একটু দাঁড়ান, আপনার কি মনে হয় আপনাকে কেবল ঘোরার জন্য কেউ স্পন্সর করবে? আর্টিকেলটা কি সেই আশাতেই পড়তে এসেছেন? তবে দুঃখিত, কিছুটা আশাভঙ্গ হতে যাচ্ছে আপনার। তবে নতুন আশা অবশ্যই জাগবে যদি পুরোটা পড়েন।
আচ্ছা, একজন বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ চিকিৎসককে কেন টাকা দেয় সরকার? সেটা কি কেবল হাসপাতালে বসে থাকার জন্য? নাকি হাসপাতালে তিনি যেটা করেন, অর্থাৎ রোগীর চিকিৎসা- সেটার জন্য? ঠিক তেমনি, শুধু মাত্র ছুটি কাটানোর ঢঙে অলসভ্রমণে কেউ আপনাকে টাকা দেবে না, যদি না সেই ভ্রমণকে আপনি উপযুক্তভাবে কাজে লাগাতে পারেন!
স্পন্সর আপনাকে টাকা তখনই দেবে, যখন ভ্রমণের দ্বারা উভয়পক্ষের জিত হবে অর্থাৎ আপনারও ঘোরা হবে, তাদেরও ‘লাভ’ হবে! এখন লাভটা কীভাবে হতে পারে? হিসাবটা খুব সহজ। তাদের বিনিয়োগকৃত অর্থ একটি ভালো প্রয়াসে ব্যয়িত হচ্ছে এবং এর পাশাপাশি তা কোম্পানি/পণ্যের ব্যান্ডিংয়েও ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে, এটুকু আপনার ভ্রমণের দ্বারা নিশ্চিত করলেই হবে। যা-ই হোক, স্পন্সর কীভাবে পাবেন এবং কীভাবে এগোতে হবে তা নিয়েই আজকের লেখা।
চিন্তা করুন স্পন্সরের দৃষ্টিকোণ থেকে
ধরুন, আপনার কাছে কেউ টাকা চাইলো। এখন আপনি অবশ্যই জানতে বা বুঝতে চাইবেন যে টাকাটা আপনি তাকে কেন দেবেন। সেই সঙ্গে আপনি যদি হন বাণিজ্যিক দাতা, তবে অবশ্যই এই সাহায্যের বিনিময়ে আপনার কতটুকু লাভ হবে, তা আপনি নিশ্চিত হবেন আগে। তাই না? ঠিক এভাবেই চিন্তা করে থাকেন আপনার সম্ভাব্য স্পন্সর। সুতরাং তাকে আশ্বস্ত করুন এবং তার কাছে এমন আইডিয়া উপস্থাপন করুন, যেটিকে আপনি সমাজের বৃহত্তর পরিসরে নিয়ে পৌঁছাতে পারেন।
এখন পৌঁছানোর ব্যাপারটি স্পষ্ট করা যাক। ধরুন, আপনি ব্লগ বা ভ্লগ বানান কিংবা পত্রিকায় লেখেন। এখন এসবের দর্শক বা পাঠক চাহিদা কেমন, এটি স্পন্সর বুঝতে চাইবে। এখানে আপনি ‘স্পেশাল’ হলে স্পন্সরের সাথে চূড়ান্ত হ্যান্ডশেকটা হয়েই যাবে। আর মানসিকভাবে প্রস্তুতি রাখুন, খুব অসাধারণ যোগ্যতা না থাকলে নগদ অর্থ আপনাকে স্পন্সর দেবেন না। এটি মেনে নিয়েই এগোন। ধরুন, এভারেস্টে যাবেন, শুধু সরঞ্জামাদির দামই পড়বে লাখের মতন। এখন আপনার স্পন্সর ‘পিউমা’/’রিবক’ আপনাকে টাকা না দিয়ে ব্যাকপ্যাক, গ্লাভস, জ্যাকেট, জার্সি, কার্গো প্যান্ট, গগলস ইত্যাদি দেবে। এটাও কিন্তু আপনার জন্য কম নয়!
