প্রথম পর্বে আলোচনা করেছিলাম সেই বিখ্যাত সাত গোল পরবর্তী ব্রাজিলের পশ্চাৎযাত্রা ও পুনরায় টিটের হাত ধরে স্বপ্ন দেখা নিয়ে। বিশ্বকাপ খেলা নিয়ে শঙ্কায় থাকা ব্রাজিল ঠিক যে মুহুর্তে বিশ্বকাপের টিকিট কেটে ফেললো, সেই মুহুর্তেই টিটে নতুন সমালোচনায় পড়লেন। প্রধান বিষয় ছিল, ব্রাজিলের মাঝমাঠ কি ইউরোপিয়ান দলের সাথে খেলার জন্য উপযুক্ত? ইংল্যান্ডের সাথে প্রীতি ম্যাচে ম্যাড়ম্যাড়ে ড্র ব্রাজিল কোচের দৃষ্টিভঙ্গিতে বেশ খানিকটা প্রভাব ফেললো।
দ্বিতীয় দফায় পরিবর্তন
টিটের পছন্দের সেনানী রেনাতো আগুস্তো ব্রাজিলের ঘরোয়া লিগে বেশ সফল। টিটের অধীনে তার দ্বিতীয় করিন্থিয়ান্সের সেই সুন্দর ফুটবল খেলা দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন। যখন ব্রাজিলের দায়িত্ব পেয়ে স্বল্প সময়ে টিটের ফলাফল দরকার ছিলো, তখন টিটে তার পরিচিত বা জ্ঞাত খেলোয়াড়দের উপর আস্থা রেখেছিলেন। কিন্তু রেনাতো-ক্যাসেমিরো-পাউলিনহো জুটির মাঝমাঠ বেশ স্থবির ধরনের খেলা দিচ্ছিল। এদিকে ম্যানসিটির মাঝমাঠের মূল শক্তি ফার্নান্দিনহো বেঞ্চে বসে থাকেন আর লিভারপুলে উইং ছেড়ে মাঝমাঠে খেলতে থাকা কৌটিনহো ব্রাজিলের হয়ে খেলেন রাইট উইংয়ে, যেখানে তার ডানা আসলে অনেকটাই ছাঁটা।
টিটে প্রথমে ফার্নান্দিনহোকে খেলান রেনাতোর জায়গায়। রেনাতো খেলতেন মূলত ৪-৩-৩ এর মাঝমাঠের তিনজনের বামপাশে। যখন নেইমার মাঠের বাইরে, কৌতিনহো লেফট উইংয়ে আর রেনাতোর পজিশনে ফার্নান্দিনহো খেলতে থাকেন। মাঝমাঠের বামপাশের এই রোল তার খুব একটা স্বাচ্ছন্দ্যের না হলেও মাঠে তার উপস্থিতি মার্সেলোর উপরে উঠে যাওয়াকে বেশ সুরক্ষা দেয় এবং রক্ষণ আঁটসাঁট হয়ে উঠে। কিন্তু সমস্যা হয়, এতে আক্রমণে জোর কমে যায়। এরপর টিটে আস্তে আস্তে কৌতিনহোকে সেই রেনাতোর রোলে খেলান ফার্নান্দিনহোর বদলে। বাল্যবন্ধু নেইমারের সাথে বামপাশে তার বোঝাপড়ায় দলে আক্রমণের মাত্রা অনেক বেড়ে যায়, আসল ব্রাজিলিয়ান ছন্দে খেলতে থাকে ব্রাজিল। কিন্তু এতে আবার মার্সেলোর দুর্বলতা প্রকাশিত হয়ে পড়ে একটু বেশি। মোদ্দাকথা, টিটে এক রেনাতোকে বাদ দিয়ে দুটো ফর্মুলা খুঁজে পান যেগুলো নিয়ে পরে আরেকটু বলা হবে। এবার একনজরে পজিশনভিত্তিক ব্রাজিল দলকে দেখে নেয়া যাক:
রক্ষণ
বহুকাল পর ব্রাজিল এমন দুজন গোলরক্ষক নিয়ে এসেছে যাদের উপর সত্যিকারের ভরসা রাখা যায়। প্রথম পছন্দ অ্যালিসন বেকার ও দ্বিতীয় পছন্দ এডারসন। রোমায় খেলা অ্যালিসন শট সেভিং পরিসংখ্যানে ইউরোপের শীর্ষ তিনের একজন, এডারসনও আছেন শীর্ষ দশে। এডারসনের পেনাল্টি সেভিং পরিসংখ্যান দারুণ। টিটে গোলকিপার থেকেই খেলা গড়তে চান আর দুই কিপারই বল পায়ে দক্ষ। তাদের পাসিং রেট অনেক মাঝমাঠের খেলোয়াড়কেও লজ্জায় ফেলে দেয়। জার্মানি ও স্পেনের পাশাপাশি সবচেয়ে ভালো কিপিং অপশন নিয়ে যাচ্ছে ব্রাজিল। ভয় একটাই থাকে, নিচ থেকে পাসিং বিল্ডআপ করতে গিয়ে না আবার অঘটন ঘটিয়ে বসে!
