময়।
কিন্তু রাজনৈতিক অভিসন্ধি পূরণের এই খেলায় যে জীবনের চলার পাথেয় হারিয়ে ফেললেন অনেক মানুষ এবং তাদের পরিবার, তার হিসাব কে দেবে? না থাকল চাষযোগ্য জমি; না হলো কারখানা- সিঙ্গুরের ভবিষ্যৎ আজ এক অজানা আঁধারের সম্মুখীন। বৃদ্ধ-জোয়ান-নারী-পুরুষ সবারই আজ এক প্রশ্ন- ভবিষ্যৎ কী? একটি কারখানা তৈরি মানে শুধু সেখানে তৈরি হওয়া গাড়ি নয়; তার সঙ্গে সঙ্গে গড়ে ওঠা একটি বৃহৎ আনুষঙ্গিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। সেখানে গাড়ি তৈরির ইঞ্জিনিয়ার থেকে শুরু করে সরবরাহকারী, লোহালক্কড়ের ব্যাপারী, এমনকি কারখানার প্রবেশপথের পাশে ছোট্ট স্টল খোলা চা-ওয়ালাও উপকৃত হয়। সিঙ্গুরের কারখানাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠতে পারত এক সম্পূর্ণ নতুন অর্থনৈতিক উপগ্রহ; ভৌগোলিক অর্থে তা চাপ কমাতে পারত কলকাতা শহরের ওপর থেকে। কিন্তু সেসব কিছুই হলো না। মাঝখান থেকে পশ্চিমবঙ্গের শিল্পায়নের সম্ভাবনা আরও স্তিমিত হলো।
সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের পর ওই রাজ্যের কোনো রাজনৈতিক নেতৃত্ব আর জমি অধিগ্রহণের সাহস দেখাতে পারবে বলে মনে হয় না। বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর ‘সরকার নিজে জমি নেবে না’ অবস্থান দেখে তা আরও স্পষ্ট হয়। গ্রামীণ ভোটব্যাংক আজ মমতার অন্যতম বড় নির্বাচনী শক্তি, আর তাই তার মুখে কৃষিবিরোধী কথা শোনার প্রত্যাশা বাতুলতামাত্র। কিন্তু, বিরোধী শক্তিরাও চুপ কেন? ‘দ্য ওয়্যার’-এর প্রতিবেদনটির মতে, তারা চুপ, কারণ সিঙ্গুরে শিল্পায়নের হারিয়ে যাওয়া সম্ভাবনার পক্ষে আওয়াজ তুলে তারা নিজেরাও ‘কৃষিবিরোধী’ দুর্নাম কিনতে চান না। তাতে আগামী নির্বাচনী লড়াইগুলোতে আখেরে লাভ হবে মমতা দেবীরই।
কিন্তু এসবের মধ্যে যা সবচেয়ে বেশি উদ্বেগজনক, তা হলো সর্বগ্রাসী রাজনীতি। সিঙ্গুরের জমি ফেরত দেওয়াকে শ্রীমতি বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুগতরা ‘রেনেসাঁ’ বলে উল্লেখ করলেও আদতে তা রাজনৈতিক জুলুমবাজির বৈধতাপ্রাপ্তি। গা-জোয়ারি রাজনীতি করে সম্পূর্ণ অর্থনৈতিক অগ্রগতির পথটিকেই বিনষ্ট করার যে ভয়ঙ্কর নজির পশ্চিমবঙ্গে তৈরি হয়েছে সেই কংগ্রেস আমলে বামেদের বিরোধী থাকাকালীনই, তা আজও অমলিন। সিঙ্গুরের চাষীর ভালো করছি ভেবে আসলে যে সর্বনাশটি আমরা তাদের করে ফেলেছি, সংখ্যাগরিষ্ঠতার গণতন্ত্রের চিলচিৎকারে তা আমাদের নজর এড়িয়ে গেছে সম্পূর্ণ। সব জেনেও না জানার ভান করছি আমরা; আমাদের স্বার্থপর রাজনীতি, সমাজনীতির কারণে নিজেদের ‘মহান হওয়ার দায়টি’ আমাদের চুকে গিয়েছে। এখন ওরা ওদের সমস্যা বুঝে নিক।
কিন্তু সিঙ্গুর এবং নন্দীগ্রামে যে ইতিহাসের সূচনা হয়েছে, তা একদিন ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের মতো গিলে খাবে আমাদের সবাইকেই। রাজনীতি সর্বগ্রাসী যেমন, তা তেমনই দু’মুখো তলোয়ারও বটে। ‘সর্বহারার প্রতিনিধি’ বামেদের এই সারসত্যর উপলব্ধি একদিন হয়েছে হাড়ে হাড়ে; তাদের উত্তরাধিকারীরাও ব্যতিক্রম হওয়ার নয়।
ফিচার ইমেজ: Express Photo by Partha Paul