২০১৮ সালের মার্চ মাসটি ভারতীয় উপমহাদেশের কমিউনিস্টদের জন্য সত্যি খারাপ সময়। গত ৩ মার্চ ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে মার্ক্সবাদী কমিউনিস্ট পার্টি ২৫ বছর রাজত্ব করার পর মুখ থুবড়ে পড়ার ঠিক দু’দিন পরেই প্রয়াত হলেন পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির বড় নেতা মহম্মদ জাম, যিনি পরিচিত ছিলেন কমরেড জাম সাকি।
তিয়াত্তর বছর বয়সে পাকিস্তানের এই প্ৰবাদপ্রতিম বামপন্থী নেতা দেশটির সিন্ধু প্রদেশের হায়দারাবাদে কিডনিজনিত ব্যাধিতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার মৃত্যুতে পাকিস্তানের বিভিন্ন মহল থেকে গভীর শোকজ্ঞাপন করা হয়।
পাকিস্তানের মতো দক্ষিণপন্থী সামরিক শক্তি প্রভাবিত দেশে বামপন্থী হওয়া সহজ নয়
সাকির পরিচয় ছিল গরীব-দুঃখী মানুষের অধিকারের পক্ষে আপসহীন সংগ্রামকারী হিসেবে। পাকিস্তানের সর্বগ্রাসী সামরিক শাসনের বিরুদ্ধাচরণ করার জন্যেও তিনি ছিলেন সেদেশের এক নমস্য ব্যক্তিত্ব। জিয়াউল হকের শাসনকালে সাকিকে এক দশকেরও বেশি সময়ে হাজতবাস করতে হয় কিন্তু তাতেও নিজের নীতিগত অবস্থান থেকে কোনোদিনও টলেননি তিনি।
জাম সাকি ১৯৬৭ সালে কলেজে পড়াকালীন, মাত্র ২৩ বছর বয়সে পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। সিন্ধু প্রদেশের ন্যাশনাল স্টুডেন্টস ফেডারেশনকে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি তৎকালীন সামরিক নেতা ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের বিরুদ্ধেও সংগ্রামে শামিল হন।
কৃষক এবং শ্রমিক শ্রেণীর মানুষের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলে তাদের অধিকার রক্ষার আন্দোলন শুরু করেন এই বামপন্থী নেতা। তার কঠোর সংগ্রামের কথা ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে এবং খুব শীঘ্রই পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির সিন্ধু কমিটিতে যোগ দেওয়ার নিমন্ত্রণ পান তিনি। এরপর তিনি দলের সম্পাদক নির্বাচিত হন। কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যপদ পান সাকি ১৯৭৩ সালে, মাত্র ২৯ বছর বয়সে। ১৯৯০ সালে ৪৬ বছর বয়সী সাকি কমিনিউস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
পাকিস্তানের মতো একটি সামরিক শক্তি শাসিত দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক ব্যবস্থায় বামপন্থার পথে হাঁটা সহজ কাজ ছিল না। কিন্তু রাষ্ট্রের শোষণনীতিকে উপেক্ষা করে জাম সাকি তার লড়াই চালাতে পিছপা হননি একদিনের জন্যও।
১৯৮৮ সালে জাম সাকি তার জন্মস্থান থারপারকার থেকে প্রাদেশিক নির্বাচনে লড়েন, কিন্তু জিততে পারেননি তার প্রভাবশালী বিপক্ষের বিরুদ্ধে। এরপর ১৯৯১ সালে সাকি কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সঙ্গচ্ছেদ করে যোগ দেন পাকিস্তান পিপলস পার্টি বা পিপিপিতে। এই পিপিপির প্রয়াত নেত্রী তথা পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো সাকির বিচারের সময়ে এবং পরে শাস্তিকালে তার মুক্তির জন্যে বড় ভূমিকা পালন করেছিলেন। সাকি আমৃত্যু পিপিপির সিন্ধু পরিষদের সদস্য থেকে গিয়েছিলেন।
তবে পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে তার পথ একসময়ে আলাদা হলেও সেই দলে আজও সাকির অনুরাগীর সংখ্যা কম নেই। কমিউনিস্ট পার্টির বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ইমদাদ কাজি সাকির মৃত্যুর পরে জানান যে, তিনি তাদের সকলের আদর্শগত গুরু ছিলেন, আর তাই তার মৃত্যুতে যে ক্ষতি হয়েছে তা পূরণ হওয়ার নয়।
পাকিস্তানের মতো নড়বড়ে গণতন্ত্র যেখানে সামরিক শক্তি ছড়ি ঘুরিয়েছে স্বাধীনতার পর বেশিরভাগ সময়জুড়ে, সেখানে সাকির মতো ব্যাক্তিত্বের মূল্যায়ন হওয়াটা জরুরি।