ব্রাজিলের সবচেয়ে দুর্বলতার জায়গা রাইটব্যাক। প্রথম পছন্দ ছিলেন আলভেস। বিশ্বকাপের আগেই পড়ে যান ইনজুরিতে। তার জায়গা নেন ডানিলো। একসময়ের দুর্দান্ত সম্ভাবনার ডানিলোর রিয়ালে কাটানো দুই বছর ছিল ভুলে যাওয়ার মতো, এবার ম্যানসিটিতেও ছিলেন গড়পড়তা। রাইটব্যাকে খেলার তেমন সুযোগ পাননি বললেই চলে। ডানিলো যদি তার রিয়ালে থাকার সময়কার মতো খেলা দেখান বিশ্বকাপে, তাহলে ব্রাজিলের স্বপ্ন অধরাই থাকবে নিশ্চিত। দুটো প্রীতিম্যাচে টিটে ট্যাকটিকালি ডানিলোকে এমনভাবে রেখেছেন যাতে খুব চোখধাঁধানো কিছু না করা লাগে, মূলত বিপদের শঙ্কা কমানোর জন্যই। তার বদলি থাকবেন ফ্যাগনার, যিনি নিজেও আশাব্যঞ্জক কোনো রাইটব্যাক নন।
জার্মান মডেলে সমাধান হতে পারতো, একসময় রাইটব্যাকে খেলা বর্তমানে সেন্টারব্যাক মার্কুইনহোসকে ডানিলোর বদলে খেলানো। কিন্তু টিটের কৌশলে উইংব্যাকের কাজ মাঝমাঠেই বেশি, তাই এ কাজ তিনি করবেন না। লেফটব্যাকে প্রথম পছন্দ মার্সেলো। মোটামুটি সবাই জানেন, আক্রমণে মার্সেলো কোনো উইঙ্গারের চেয়ে কন নন, কিন্তু রক্ষণে খুবই দুর্বল। রিয়ালেও প্রতিপক্ষ তার পাশটা টার্গেট করে, ব্রাজিলের সাথেও তা-ই করবে। প্রচুর উপরে ওঠেন আর এ কারণে ডিফেন্ড করতে সমস্যা হয়। ঠিক উল্টো গুণাবলী ফিলিপে লুইসের। লুইস রক্ষণে জমাট, নিজের পাশে এমনভাবে ডিফেন্ড করেন যেন কোনো সেন্টারব্যাক মার্ক করছেন। কিন্তু আক্রমণে মার্সেলোর মতো সাবলীল না। গেম বিল্ডআপ, ক্রস বা বল বানিয়ে দেয়ার স্কিলে মার্সেলোর চেয়ে পিছিয়ে। ভাল কথা হলো, কোচের কাছে দুই উপাদানই মজুদ আছে!