উপযুক্ত দাতা কোম্পানি খুঁজে বের করুন
ট্র্যাভেল-ব্লগার ফ্রান্সিস ট্যাপন বিশ্বভ্রমণের স্পন্সরশিপের জন্য গোলিট নামের একটা কোম্পানির কাছে দরখাস্ত করেছিলেন। আবেদন মঞ্জুর হবার পর তিনি জানতে পারলেন ‘রিটার্ন অন ইনভেস্টমেন্ট’ সেকশনে তিনিই সর্বপ্রথম আবেদনকারী ব্যক্তি ছিলেন। অর্থাৎ আমরা হয়তো অনেকে জানিই না যে, অনেক কোম্পানিরই এমন একটি সেকশন থাকে, যেখানে তারা বিনিয়োগের জন্য উদ্যোক্তা খোঁজে। এক্ষেত্রে তারা কেবল বিনিয়োগের টাকাটুকুই উসুল চায় কোম্পানির প্রচারের বিনিময়ে। তাই চোখ কান খোলা রাখতে হবে। এক্ষেত্রে কোম্পানিগুলো তাদের পণ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ এমন যেকোনো কিছুতেই বিনিয়োগ করতে পছন্দ করে। যেমন ধরুন, আপনি একজন বিশিষ্ট রন্ধনশিল্পী, টিভিতে রান্নার অনুষ্ঠান করেন। এখন আপনি এডিডাস বা নাইকির কোনো স্পন্সর হয়ত পাবেন না, কিন্তু একটু চেষ্টা করলেই পেয়ে যেতে পারেন কোনো মসলা কোম্পানির স্পন্সর। শুধু এটুকু কোম্পানিকে বোঝাতে হবে যে আপনি কীভাবে তাদের পণ্যের প্রোমোশনটা করবেন। হতে পারে প্রতি পর্বে আপনি তাদের মসলা দিয়েই সব পদ রান্না করলেন।
তেমনি আপনার ভ্রমণের ক্ষেত্রে অমুক বাইসাইকেল কোম্পানি, কিংবা তমুক বেভারেজসহ প্রাসঙ্গিক কোম্পানিগুলো ঠিকই বিনিয়োগ করবে। শুধু তাদের কাছে যান এবং আপনার প্রোমোশনাল আইডিয়াটি তুলে ধরুন। এক্ষেত্রে যে প্রস্তাবনা আপনাকে লিখতে হবে, তাতে উল্লেখিত থাকতে হবে কয়েকটি বিষয়–
· কীভাবে ব্র্যান্ডিং করবেন পণ্যটির?
· কত মানুষের কাছে আপনি নিজেকে পৌঁছাতে পারবেন বলে ভাবছেন?
· আপনাকেই কেন টাকাটা স্পন্সর করা উচিত? কেন অন্যকে নয়?
মনে রাখবেন, আপনি যখন সেই কোম্পানির কাছে যাচ্ছেন, আপনি কোনো ভিক্ষুক নন। আপনি তাদের মক্কেল যে কিনা টাকা নিয়ে সেই পুঁজি তুলে আনবার সৃষ্টিশীল বিপনন-প্রস্তাবনা দিতে এসেছেন। সুতরাং আত্মবিশ্বাসের সাথে চোখে চোখ রেখে কথা বলুন।
ব্যক্তিগত যোগাযোগকে কাজে লাগান
আপনার পরিচিত সবাই, আবারও বলছি, ‘সবাই’কে বলুন আপনার বিশেষ আইডিয়াটির কথা। সেই সঙ্গে প্রত্যেককে আলাদা আলাদাভাবে জিজ্ঞেস করুন কীভাবে কেমন করে এগোনো যায়! এটা একটা কৌশল। কে জানে, এদের কোনো একজনই হয়ত আপনাকে পাইয়ে দিতে পারেন কাঙ্ক্ষিত স্পন্সর।
বিশ্বাসযোগ্যতা আদায় করুন
বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ‘প্রথম’ হবার ঝুঁকিটি কম স্পন্সরই নিতে চায়। সুতরাং আগেও আপনাকে কেউ স্পন্সর করেছে আর আপনিও সেটা সফলভাবে কাজে লাগিয়েছেন কিংবা বর্তমান প্রজেক্টেও কিছু স্পন্সরের সাথে আপনার ফলপ্রসূ আলাপ বা চুক্তি হয়েছে- স্পন্সরকে এমনটা যদি দেখাতে পারেন, সবচেয়ে ভালো হয়। আর যদি পূর্বে স্পন্সরশিপ পাবার রেকর্ড না থাকে, তবে স্পন্সরশিপকে কীভাবে কাজে লাগাবেন তার একটা চেকলিস্ট এবং আপনার বিগত কাজের মান স্পন্সরকে দেখান। তাহলে তারা ভরসাটা আপনাকে করতে অত দ্বিধা করবেন না।
জোর দিতে পারেন দাতব্য কর্মসূচিতে
স্পন্সর করবার ক্ষেত্রে দাতাদের আগ্রহের একটি জায়গা থাকে দাতব্য কর্মসূচি বা চ্যারিটি। কেননা দাতব্য কাজের বিনিয়োগে তাদের ইমেজটাও যেমন সমুন্নত হয়, তেমনি তারা মানসিক তৃপ্তিও লাভ করেন। তাই আপনার ভ্রমণকে কোনো দাতব্য কাজের সাথে যুক্ত করে সেই দাতব্য উদ্দেশ্যে অর্থ সংগ্রহ করতে পারেন। কিন্তু একটি কথা ভালো করে মাথায় গেঁথে নিন, আপনাকে ছুটি কাটানোর জন্য কেউ টাকা দেবে না। তাই আপনার আদায়কৃত অর্থের কী পরিমাণ অংশ ব্যক্তিগত ভ্রমণে ব্যয়িত হবে আর কী পরিমাণ দাতব্য ফান্ডে যাবে, সেটি দাতাদের স্পষ্ট করে জানিয়ে দিন। এতে করে তারাও তাদের বিনিয়োগ-নিরাপত্তা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকবে।
সেলিব্রিটি সংস্রবের চেষ্টা করুন
স্পন্সরের মনোযোগ বা আস্থা আদায়ের আরেকটি পন্থা হলো সেলিব্রিটিদের কাজে লাগানো। গড়পড়তা একজন মানুষের পক্ষে এভাবে একজন সেলিব্রিটি ‘ম্যানেজ’ করা একটু কঠিন। তবে পদ্ধতিটি বেশ ফলপ্রসূ। এই যেমন ব্রিটেনের পল আর্চারের কথাই ধরা যাক। ট্যাক্সি নিয়ে তিনি লন্ডন থেকে যাবেন সুদূর সিডনি। তিনি ভাবলেন, কোনো একজন সেলিব্রিটিকে যদি আমার এই কাজের প্রচারে যুক্ত করতে পারি তো মন্দ হয় না। ভাবনানুযায়ী তিনি গেলেন গিনেস কর্তৃক স্বীকৃত জীবিত বিশ্বসেরা পরিব্রাজক স্যার র্যানালফ ফিনেসের কাছে। অপ্রত্যাশিতভাবে তিনি রাজি তো হলেনই, নিজেও চড়ে বসলেন আর্চারের ট্যাক্সিতে! ফিনেসের নামের গুণে মিডিয়াও যেমন বাড়তি কাটতি দিলো, তেমনি স্পন্সররাও এগিয়ে এলো। আপনিও এভাবে যেতে পারেন আপনার হাতের কাছে থাকা কিংবা প্রিয় সেলিব্রিটির কাছে। আর্চারের মতো সবসময় এতটা ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়ত হবে না, কিন্তু চেষ্টা করেই দেখুন না!