ব্যক্তি সাকিকে শক্তিশালী সামরিক শাসকরা বরাবর আক্রমণ করেও টলাতে পারেনি, সে কথা তো আগেই বলা হয়েছে। তাকে ‘দেশদ্রোহী’ তকমা দেওয়া সত্ত্বেও সাকি হার মানেননি।
কিন্তু সাকির কাহিনীর আরও একটি দিক রয়েছে। সাকি যখন উর্দিধারী কায়েমী স্বার্থের বিরুদ্ধে লড়ছেন, তখন পাকিস্তানী সমাজের নানা ক্ষেত্রে তরুণ তুর্কিরা একটি প্রতি-আদর্শের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। অর্থাৎ, একদিকে একনায়কতন্ত্র চললেও অপরদিকে আদর্শের রাজনীতিরও একটি গুরুত্ব ছিল, এমনকি পাকিস্তানের মতো বদ্ধ রাজনৈতিক ব্যবস্থাতেও। আজকের পাকিস্তানের রাজনীতিতে পর্বতপ্রমাণ দুর্নীতি এবং আদর্শহীনতা দেখা যায়, কিন্তু সাকির মতো দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তিত্বকে দেখা যায় না, যিনি প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা সত্ত্বেও লড়তে পিছপা হতে জানেন না।
পাকিস্তানে এই বছরই জাতীয় নির্বাচন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নওয়াজ শরিফের পতনের পরে এবং শাসকদল পিএমএল-এন-এর মধ্যে চূড়ান্ত গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব প্রকট হওয়া সত্ত্বেও, একদা সরব বামপন্থী রাজনীতি সেখানে আর মাথা তুলে দাঁড়ায় না। পাকিস্তানের সমাজ-রাজনীতির বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আজ দুর্নীতির ভারে ন্যুব্জ হলেও এই অবস্থায় যারা প্রকৃত দায়িত্ব পালন করতে পারে, সেই বামদের দেখা আর সেখানে মেলে না।
১৯৬০ এর দশকের শেষাশেষি থেকে পাকিস্তানের সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কৃষক, ছাত্র, শিল্পী ইত্যাদি শ্রেণীর সংঘবদ্ধ রাজনৈতিক এবং সামাজিক আন্দোলন দেখা যেত; অর্থাৎ সেখানে এক বামপন্থী প্রতিক্রিয়ার ঘরানা ছিল। জিয়াউল হকের শাসনকালে এই সুশীল সমাজের আন্দোলনের টুঁটি চিপে ধরা হয়, বিশেষত ১৯৭০ সালের অবিভক্ত পাকিস্তানের নির্বাচনের ফলাফলের পর।
জিয়াউল হকের সেই শোষণের শাসনের রেশ বর্তমান পাকিস্তানের সমাজজীবন থেকে মিলিয়ে যায়নি আজও। আন্দোলন যে পাকিস্তানের মাটিতে আজ হয় না তা নয়, কিন্তু অতীতের সেই সংঘবদ্ধতা আজ হারিয়ে গেছে অনেকটাই। পাকিস্তানের নানা শ্রেণীর শোষণের যে রাজনীতি আর তার বিরুদ্ধে যে প্রতিক্রিয়া, তা আজ অনেকটাই বিভক্ত। সাম্প্রদায়িকতা এবং আঞ্চলিকতার সংঘাত এই সমস্ত আন্দোলনকে আজ একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। এই সময়েই সাকির মতো ব্যক্তিত্বের অভাব আরও বেশি করে অনুভূত হচ্ছে, কারণ তার মতো সর্বগ্রহণযোগ্য বামপন্থী নেতা আজ থাকলে এই বিচ্ছিন্নতার মোকাবিলা করা যেত অনেকটাই।
আসমা জাহাঙ্গীর, জাম সাকির মৃত্যু অনেকটাই ম্লান করল পাকিস্তানের নাগরিক সমাজকে
পাকিস্তানের স্বনামধন্য মানবাধিকার কর্মী আসমা জাহাঙ্গীরের পর জাম সাকির মৃত্যু আজ সেদেশের নাগরিক সমাজকে অনেকটাই ম্লান করে দিয়েছে। বছর দশেক আগে বেনজির ভুট্টোর হত্যাকাণ্ডও সেখানকার বাম-ঘেঁষা রাজনৈতিক নেতৃত্বের উপর এক প্রবল আঘাত হেনেছিল। রাজনৈতিক এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে নাগরিক সমাজের প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠা পেতে যে দেশটি বহু বছর ধরে লড়ে আসছে তার জন্য এ খুব শুভ সংবাদ নয়। কিন্তু আশাতেই বাঁচে মানুষ।
পাকিস্তানের বামপন্থী ধারাকে আজ জাম সাকির মতো নেতার দেখানো পথ ধরেই এগিয়ে যেতে হবে। কারণ, একটি পাল্টা আর্থ-রাজনৈতিক আদর্শকে প্রতিষ্ঠিত না করতে পারলে পাকিস্তানের একচেটিয়া কায়েমী স্বার্থ সেখানকার নাগরিক জীবনকে আরও প্রতিহত করবে।
ফিচার ইমেজ: The News International