সেন্টারব্যাকে খেলবেন থিয়াগো সিলভা-মিরান্ডা জুটি। প্রচন্ড ঠাণ্ডা মাথার সিলভা ম্যান মার্কিংয়ে দারুণ, ফর্মে থাকা সিলভা বিশ্বের সেরাদের একজন কোনো সন্দেহ ছাড়াই। গত বিশ্বকাপের পর ব্রাত্য হয়ে পড়া সিলভাকে দলে আবার নিয়মিত করেন টিটে, আর সেই স্থার প্রতিদান তিনি ভালোই দিচ্ছেন। মিরান্ডার ক্লাব ফর্ম খুব একটা আহামরি ভালো না, কিন্তু ব্রাজিলের জার্সিতে বেশ ভাল খেলেন, যদিও নিরেট নির্ভরশীলতার প্রতীক নন! প্রচন্ড লম্বা এই দুজনের জুটি শারীরিকভাবে শক্ত প্রতিপক্ষের সাথে ভালো কাজে দেবে। বলা বাহুল্য, সিলভা নিয়মিত হওয়ার পর থেকে ব্রাজিল এখনো কোনো গোল খায়নি।
টিটের চাহিদা হলো, নিচ থেকে পাসে খেলা গড়ে তোলা, তাই ডিফেন্ডারদের বল পায়ে দক্ষ হতে হয়। সিলভা এই কাজে দক্ষ হলেও মিরান্ডা নন। চাপের মুখে প্রায়ই বল হারান মিরান্ডা। তাদের বদলি থাকবেন মার্কুইনহোস। টিটের অধীনে প্রথম লম্বা সময় একসাথে খেলেছেন মার্কুইনহোস-মিরান্ডা জুটি সফলভাবেই। মার্কুইনহোস একটু খাটো হলেও রক্ষণে খেলছিলেন দারুণ। আবার ক্লাবে একসাথে খেলেন সিলভার সাথে। কাজেই কারো চোট বা সাসপেনশন হলেও যে জুটিটি হবে তারা একে অপরের সাথে সুপরিচিত। ৪র্থ সেন্টারব্যাক জেরোমেল। বর্ষীয়ান এই ডিফেন্ডার এবার গ্রেমিওকে লাতিন সেরার খেতাব এনে দিয়েছেন। খুব সংক্ষেপে বললে, তার স্কিলসেট অনেকটা সিলভার মতোই, ঠাণ্ডা মাথার ডিফেন্ডার। শুধু সমস্যা একটাই, তিনি খুব বেশি ম্যাচ খেলেননি দলের সাথে, তাই কখনো খেলতে নামলে বোঝাপড়ার সমস্যা হতে পারে।
মাঝমাঠ
জার্মানির সাথে সেই ম্যাচ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল ব্রাজিলের মাঝমাঠ ইউরোপের চেয়ে কতটা পিছিয়ে। স্কোলারি ডিফেন্ডারদের লম্বা বল পাঠাতে বলতেন মাঝমাঠকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য, যেটা জার্মানি ভালই ব্যবচ্ছেদ করেছিল। টিটে মাঝমাঠেই মূল খেলা গড়ায় ইচ্ছুক। দৃষ্টিনন্দন না, বরং ‘ফাংশনাল’ মাঝমাঠ ধারণায় গড়ে তোলা। মাঝমাঠে প্রথমে যার নাম আসবে তিনি ক্যাসেমিরো। খুব দৃষ্টিনন্দন খেলোয়াড় নন কিন্তু দারুণ কার্যকর। জিদানের অধীনে তিন বছর খেলে গেছেন টানা। দলের ‘নোংরা কাজ’ যেমন ট্যাকল, ক্লিয়ার, ট্যাকটিক্যাল ফাউল, বডিপ্রেস করার ভার তার উপর। ক্যাসেমিরো আছেন বলে মার্সেলো, কৌটিনহো উপরে খেলার স্বাধীনতা পান। ব্রাজিল দলে নেইমার বা জেসুস খারাপ খেললেও কেউ না কেউ কভার দিতে পারেন, কিন্তু ক্যাসেমিরোর সরাসরি কোনো বিকল্প নেই। ব্রাজিলের রক্ষণের যে স্থায়িত্ব, সেটার পেছনে তার দারুণ ভূমিকা।