ঢাক পেটান জোরসে
বিশ্ব ঘুরতে বেরোবেন। এত বড় একটা কর্মপরিকল্পনা আপনার। এর প্রচারণাও তাই হওয়া চাই জাঁকালো। আপনার বাড়ির পাশের বাগানে বসে স্থানীয় সংবাদদাতাদের ডেকে ঘোষণা দিলে তাই হবে না! সামাজিক মাধ্যমে জোর প্রচারণার পর একদিন সাহস করে সংবাদ সম্মেলন ডেকে হাজির হয়ে যান জাতীয় পর্যায়েই। আত্মবিশ্বাস রাখুন, স্বপ্নটা যদি তত বড় দেখতে জানেন, তো গণমাধ্যম থেকে তেমন ইতিবাচক সাড়াটাই পাবেন।
স্পন্সরের ওপর একক নির্ভরশীলতা কমান
স্পন্সরশিপ পাওয়া আসলে অনেকখানি ভাগ্যের ব্যাপার, না-ও পেতে পারেন। তার জন্য কি আপনার স্বপ্ন থমকে থাকবে? মোটেও না। চাকরি-ব্যবসা কিছু একটা করুন, রোজগার করুন, পরিমিত খরচ করে সঞ্চয়ের পরিমাণ বাড়াতে থাকুন, ব্যস। তাছাড়া স্পন্সরশিপ পেলেও সফরের পুরোটা যে তাতে কাবার হবে, তা-ও নয়। সেক্ষেত্রে বাকি টাকার যোগানটা তো নিজ পকেট থেকেই যাবে। তো ট্যাঁক ভারি করতে বাড়ান আপনার ব্যক্তিগত সঞ্চয়। পাশাপাশি টি-শার্ট, গ্লোব, পুরনো বই, ভ্রমণের ছবি, পোস্ট কার্ড ইত্যাদি বিক্রি করতে পারেন।
এর বাইরে আরেকটি উপায় আছে। ধরুন, ১০ লাখ টাকা নিয়ে ৪ জন বন্ধু মিলে সিঙ্গাপুর গেলেন। এখন আপনারা প্রত্যেকেই এই টাকা দিয়ে কাস্টমসের সর্বোচ্চ সীমা ও অন্যান্য বিধি-নিষেধ অনুযায়ী গ্যাজেট কিনে নিতে পারেন। এরপর দেশে এসে সেগুলো খুচরা বাজারে ১৪-১৫ লাখে বিক্রি করে আপনি ৪-৫ লাখ টাকা লাভ করতে পারেন। ভ্রমণের ১০ লাখ যদি ধার করেন, তবে সেটি তো পরিশোধ হচ্ছেই, সাথে আপনি পেয়ে যাচ্ছেন পরের ভ্রমণের জন্য নতুন করে ৪-৫ লাখ টাকা। তবে এই পদ্ধতি অনুসরণের জন্য প্রচুর মার্কেট রিসার্চ করতে হবে আপনাকে। কোন দেশে কোন প্রোডাক্ট ভালো, আন্তর্জাতিক বাজারদর কেমন, কাস্টমসে কতটুকু বহন করা বৈধ তা জানতে হবে।
তমিস্লাভ পার্কো নামক এক ক্রোয়েশীয় পর্যটক বন্ধুর প্রাসঙ্গিক গল্প দিয়ে শেষ করছি। এত অনুপ্রেরণার গল্প থাকতে তার নাম নিচ্ছি কেন জানেন? কারণ তার সাফল্যের গল্পটা শুরু হয়েছিলো বাংলাদেশেই।
সবাই ঘুরতে চায়, কিন্তু টাকার অভাব সবারই। তাই স্পন্সর পাবার বাজারেও তুমুল প্রতিযোগিতা। লড়াইয়ে টিকে থাকতে এজন্য চাই অপ্রথাগত কোনো আইডিয়া। তমিস্লাভ তাই বেছে নিয়েছিলেন হিচ-হাইকিংকে। অর্থাৎ আঙুল নাড়িয়ে লিফট চেয়ে মুফতে যানবাহন ব্যবহার করে বিশ্ব ঘোরা। এভাবে নিজের টাকায় তিনি তুরস্ক, স্পেনসহ নানা জায়গায় ঘুরতেন আর ফেসবুকে আপলোড করতেন।
ফেসবুকে পেজের সুবাদে তিনি একটা বিশাল কমিউনিটিও গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন। এ নিয়ে ফিচার হয়ে গেলো ক্রোয়েশীয় একটি দৈনিকের পাতায়। মূলত এরপরেই ভাগ্য খুলে গেলো তমিস্লাভের। ক্রেডিট কার্ড কোম্পানি ‘মাস্টার কার্ড’ তাদের একটি ক্যাম্পেইনের জন্য বাংলাদেশে একমাস থাকার অফার দিলো তমিস্লাভকে। সফলভাবে বাংলাদেশ ভ্রমণকে কাজে লাগালেন মাস্টারকার্ডের সকল বিজ্ঞাপনে! ব্যস, সেই শুরু। এখন দেদারসে মাস্টারকার্ডের টাকাতেই দুনিয়া ঘুরছেন তমিস্লাভ। প্যাশনের উগ্রতার সাথে মাথার তীক্ষ্ণতাটুকু কাজে লাগাতে পারলেই আপনি সফল!
ফিচার ইমেজ: The Luggage Professionals