আছেন ম্যানসিটির ফার্নান্দিনহো। মূলত ক্লাবে তার পজিশন ক্যাসেমিরোর একই পজিশন এবং এই রোলে ইংলিশ লিগের সেরাদের একজন তিনি। কিন্তু দলের প্রয়োজনে লেফট মিডে খেলতে পারেন দলে জমাট ডিফেন্স নিশ্চিত করার জন্য। ব্রাজিলের মাঝমাঠ মূলত ৪-৩-৩। থ্রি ম্যান মিডফিল্ডের ডানপাশে নিশ্চিতভাবেই খেলবেন পাউলিনহো। অনেকের অপছন্দ হলেও টিটের সিস্টেমে তার ভূমিকা ব্যাপক গুরুত্বের। জানেন কি, ব্রাজিলের হয়ে টিটের অধীনে বাছাইপর্বে সবচেয়ে বেশি গোল তারই? ব্রাজিল ও বার্সায় তার খেলা দেখলে এটা পরিষ্কার যে, বক্সে সময়মতো চলে আসতে তার জুড়ি মেলা ভার। ওয়ার্করেট ভালো, কিন্তু পাসিং জঘন্য। প্রতিপক্ষ হাইপ্রেস করলে প্রায়ই বল হারিয়ে ফেলেন।
আছেন রেনাতো ও ফ্রেড। রেনাতো ব্রাজিলের এই দলে একসময় নিয়মিত ছিলেন, তাই কখনো নামলে সহজেই সেট হয়ে যেতে পারবেন। যদিও এই দলে ফ্যাবিনহো, এলানের মতো খেলোয়াড়ের বদলে তার অন্তর্ভুক্তি বেশ বিতর্কিত! সদ্য শাখতার থেকে ইউনাইটেডে যোগ দেয়া ফ্রেড বহুমুখী গুণসম্পন্ন খেলোয়াড়। বল পায়ে গেম বিল্ড আপ, লংপাস, থ্রুবল, টেক-অন সবকিছুতেই দক্ষ। কেবল শারীরিকভাবে বল দখলে তার ভালোরকম দুর্বলতা আছে। গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ব্যবধান গড়ে দেয়ার জন্য দারুণ অপশন ফ্রেড।
আক্রমণভাগ
আক্রমণভাগে প্রথমেই নেয়া লাগে নেইমারের নাম। তার সম্পর্কে বেশি কিছু বলার দরকার আছে কি? সুস্থভাবে নেইমার ব্রাজিলের হয়ে যে পাঁচটি টুর্নামেন্ট খেলেছেন তার মধ্যে তিনটির ফাইনাল খেলেছে ব্রাজিল! যে যতই বলুক ‘নেইমারবিহীন এই দল শক্ত’, এই দলের আসল প্রাণই নেইমার। অনেকের মতেই জাতীয় দলের জার্সিতে মেসি-রোনালদোর চেয়েও বেশি নির্ণায়ক শক্তিসম্পন্ন খেলোয়াড় এই নেইমার।
মূল স্ট্রাইকারের ভূমিকায় খেলবেন জেসুস। ম্যানসিটিতে বেশ ভালো মৌসুম কাটানো এই তরুণের দলের গেম বিল্ডআপে ভালো ভূমিকা আছে। টিটের অধীনে শুরু থেকেই খেলা জেসুসের দলের সাথে বোঝাপড়াও ভালো। তার বদলি হিসেবে নামবেন লিভারপুলে স্বপ্নের মৌসুম কাটানো ফিরমিনো, যিনি মূলত ফলস নাইন হিসেবে খেলেন। ব্রাজিল এবার দুজন স্ট্রাইকারকেই প্রস্তুত পেয়ে রাশিয়ায় যাচ্ছে, যেমনটা আগের দুই বিশ্বকাপে হয়নি।
রাইট উইংয়ে খেলবেন উইলিয়ান। ধুঁকতে থাকা চেলসির হয়ে তার ফর্ম ছিল বেশ ভালো। উইলিয়ান দলের জন্য খেটে খেলেন, কস্তার বদলে তাকে খেলানোর আসল কারণ রক্ষণের কাজে ভালো বলে নড়বড়ে রাইটব্যাক ডানিলোকে সহায়তা করতে পারবেন নিচে নেমে। খুব দক্ষ না হলেও ফুল ফর্মে থাকলে দলের জন্য কার্যকরী। শুরু থেকে না খেললেও বদলি হিসেবে নামবেন কস্তা। প্রচন্ড গতিশীল এই উইঙ্গার প্রতিপক্ষের দুর্বল হতে থাকা পায়ের উপর নতুন উদ্যমে আক্রমণ শানাতে বেশ দক্ষ। কস্তা যেকোনো সময় ব্যাবধান গড়ে দেয়ার মতো প্রতিভা রাখেন। এছাড়াও আছেন টাইসন। দলে তার অন্তর্ভুক্তিও ছিল বেশ বিতর্কিত। ক্লাবে উইঙ্গার বা এটাকিং মিডফিল্ডার হিসেবে খেললেও ফ্রেন্ডলি ম্যাচে কোচ তাকে কৌতিনহোর জায়গায় খেলান। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো, কিছু খেলোয়াড় থাকে যাদের ঠিক কোনো নিয়মে ফেলা যায় না, কেবল কোচই জানেন কেন তার জায়গা পাওয়া। টাইসনও এমনই একজন!
খেলার ধরন
আদতে ৪-১-৪-১ বললেও মূল ফর্মেশন ৪-৩-৩। টিটের কৌশলে ফুলব্যাকদের স্থান মাঝমাঠে। কোনো ম্যাচে ডিফেন্সিভ খেলাতে চাইলে মাঝমাঠ হবে ফার্না-ক্যাসেমিরো-পাউলিনহোর আর কৌতিনহো চলে আসবেন রাইট উইংয়ে। বল পায়ে রেখে আক্রমণাত্মক ধাঁচে খেলে- এমন দলের সাথে এভাবে খেলাতে পারেন কোচ। এছাড়া সাধারণভাবে মাঝমাঠ হবে কৌতিনহো-ক্যাসেমিরো-পাওলিনহোর। রাইট উইঙ্গার উইলিয়ান, রাইট মিডের পাউলিনহো আর ডানিলো মিলে ডানপাশ সামলাবেন। সমস্যা হলো, মার্সেলো খেললে সেই পাশে একটা শূন্যতা তৈরি হয়ে যায়, ফার্না খেললে সেটা থাকে না। কিন্তু বল পায়ে অসাধারণত্ব ও প্লেমেকিং বিবেচনায় কৌতিনহো খেলবেন লেফট মিডে, আর আছেন লেফট উইংয়ে নেইমার। ফলে ক্যাসেমিরোর উপর মূল মাঝ অংশ ছাড়াও মার্সেলোকে কভার করতে হবে। সবচেয়ে ভালো হতো নেইমার-কৌতিনহো জুটি ঠিক রেখে লেফট ব্যাকে লুইসকে খেলালে, এতে রক্ষণের শূন্যতা থাকতো না।
এই ব্রাজিল দলটি একটি কাঠামোর উপর দাঁড়িয়ে। এ কারণেই মার্সেলো-আলভেসের মতো রক্ষণে দুর্বল খেলোয়াড় আর ক্লাবের ফ্লপ মিরান্ডাকে নিয়েও টিটের অধীনে ব্রাজিল ২১ ম্যাচে মাত্র ৫ গোল হজম করেছে। কৌতিনহোর ভূমিকা হবে অনেকটা রিভালদোর মতো। ২০০২ সালে রোনালদোর গোল বহুল আলোচিত হলেও রিভালদোর ৫ গোল ও ৩ এসিস্ট ছিল নেপথ্য শক্তি। কৌতিনহোর পায়ে দুটোই আছে। প্লেমেকিং, থ্রু বল, শ্যুট, স্কোর সব মিলিয়ে এই বার্সা তারকা যদি পুরো ফর্মে ফিট থেকে খেলতে পারেন, ব্রাজিলের সম্ভাবনা অনেকটাই বেড়ে যায়।
ব্রাজিলের এই মাঝমাঠ আসলে দুর্বল না ফাঁদ- এটাও একটা ব্যাপার। কৌতিনহোকে মাঝমাঠে এনে সাথে মাঝমাঠে দুই কনভার্টেড ফুলব্যাক আর ক্যাসেমিরো মিলে বেশ পাসিং ভালোই, বিশ্বমানের না হলেও। বল উদ্ধারে সপ্রতিভ বলে কাউন্টার অ্যাটাক হয় বেশি। টিটে যেটা নিশ্চিত করতে চান তা হলো, কোনো প্লেয়ার ভুল করলেও যেন সেটা কভার দিতে আরেকজন পাশেই উপস্থিত থাকেন। এই জমাট কাঠামোই ব্রাজিলকে খানিকটা আশা যোগাচ্ছে।
দুর্বলতা
২০১৪ পরবর্তী প্রায় দুই বছর টালমাটাল অবস্থায় থাকা ব্রাজিল টিটের অধীনে সময় পেয়েছে সাকুল্যে দুই বছর, যেটা জার্মানির লো বা ফ্রান্সের দেশমের চেয়ে ঢের কম। ব্রাজিল একটি কাঠামো পেয়ে গেলেও এটায় এখনো পুরো অভ্যস্ত না। বলা চলে, সুতোয় দাঁড়িয়ে ব্রাজিল দল। কোনো কারণে ক্যাসেমিরো, নেইমার বা কৌতিনহোর ইনজুরি ব্রাজিলের স্বপ্ন মাটি করে দিতে পারে। টিটে ২০১৪ থেকে থাকলে আরো ভালোভাবে দলকে দাঁড়া করাতে পারতেন। দিনশেষে এই সময়টাই এখন আফসোসে ফেলছে ফেডারেশনকে!
ব্রাজিলের স্ট্রাইকার হিসেবে জেসুস দারুণ, তবে বিশ্বকাপের মতো মঞ্চের চাপের জন্য কি তিনি প্রস্তুত? সেই রকম শারীরিক অবস্থাও আছেন কি না তা নিয়েও ব্রাজিলের কিছু সাংবাদিকের সংশয়। হয়তো ব্রাজিল একজন পুরোদস্তুর নাম্বার নাইন মিস করবে। উইলিয়ানের ভূমিকাটা দলে কেমন যেন বিচ্ছিন্ন, কারণ শুরু থেকে দলে রাইট উইংয়ে ছিলেন কৌতিনহো। তার মানিয়ে নেয়াটা দ্রুত হলে ব্রাজিলের আক্রমণে ভাল মাত্রা আসবে।
বল পায়ে পাওলিনহো ও মিরান্ডার দুর্বলতা টিটের নিচ থেকে খেলা গঠনকেই ঝুঁকির মুখে ফেলতে পারে। এই কৌশলে যারা খেলে তাদের পুরোদস্তুর পারফেকশন লাগে। ভেবে দেখুন ২০১৪ এর ফাইনালে ক্রুসের সেই ভুল পাসে যদি হিগুয়েইন গোল পেয়ে যেতেন? ঠিক একইভাবে এমন বড় মঞ্চে একটু ভুলও বড় হয়ে দেখা দিতে পারে।
ব্রাজিলের দুই উইংব্যাক মার্সেলো ও ডানিলো রক্ষণে দারুণ দুর্বল। কোনো বড় দলের সাথে ব্রাজিল সমস্যায় পড়তে পারে। ২০১৪ বিশ্বকাপ ফাইনালে পুরো ম্যাচে নিরেট থাকা জাবালেতা কেবল একবারই একটু ফাঁক দিয়েছিলেন শুর্লের সেই ক্রসে, যা থেকে গোতজে গোল দেন! আর সেই জায়গায় ডানিলো-মার্সেলোর রক্ষণে অনেক দুর্বলতা। উপায় একটিই, ট্যাকটিক্যালি তাদের উপরে ওঠা সীমাবদ্ধ রাখা ও ভালো কভার যেন পান তা নিশ্চিত করা।
গতবারের তুলনায় এবার!
সেই ফ্রেড আর জো এর তুলনায় এবারের স্ট্রাইকার ফিরমিনো-জেসুস অনেকগুণে ভালো। যে আক্রমণভাগ গতবার খুঁড়িয়েছে, এবার অন্তত তার চেয়ে ঢের ভালো। গুস্তাভো-পাওলিনহো-অস্কারের ‘নন-ফাংশনাল’ মাঝমাঠের চেয়ে এবারের কৌতিনহো-পাওলিনহো-ক্যাসেমিরোর মাঝমাঠ অনেক ভালো ঠেকছে। দলের নেইমার-নির্ভরতা বেশ কম। এর মানে এই না যে, নেইমার ছাড়াই চলে, কিন্তু দলে কেউ না কেউ লড়াই চালিয়ে যাওয়ার মানসিকতা রাখে। সর্বোপরি এটা একটা ‘দল’!
গতবারের ব্রাজিল ছিল বিচ্ছিন্ন এক ইউনিট। স্কোলারি ইচ্ছে করেই মাঝমাঠ বাইপাস করতেন ডিফেন্ডারদের দিয়ে আক্রমণভাগের কাছে লংবল দিয়ে, বাকিটা নেইমারের উপর! এবারে ব্রাজিল শর্টপাস, কাউন্টার অ্যাটাক সব মিলিয়ে একটি দলের মতো খেলছে। কিন্তু ভাগ্যও দরকার। সুসংগত কাঠামোর উপর গড়ে ওঠা যেকোনো দলেরই বাজে দিন আসে। সেই দিন ভাগ্য সুপ্রসন্ন না হলেই বিপদ। গতবারের তুলনায় ব্রাজিল এবার অনেক সুসংগঠিত। অভাব কেবল সেই দুঙ্গার আমলে নষ্ট হওয়া দুই বছরের!
বেঞ্চ ও প্ল্যান বি
২০১০ সালে এগিয়ে গিয়েও হল্যান্ডের সাথে যখন ব্রাজিল পিছিয়ে পড়ে, তখন ব্রাজিলের বেঞ্চে ছিল নিলমার-গ্রাফিতে! গতবার ব্রাজিলের বেঞ্চে হার্নানেস-বার্নাড। এবার জেসুসের বদলে নামার জন্য তৈরি থাকবেন চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সর্বোচ্চ মোট গোল-অ্যাসিস্টদাতা ফিরমিনো, উইলিয়ানের বদলে নামবেন জুভেন্টাসের নিয়মিত তারকা কস্তা, পাউলিনহো-ক্যাসেমিরোর বদলে নামবেন ফার্নান্দিনহো বা ফ্রেডের মতো বহুমুখী গুণসম্পন্ন খেলোয়াড়রা।
গত তিন বিশ্বকাপে ব্রাজিলের কোনো প্ল্যান বি ছিল না। এবার স্পষ্ট দুটো প্ল্যান। যেসব দল রক্ষণাত্মক খেলে তাদের বিপক্ষে কৌতিনহোকে মাঝমাঠে রেখে পুরো আক্রমণাত্মক মেজাজে, আর যেসব দল বল পায়ে বেশি রেখে আক্রমণাত্মক খেলে তাদের সাথে ফার্নান্দিনহোকে মাঝে রেখে জমাট রক্ষণ খেলানো। এদিকটাও হালের ব্রাজিল দলগুলোর ক্ষেত্রে নতুন।
সম্ভাব্য লাইনআপ
অ্যালিসন
ডানিলো-সিলভা-মিরান্ডা-মার্সেলো
পাওলিনহো-ক্যাসেমিরো-কৌতিনহো
উইলিয়ান-জেসুস-নেইমার
ম্যাচগুলোর সূচী
ব্রাজিল-সুইজারল্যান্ড (১৭ জুন, রাত ১২.০০)
ব্রাজিল-কোস্টারিকা (২২ জুন, সন্ধ্যা ০৬.০০)
ব্রাজিল-সার্বিয়া (২৭ জুন, রাত ১২.০০)
ব্রাজিল মোটামুটি সব টুর্নামেন্টেই যায় ফেভারিট হিসেবে, যদিও অনেক সময় আন্দাজ করাই যায় যে, এই দল জেতার মতো বা এবার জেতার মতো না। এবারের দলটি সত্যিই মধ্যাবস্থায়। তাত্ত্বিক অনেক সমস্যা থাকার পরেও এই ব্রাজিল একটি দল হিসেবে খেলছে, যেটি আশার বিষয়। আবার দলে বেশ কিছু বড় ঘাটতি আছে যা প্রকট হয়ে দেখা দিতে পারে যেকোনো সময়েই।
তবে ব্রাজিল তার প্রথম লড়াইটি জিতে নিয়েছে। ২০১৪ এর লজ্জার পর আবার অন্ধকার যুগ পেরিয়ে স্বল্প সময়ে যেভাবে উঠে এসে আবার নিজেদের দাবিদার হিসেবে প্রকাশ করেছে এটিও একপ্রকার বিজয়। ঠিক এজন্যই বলা হয় যে, এই দলে এক টিটে যেকোনো খেলোয়াড়ের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ব্রাজিল জেতার মতো দল কি? উত্তরের জন্য অনেকগুলো ফ্যাক্টর একসাথে ক্লিক করতে হবে এবং হয়তো সম্ভব। কিন্তু যেটা নিঃসন্দেহ তা হলো, গতবারের মতো লজ্জাজনক পরিণতি এবার হবে না। উল্টো ভালো কিছুও হতে পারে।
ফিচার ছবিসত্ত্ব: ASHARQ AL-AWSAT English Archive